রবিবার, ১০ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

ইয়াহিয়া জানতেন ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ আত্মহত্যার শামিল

খুশবন্ত সিং

ইয়াহিয়া জানতেন ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ আত্মহত্যার শামিল

অনুবাদ : আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

 

ইয়াহিয়া খানকে যখন প্রশ্ন করা হয়েছিল পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে প্রথম আঘাত হানার কথা ভাবছে কিনা? তিনি উত্তর দেন, ‘সামরিক দিক থেকে এটি আত্মহত্যার শামিল হবে।’ কথাটি তিনি বলেছিলেন আমাদের বিমান ঘাঁটিগুলোর ওপর বোমাবর্ষণ এবং আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করার জন্য তাঁর বিমানবাহিনীকে আদেশ দেওয়ার মাত্র কদিন আগে। পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নিতে পারে সে সম্পর্কে ধারণা থাকলে কেন তাঁর দেশকে এমন একটি যুদ্ধে জড়িত করেছিলেন যে যুদ্ধে তিনি পরাজিত হবেন বলে জানতেন?

 

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান একদিকে দূরদৃষ্টি দেখাননি অন্যদিকে দেশ পরিচালনায় তাঁর মধ্যে কোনো স্থিরতা ছিল না। তিনি একজন সৈনিক এবং তাতেও তাঁর তেমন কোনো বৈশিষ্ট্য ছিল না। সামরিক বাহিনীর কাঠামোয় তাঁর পদোন্নতিগুলো সৈনিকসুলভ যোগ্যতার কারণে নয় বরং প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টদের তোয়াজ করার কারণে হয়েছে। অনেকটা কাকতালীয়ই তিনি নিজেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ পদে দেখতে পান যখন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের অবস্থান নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল। তত দিনে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর লোকদের দ্বারা শাসিত হতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। আইয়ুব খানের কাছ থেকে ইয়াহিয়া খান এমন এক উপায়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেন ঠিক যেভাবে কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান অবসর গ্রহণ করলে তার অধস্তন কেউ দায়িত্ব গ্রহণ করে। এমনকি রাজনীতিবিদরা প্রেসিডেন্ট পদের জন্য প্রতিযোগিতায় ছিলেন না কারণ রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের কাছে নিন্দিত ছিল এবং জনগণকে কখনো তাদের মতামত প্রকাশের সুযোগ দেওয়া হয়নি। পাকিস্তানের জন্য এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার ছিল যে তাদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের সবচেয়ে সংকটের মুহূর্তে মাঝারি মানের একজন সৈনিক যিনি এত দ্রুত নিজেকে নিম্নতম পর্যায়ের প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রমাণ করেন।

