শনিবার, ৯ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

মুঘল প্রাদেশিক শাসন

মুঘল সাম্রাজ্যের প্রদেশকে বলা হতো সুবাহ। এর প্রশাসকদের বলা হতো সুবাদার। মুঘল অধিকার স্থিতিশীল হলে  আকবর তাঁর রাজত্বের ২৪তম বছরে (১৫৭৯-৮০ খ্রিস্টাব্দে) সাম্রাজ্যকে ১২টি প্রদেশ বা সুবাহতে বিভক্ত করেন। এগুলো হলো- এলাহাবাদ, আগ্রা, অযোধ্যা, আজমির, আহমেদাবাদ, বিহার (রাজধানী পাটনা), বাংলা (রাজধানী রাজমহল), দিল্লি, কাবুল, লাহোর, মুলতান ও মালওয়া। পরে দাক্ষিণাত্যের বেরার, খান্দেশ ও আহমেদনগর অধিকৃত হলে সুবাহর সংখ্যা দাঁড়ায় পনেরোয়। সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় ওড়িশা ও কাশ্মীর সুবাহর মর্যাদা পেলে সংখ্যা হয় ১৭। প্রথম সুবাহব্যবস্থা প্রবর্তনের সময় ওড়িশা বাংলার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল পরে তা পৃথক সুবাহর মর্যাদা পায়। সম্রাট শাহজাহানের সময় সুবাহ হয় ২২টি। তিনি তাঁর রাজত্বের অষ্টম বছরে তেলেঙ্গানাকে বেরার থেকে পৃথক করে একটি সুবাহর মর্যাদা দেন। আওরঙ্গজেব ১৬৮৬ খ্রিস্টাব্দে বিজাপুর ও ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দে গোলকুন্ডাকে নতুন সুবাহ ঘোষণা করেন। তাঁর সময় সুবাহ ছিল ২১টি। ১৭১০ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট শাহ আলমের সময় আর্কট প্রদেশটি মুঘল সুবাহর অন্তর্ভুক্ত হয়। সম্রাট আকবর কর্তৃক বাংলার একাংশ বিজয়ের পর মুঘল শাসনব্যবস্থায় বাংলা একটি প্রশাসনিক এককে পরিণত হয়। আঠারো শতকের শেষ নাগাদ বাংলায় এ ব্যবস্থা পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে। এই সময়ের মধ্যে সুবে বাংলার ভৌগোলিক অবস্থান, অভ্যন্তরীণ প্রশাসন, কেন্দ্রের সঙ্গে এর সম্পর্কের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। আবুল ফজল তাঁর আইন-ই-আকবরি গ্রন্থে সুবাহ বাংলার ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে যে বিবরণ দিয়েছেন তাতে কিছুটা বিভ্রান্তি থাকলেও এ বিবরণ থেকে সুবে বাংলার প্রাথমিক একটা তথ্যচিত্র পাওয়া যায়। যেমন সুবে বাংলার সীমানা গড়হি (তেলিয়াগড়) থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত। এর দৈর্ঘ্য ৪০০ ক্রোশ (১ ক্রোশ = দেড় কিলোমিটার) উত্তরে পর্বতমালা থেকে সরকার মান্দরণের (হুগলি জেলা) দক্ষিণ সীমা পর্যন্ত প্রস্থে ২০০ ক্রোশ। ওড়িশা সুবে বাংলার সঙ্গে যুক্ত হলে দৈর্ঘ্যে আরও প্রায় ৪৩ ক্রোশ ও প্রস্থে আরও ২৩ ক্রোশ বৃদ্ধি পায়। সুবে বাংলার পুবে সমুদ্র, দক্ষিণে পর্বতমালা, পশ্চিমে বিহার এবং পুবে ভাটি অঞ্চল অবস্থিত যা বাংলার অন্তর্ভুক্ত। বাংলার উত্তরে কোচ, কামরূপ ও কামতা রাজ্য। এ রাজ্যের সীমান্তেই আসাম অবস্থিত। সুবে বাংলার দক্ষিণ-পুবে আরাকান এবং এখানেই চট্টগ্রাম বন্দর। আবুল ফজলের দেওয়া তথ্যে যে ভুলটি ছিল তা হলো বাংলার পুবে সমুদ্র নয় বরং ত্রিপুরা রাজ্য অবস্থিত ছিল এবং দক্ষিণে শুধুই সমুদ্র, পর্বতমালা ছিল না। অবশ্য আবুল ফজল ১৫৯৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর লেখা শেষ করার প্রায় এক যুগ আগে সুবে ব্যবস্থা চালু হয়েছিল এবং বাংলা দুর্বলভাবে হলেও সুবে ব্যবস্থার অধীন এসেছিল। সে সময় সুবে বাংলার আয়তন ছিল কম। ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে আফগান শাসক দাউদ খান কররানি মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হলে বাংলা থেকে আফগান শাসনের অবসান হয় এবং মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠা হয়। কিন্তু তখন সারা বাংলা মুঘল আধিপত্য স্বীকার করেনি। কারণ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে আফগান সেনানায়ক এবং বারো ভূঁইয়াদের প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল। তা ছাড়া বাংলায় অবস্থানরত মুঘল সেনাদের একাংশও বিদ্রোহ করেছিল। ফলে আকবর প্রশাসনের অধীন সুবে বাংলার বিস্তৃতি থেমে থাকে।

১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে আকবরের মৃত্যুর সময় সুবে বাংলার সীমানা ছিল উত্তরে ঘোড়াঘাট, দক্ষিণ-পশ্চিমে সাতগাঁও ও বর্ধমান, পুবে করতোয়া নদী এবং বগুড়ার শেরপুর মোর্চার বরাবর একটি সমান্তরাল এলাকা এবং পশ্চিমে রাজমহল। অর্থাৎ আবুল ফজলের বর্ণিত সুবে বাংলার সীমানা সতের শতকের শুরুতে প্রকৃতপক্ষে এমনটাই ছিল। যদিও তাঁর সময়ে চট্টগ্রাম মুঘলদের অধীন আসেনি। চট্টগ্রাম অঞ্চল সুবে বাংলার অধীন হয় ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়। সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে  ইসলাম খান চিশতি বাংলার সুবাহদার নিযুক্ত হলে তাঁর প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কৌশল বাংলার জন্য যথার্থভাবে কার্যকর হয় এবং সুবে বাংলার সীমানা বৃদ্ধি পায়। ইসলাম খান ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় আসেন এবং একে সুবে বাংলার রাজধানী ঘোষণা দিয়ে এর নাম করেন  জাহাঙ্গীরনগর।  মুর্শিদকুলি খান কর্তৃক ত্রিপুরা, বিহারের ভাগলপুর ও পূর্ণিয়ার কিছু অংশ সুবে বাংলার অন্তর্ভুক্ত হয় এবং আঠারো শতকে মেদেনিপুর বাংলার সঙ্গে সংযুক্ত হলে মুঘল সুবে বাংলার সীমানা পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর