সোমবার, ১১ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা
স্মরণ

বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদ

ব্যারিস্টার এম তমিজ উদ্দিন

বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদ

ব্রিটিশ শাসনের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি লাভের পর পশ্চিম পাকিস্তানিদের শাসন এবং শোষণের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) যে বৈষম্যপূর্ণ শাসন ব্যবস্থা কায়েম ছিল তার বিপরীতে সেই অস্বাভাবিক সময়েও যে কজন বাংলা ভাষাভাষী মানুষ স্বমহিমায় জ্ঞান ও পান্ডিত্যে নিজেকে উজ্জ্বল করে পাকিস্তান রাষ্ট্রের উচ্চাসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তাদের অন্যতম ছিলেন, অবিভক্ত পাকিস্তানের সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদ।

সময়ের চাকা ঘুরে আবারও এলো সেই ঐতিহাসিক স্মরণীয় ও বরণীয় একটি দিন, যে দিনে এই ভূখন্ডে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলার ইতিহাসের এক শ্রেষ্ঠ সন্তান এবং (১১ ফেব্রুয়ারি ১৯১১-৩ এপ্রিল ১৯৭৯), ইতিহাসে যিনি জায়গা করে নিয়েছেন জীবন্ত কিংবদন্তি হিসেবে। জাতি এই দিন শুধু তাঁর জন্ম উৎসবই পালন করে না, তাঁকে স্মরণ করে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞভরে তাঁর অবদানের কথা স্বীকার করে।

ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সমাপ্তির বছরগুলোতে যখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের উত্তাপ থার্মোমিটারের উচ্চাঙ্গে প্রবাহিত সে সময় তিনি ব্রিটেনের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠান দ্য অনারেবল সোসাইটি অব লিংকন্স ইন থেকে পৃথিবীর এখন পর্যন্ত শ্রেষ্ঠতম ঐতিহ্যের এবং সম্মানজনক উপাধি ব্যারিস্টার এট ল’ লাভ করেন। সেটি ছিল ১৯৩৮ সাল।

বিলেত ফেরত একজন ব্যারিস্টারের কদর সে সময় বাঙালি মুসলমান সমাজে কতটা শিহরণ জাগানো ছিল তার বর্ণনা দেওয়া বাহুল্য মাত্র। ইতিপূর্বে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থশাস্ত্রে বিএ (সম্মান) ও এমএ এবং আইনশাস্ত্রে বিএল ডিগ্রি লাভ করেন।

আইন পেশায় সুখ্যাতি অর্জনের পাশাপাশি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এক কঠিন সময়ে বিচারপতি মোর্শেদ এগিয়ে এসেছিলেন এবং দায়িত্ব নিয়েছিলেন একজন অকুতোভয় বীর সৈনিকের মতো। তাঁর দূরদর্শী চিন্তা, মেধা, পরিশ্রম এবং সোচ্চার ভূমিকার জন্য এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সব শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণ এবং বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী মহলের এক বিরাট সমর্থন লাভ করেছিলেন।

১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে এবং ২১ দফা কর্মসূচি প্রণয়নে বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বলা হয়ে থাকে, ২১ দফা দাবির প্রথম খসড়াটি তিনিই প্রণয়ন করেন। বিচারপতি মোর্শেদ প্রধান বিচারপতি থাকা অবস্থাতেই ১৯৬৬ সালের স্বাধিকার আন্দোলনের ছয় দফার দাবি প্রণয়ন করেন (এটি তিনি করেছিলেন অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে, দু-তিনজনের বাহিরে কেউ জানতেন না, কারণ বিষয়টি জানাজানি হলে সে সময় তিনি তাঁর প্রধান বিচারপতির পদটিই শুধু হারাতেন না তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগও আনা হতো) যা পরবর্তী পর্যায়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। সে সময়ের প্রতিশ্রুতিশীল ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব শেখ মুজিবুর রহমানকে এই স্বাধিকার আন্দোলনের ছয় দফা দাবির জন্য পাকিস্তানের কারাগারে কারাভোগ করতে হয়েছিল।

ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে যখন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা আইয়ুব খান তার সামরিক শাসন পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে ঐতিহাসিক ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ মামলা দায়ের করে সে সময় বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদ ইতিহাস সৃষ্টি করে প্রধান বিচারপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে জনতার কাতারে এসে দাঁড়ান। বিচারপতি মোর্শেদ গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায় বিচার এবং মানুষের অধিকারে বিশ্বাস করতেন ও সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতেন। তিনি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মারফত গণতন্ত্রের মর্যাদা অক্ষুণ রাখার চেষ্টা করেছেন এবং সফলতাও অর্জন করেছেন।

আরেকটি স্মরণীয় ভূমিকা পালন করেন ১৯৭১ সালের মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে। বিচারপতি মোর্শেদ সাংবিধানিক বিধি-বিধানের কারণে তৎকালীন হাই কোর্ট বার এবং আইনজীবীদের সঙ্গে শ্রদ্ধা এবং সম্মানের এমন একটা সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছিল, যার চূড়ান্ত পর্যায়ে কোনো বিচারপতি সরকার মনোনীত জেনারেল টিক্কা খানকে শপথ পাঠ করাতে রাজি হননি বা সাহস করেননি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানান, যা রেকর্ড করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সরকারিভাবে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি দেওয়া হবে এমনটিই প্রত্যাশিত

লেখক : যুক্তরাজ্য প্রবাসী গবেষক।

সর্বশেষ খবর