সামরিক ইউনিফর্ম থেকে বেসামরিক পোশাক পরিবর্তনে কোনো ব্যক্তির বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটে না। পাঁচ তারকাবিশিষ্ট জেনারেল দেশের অদৃষ্টকে নির্দেশনা দিতে পরিস্থিতি দ্বারা তাড়িত হয়ে সব সময় যা করেছেন তা হলো ধাপ্পাবাজি, নোংরা কথাবার্তা বলা, মেজাজি আচরণ প্রদর্শন এবং চিন্তাভাবনায় তিনি সব সময় ছিলেন দ্বিধাগ্রস্ত। তাঁর কোনো রাজনৈতিক আদর্শ অথবা রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল না। অর্থাৎ ভাগ্য তাঁর কোলে যে ক্ষমতা অর্পণ করেছিল তা দৃঢ়তার সঙ্গে ধারণ করার সাধ্যও তাঁর ছিল না। ঘটনাপ্রবাহকে দেশ ও জাতির স্বার্থে কাজে লাগানোর পরিবর্তে ইয়াহিয়া খান উদ্ভূত পরিস্থিতি ও ঘটনাবলিকে নিজের বিপদ ডেকে আনার পথে এগিয়ে নিলেন। তিনি যা করতে পারতেন তা হলো ব্যাধির জন্য নির্ধারিত ব্যবস্থাপত্রের ছোট বইয়ে তালিকাভুক্ত ব্যাধি উপশমকারী ব্যবস্থাপত্র অনুসরণ করা। জনগণ যখন নির্বাচন দাবি করছিল তখন তিনি তাদের নির্বাচন দিলেন। নির্বাচনের ফলাফল কী হবে সে সম্পর্কে তিনি পূর্ব ধারণা করতে পারেননি। ফলাফল যখন তাঁর কাছে অগ্রহণযোগ্য বলে মনে হলো তিনি একজন ক্ষমতাধর পুরুষ হিসেবে ফলাফল মেনে না নিয়ে তা মোকাবিলা করতে সোজাসাপ্টা অস্বীকার করে বসলেন। বরং তিনি ধৃষ্ট শিশুর মতো আচরণ শুরু করলেন এবং তাঁকে যে ওষুধ পান করতে দেওয়া হলো তা পান করতে অস্বীকৃতি জানালেন। একটির পর একটি অজুহাত দেখানোর কৌশল গ্রহণ করলেন। অর্থাৎ নির্বাচনের ফলাফল তিনি গলাধঃকরণ করতে পারছেন না। চিন্তাধারা এবং কাজেও অনুরূপ দ্বিধা দেখা গেছে ভারতের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে। একদিন তিনি ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কথা এবং যুদ্ধে তাঁকে সাহায্য করবে এমন বহু বন্ধুর কথা বলেন। পরদিন দিন জলপাইয়ের শাখা নাড়েন এবং সৎপ্রতিবেশীসুলভ ধর্মোপদেশ শোনান। এরপর হঠাৎই সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন, শান্তিপূর্ণ উদ্যোগের ক্ষেত্রে তিনি যথেষ্ট অবদান রেখেছেন এবং বিমানবাহিনী ও সেনাবাহিনীর লাগাম ছেড়ে দেন যা তিনি স্বয়ং বর্ণনা করেছেন ‘সামরিক আত্মহত্যা’ হিসেবে। জুলফিকার আলী ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানে এখন একমাত্র ক্ষমতাবান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যিনি প্রেসিডেন্টের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন মাটিতে গড়া, যিনি তাঁর কাজ করছেন অনিচ্ছার সঙ্গে। ভুট্টোর জন্ম অতি ধনবান পরিবারে, সুশিক্ষিত, পরিপাটি, ভদ্রজনোচিত এবং মার্জিত। তিনি সুদর্শন, সংস্কৃতিমান, বাস্তববাদী, পড়ুয়া, সক্ষম এবং উচ্চাভিলাষী। তিনি যেমন বলতে পারেন তেমন লিখতেও পারেন। এসব যোগ্যতা ও গুণের সমন্বয় তাঁকে সিংহাসনের এক অদম্য প্রতিযোগীতে পরিণত করেছে। ভুট্টো স্বচ্ছ মস্তিষ্কের মানুষ এবং পাকিস্তানের ভূমিকার ওপর তাঁর দর্শন ও ভবিষ্যতে তিনি পাকিস্তানকে কী দিতে চান সে সম্পর্কে পরিকল্পনা তিনি একাধিকবার ব্যক্ত করেছেন।

তিনটি বিষয়ে তিনি অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট। তাঁর দেশের সবকিছু নিশ্চয়ই তাঁর নখদর্পণে। পাকিস্তান অবশ্যই কমিউনিস্ট চীনের সঙ্গে এবং ইসলামী দেশগুলোর সঙ্গে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ, বিশেষ করে তুলনামূলকভাবে অগ্রসর ইরান ও তুরস্কের সঙ্গে। এবং পাকিস্তান অবশ্যই ভারতের ওপর প্রাধান্য বজায় রাখবে এমনকি তারা যদি এও বোঝাতে চায় যে হাজার বছরের জন্য বিরামহীন যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।

ইয়াহিয়া খান এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো তাদের মধ্যে ঘটনা প্রবাহের গতি স্থির করে নিয়েছেন যা উপমহাদেশকে যুদ্ধের অগ্নিশিখায় আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। আমরা আজ যে বিয়োগান্ত নাটক প্রত্যক্ষ করছি তার মধ্যে এ দুই ব্যক্তির ভূমিকাকে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো কীভাবে দেখছে তা দেখার জন্য আমাদের গত বছরের চেয়ে বেশি দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।

নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো আবশ্যকতা ইয়াহিয়া খানের ছিল না। কিন্তু জনগণ যেহেতু নির্বাচন চাইছিল তাই তিনি তাদের নির্বাচন দেন ক্ষমতার সঙ্গে নিজেকে কোনো পক্ষভুক্ত করার উদ্দেশ্য ছাড়াই। ভুট্টো নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন কারণ তিনি জানতেন রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করা থেকে সেনাবাহিনী ও ইয়াহিয়া খানের মতো লোকদের উৎখাত করার এবং তাঁর জন্য পাকিস্তানের একচ্ছত্র নেতা হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার এটিই একমাত্র উপায়। এমনকি নির্বাচনের সময় ভুট্টো ‘ভারতের সঙ্গে হাজার বছর ধরে যুদ্ধ’ করার সেøাগান কাজে লাগিয়েছিলেন। আমরা ভারতে সরলভাবে বিশ্বাস করেছিলাম যে পাকিস্তানের শাসক হিসেবে একবার যদি জনগণের প্রতিনিধি সেনাবাহিনীর স্থলাভিষিক্ত হয় তাহলে আমাদের দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটবে। আমাদের যা করার ছিল তা হচ্ছে ভারতের প্রতি শেখ মুজিবুর রহমানের অভিব্যক্ত বন্ধুসুলভ অনুভূতির সঙ্গে থাকা। আমাদের বিরুদ্ধে ভুট্টোর ‘হাজার বছরের যুদ্ধের’ গগনবিদারী চিৎকারের প্রতি আমরা কান দিইনি।

পাকিস্তানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। যদিও ফলাফল ইয়াহিয়া খানের পছন্দমাফিক হয়নি এবং যদিও ভোটারদের রায়-পরবর্তী যৌক্তিক অবস্থা মেনে নেওয়ার উদ্দেশ্য তাঁর ছিল না তবু তিনি তাঁর স্থূল বুদ্ধি -বিবেচনা নিয়ে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে শুভেচ্ছা জানাতে যান। ইয়াহিয়া খানের মনের কথা জুলফিকার আলী ভুট্টো জানতেন। তিনি ক্ষমতার শীর্ষের এতটাই কাছে চলে এসেছিলেন। তাঁর পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে শুধু ইয়াহিয়া খান ও শেখ মুজিবুর রহমান। নির্বাচনে জনগণের পছন্দনীয় ব্যক্তির অনুকূলে ইয়াহিয়া খানের ঘোষিত উদ্দেশ্যের কাছে তিনি হেরে গেলেন। অতএব তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ ভেবে তাঁর অবস্থান পরিবর্তন করলেন। যদিও এর আগে তিনি পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের শোষণের সমালোচনা করেছেন এবং পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু এবার তিনি শেখ মুজিবকে বিশ্বাসঘাতক বলে দোষারোপ করলেন। যা ভুট্টোকে সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ করেছিল তা ছিল শেখ মুজিব কর্তৃক ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে উচ্ছ্বসিত আশাবাদ ব্যক্ত করা।

পাকিস্তানের প্রথম স্বাধীন ও অবাধ নির্বাচনের ব্যাপারে ভারতের প্রতিক্রিয়া ইন্দিরা গান্ধীর চেয়ে আর কেউ ভালোভাবে ব্যক্ত করেননি। তিনি বলেন, ‘আমরা পাকিস্তানের জনগণের কল্যাণ কামনা করি।’

ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার মতলবের বিপরীতে পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা যখন ক্ষমতা ভাগাভাগি করার কাজে ব্যস্ত ছিলেন ঠিক তখনই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ঘটল ’৭১ সালের ৩০ জানুয়ারি লাহোরে আমাদের একটি ফকার-ফ্রেন্ডশিপ বিমান হাইজ্যাক করার ঘটনা। ইয়াহিয়া খান তাঁর মন স্থির করতে পারছিলেন না যে বিমান অথবা হাইজ্যাকারদের ব্যাপারে তিনি কী করবেন। তিনি বিমান ভারতকে ফেরত দেওয়া, ফেরত না দেওয়া, হাইজ্যাকারদের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার ব্যাপারে পূর্ণ তদন্ত পরিচালনা ইত্যাদি কথাবার্তা বলছিলেন। ভুট্টো এ ঘটনাকে ক্ষমতা হাইজ্যাক করার সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে চেষ্টা করলেন। বিমানটি হাইজ্যাক করার তিন দিন পর তিনি লাহোর বিমানবন্দরে উচ্ছ্বসিত উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে নিয়ে যান তাঁর নেতৃত্বে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর চোখের সামনে হাইজ্যাকারদের দ্বারা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বিমানটি ধ্বংস করার সুযোগ দেওয়া হয় এবং ভুটো হাইজ্যাকারদের বীর বলে প্রশংসা করেন। (শিগগিরই তিনি তাঁর কথা পাল্টান এবং হাইজ্যাকারদের ভারতীয় এজেন্ট বলে ঘোষণা করেন)। ইয়াহিয়া খানের সিদ্ধান্তহীনতা আর ভুট্টোর ভ্রান্তিপূর্ণ একগুঁয়েমির কারণে পাকিস্তানকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। ভারত তার বিমান ধ্বংসের ঘটনার প্রতিশোধ নেয় ভারতের আকাশসীমা দিয়ে পাকিস্তানের বিমান চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের মধ্য দিয়ে। এর মাধ্যমে আমরা পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে ১ হাজার ২০০ মাইলের দূরত্ব ১ হাজার ৮০০ মাইলে বৃদ্ধি করি। এটি ছিল পাকিস্তানের কফিনে লাগানো ভারতের প্রথম পেরেক। কফিনটি এখন অপেক্ষা করছে আত্মহত্যাজনিত লাশের জন্য। যে নির্বুদ্ধিতা ও অদক্ষতার সঙ্গে ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম মোকাবিলার চেষ্টা করেছেন তা তাঁর নিজের মৃত্যু কামনার আরও প্রমাণ সামনে আনে। নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রায় নিরঙ্কুশ (১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসন) বিজয় সত্ত্বেও ইয়াহিয়া খান তাঁকে গ্রেফতার করেন এবং জেনারেল টিক্কা খানকে নিয়োগ করেন বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে বোঝাপড়ার জন্য। এ পরিকল্পনার অংশ ছিল বাঙালিদের তাদের স্বস্থানে রাখা এবং সন্দেহ নেই যে এর পেছনে কারণ ছিল পাঞ্জাবি ও পাঠানদের পৌরুষ নিয়ে অতিরঞ্জিত ধারণা এবং এর সঙ্গে যুক্ত ছিল ডাল-ভাত ভোজী বাঙালি বাবুদের প্রতি ঘৃণা।

শুধু জাতিগত ঔদ্ধত্যই সবকিছু ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের বিপুল জনপ্রিয়তা সম্পর্কেও ইয়াহিয়া ও টিক্কা খানের ধারণা ছিল সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর। একজন মানুষ ও জেনারেল হিসেবে টিক্কা খান সব বিবেচনায় এক মহামূর্খ, যিনি বিশ্বাস করতেন কয়েক শ ‘দুষ্কৃতকারীকে’ গুলি করে মেরে ফেললেই বাদবাকি মানুষের শিক্ষা হবে। টিক্কা খানের সেনারা ’৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ড্রাগনের যে বীজ বপন করেছিল তা রাতারাতি গজিয়ে ওঠে মুক্তিবাহিনী হিসেবে।

মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে পাকিস্তানিদের ক্ষিপ্ততাও বেড়ে চলে। বিদ্রোহ দমনের জন্য তারা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সাড়ে চার ডিভিশন সৈন্য নিয়ে আসে এবং তারা এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে আটকা পড়ে যা রূপ নেয় বিরতিহীন এক যুদ্ধের। ইয়াহিয়া খান, টিক্কা খান অথবা জুলফিকার আলী ভুট্টো জানতেন না কী করে তারা এ জলাভূমি থেকে নিজেদের বের করে আনবেন।

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত সঠিক ছিল। আমাদের সুস্পষ্ট ও প্রকাশ্য সহানুভূতি সত্ত্বেও আমরা বস্তুগত কোনো সহায়তা প্রদান করিনি। বরং মুক্তিযোদ্ধারা যখন দলে দলে ভারতে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়, বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স তাদের অস্ত্র নিয়ে নেয়। বাংলাদেশের বিষয়ে আমরা প্রথমবারের মতো জড়িত হই এপ্রিলের শেষ দিকে যখন হিন্দু ও মুসলিম উভয় ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লাখ লাখ শরণার্থী সীমান্ত পেরিয়ে আমাদের ভূখন্ডে প্রবেশ করে। আমরা পাকিস্তান এবং বিশ্বের কাছে এর প্রতিবাদ জানাই। পাকিস্তান আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে, আমরা মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্রসজ্জিত ও শরণার্থীদের প্ররোচিত করছি। তারা শরণার্থী সংখ্যা কম করে দেখাচ্ছে (এখনো তারা বলছে এ সংখ্যা ৩০ লাখের নিচে) এবং তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে প্রতারণামূলক কথাবার্তা বলছে। অবশিষ্ট বিশ্ব আমাদের যথেষ্ট উপদেশ, সহানুভূতি, কিছু অর্থ, খাদ্য এবং ওষুধ প্রদান করেছে। শরণার্থী সংখ্যা ১ কোটি ছাড়িয়ে গেছে।

আগস্টের মধ্যে মুক্তিবাহিনী তাদের অভিযান বৃদ্ধির পর ভারত উপলব্ধি করে ১ কোটি অনাহূত অতিথিকে ফেরত পাঠানোর একমাত্র উপায় বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সেনবাহিনী উচ্ছেদ ও শেখ মুজিবুর রহমানের নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা। আমাদের আবেগময় সহানুভূতি প্রকৃত অর্থে ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে জড়িত হওয়ার রূপ নেয়। ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বকে হুঁশিয়ার করেন বিশ্ব যদি কোনো কিছু না করে তাহলে ভারত-পাকিস্তান সামরিক সংঘাত সময়ের ব্যাপার মাত্র। শেষ আশ্রয় হিসেবে আমরা আমাদের বন্ধুদের দিকে, প্রধানত সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে হাত বাড়াই। পাকিস্তান হাত বাড়ায় তার বন্ধু চীন, ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের দিকে।

দৃশ্যত যুদ্ধ শুরু হওয়ার বেশ আগে ইয়াহিয়া খান এবং তাঁর সামরিক উপদেষ্টারা সেনাবাহিনীর সাড়ে চার ডিভিশন পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে তারা তাদের বিমানবাহিনীর অধিকাংশই প্রত্যাহার করে নেন। তাদের কৌশল ছিল সহজ, কিন্তু তা পুরোপুরিই ভুল ধারণার ওপর ছিল। তারা ভেবেছিলেন পশ্চিমে তারা প্রবল আঘাত হানতে সক্ষম হবেন এবং এর সুফল পাওয়া যাবে পূর্ব পাকিস্তানে।

পাকিস্তানিরা নিজেরাই নিজেদের কথার মধ্যে সম্মোহিত থাকতে ব্যস্ত ছিল। ধর্ম ছাড়া তাদের আর কোনো যুক্তি ছিল না। তারা এ বাস্তবতা ভুলে গিয়েছিল যে বাংলাদেশের মুসলিম জনসংখ্যা তাদের জনসংখ্যার চেয়ে বেশি (ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ ও ভারতের পর পাকিস্তান এখন চতুর্থ বৃহত্তম মুসলিম দেশ)। তাদের কিছু কিছু তুলনা কৌতুকের মতো ও হাস্যকর। তারা আমাদের বিমান ঘাঁটিগুলোর ওপর ইসরায়েলি ধরনের ঝটিকা হামলা চালাবে। সাম্প্রতিক সময়ের যুদ্ধে কোনো বিমানবাহিনী কোনো পটকা ছোড়ে না। যশোর হবে পাকিস্তানের স্ট্যালিনগ্রাদ। অথচ কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই যশোর দখল করা হয়। যুদ্ধের সাত দিনের মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সর্বত্র পলায়নপর ছিল। নৌশক্তির অধিকাংশ এখন বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরের তলদেশে। পাকিস্তানের বিমানবাহিনী পাখনা বেঁধে দেওয়া কবুতরের মতো অসহায়ভাবে ছটফট করছে।

যুদ্ধের সিদ্ধান্ত যেমন একটি বাহিনীর ওপর আরেকটি বাহিনীর শ্রেষ্ঠত্ব যাচাইয়ের পর গ্রহণ করা হয়; একইভাবে তাদের অন্তর্নিহিত দুর্বলতাগুলোও বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়। পাকিস্তানের দুর্বলতা ছিল তার নেতৃত্বে এবং সামরিক কমান্ডারদের অদক্ষতার মধ্যে, যারা তাদের বহু বছরের প্রস্তুতি সত্ত্বেও তাদের কর্তব্য পালনে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছেন (পাকিস্তান তার বাজেটের ৮০ শতাংশ ব্যয় করেছে সামরিক বাহিনীর পেছনে) এবং সর্বোপরি নৈতিক অবস্থানের দিক থেকেও তাদের মাঝে ছিল দীনতা।

এর বিপরীতে ভারত ইন্দিরা গান্ধীকে একজন বিচক্ষণ ও কুশলী প্রধানমন্ত্রী পেয়েছিল। তাঁর সামরিক কমান্ডাররা পেশাগতভাবে পাকিস্তানিদের চেয়ে বহুগুণে সেরা ছিলেন। ভারত স্থলশক্তিতে পাকিস্তানের চেয়ে দ্বিগুণ, বিমানবাহিনীতে তিন গুণ এবং সমুদ্রে চার গুণ বেশি শক্তিশালী। ভারত শক্তিশালী ছিল এবং এখনো আছে। কারণ ভারতের হাত পরিচ্ছন্ন। লাখ লাখ বাঙালির রক্তে পাকিস্তানের হাত কলুষিত হয়ে আছে।

খুশবন্ত সিং (১৯১৫-২০১৪) : খ্যাতিমান ভারতীয় সাংবাদিক রম্য লেখক, কূটনীতিবিদ ও রাজনীতিবিদ।

সর্বশেষ খবর