মঙ্গলবার, ১২ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরা ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কানামাছি

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরা ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কানামাছি

১৬ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী নতজানু হয়ে আমাদের কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে আত্মসমর্পণ করে। আল্লাহর অসীম দয়ায় বাহুবলে সে অনুষ্ঠানে শরিক হয়েছিলাম। একমাত্র বাঙালি হিসেবে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ১৪ ডিভিশন হেড কোয়ার্টারে টাইগার নিয়াজির গুহায় গিয়েছিলাম। দেখেছিলাম নিস্তেজ লেজ গুটানো বাঘকে। আমাদের সামনে যখন দন্ডায়মাণ হয়ে নিয়াজি এক এক করে হাত মেলাচ্ছিল আমি হাত বাড়াতে পারিনি। ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। মিত্রবাহিনীর বিজয়ী সেনাপতি জেনারেল নাগরার বারবার অনুরোধে বলেছিলাম, হত্যাকারী, নারীর সম্ভ্রম হরণকারী এ জল্লাদের সঙ্গে আমি কোনোভাবেই হাত মেলাতে পারব না। দেশের মানুষ আমাকে সে ক্ষমতা দেয়নি। এই ঘাতকের সঙ্গে হাত মেলালে শেষ বিচারে আল্লাহর সামনে দাঁড়াবার আমার পথ থাকবে না। নাগরা বারবার বলেছিলেন, ‘পরাজিত সেনাপতির সঙ্গে হাত মেলানো বিজয়ীর মাহাত্ম্য।’ কিন্তু সেদিন আমি সে মাহাত্ম্য দেখাতে পারিনি বা দেখাইনি। ঘৃণায় আমার সমস্ত দেহমন জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে গিয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিন। কিন্তু ১০ জানুয়ারিকে কোনোভাবেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। আমরা ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ী হলেও অন্তরে কোনো আনন্দ ছিল না, ছিল এক বুকফাটা হাহাকার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ছাড়া স্বাধীনতা ছিল অনেকটাই অর্থহীন। তাই ১০ জানুয়ারি যখন মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজধানী ঢাকার মাটিতে পা রাখেন তখন আমাদের বিজয় ষোলকলা পূর্ণ হয়। আমরা সম্পূর্ণ স্বাধীন মুক্তির আনন্দ অনুভব করি।

গত বছর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের শুরু হয়েছিল জাতির পিতার শততম জন্মদিন হিসেবে। কেউ কেউ বলারও চেষ্টা করেছেন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী। সারা বছর রেডিও-টিভি-পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০২১ সালের ১৭ মার্চ হবে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী, ২০২০ সালের ১৭ মার্চ ছিল শততম জন্মদিন। অনুষ্ঠানের সূচনা হয়েছিল তেজগাঁ বিমানবন্দরে তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আবহাওয়া সৃষ্টির মাধ্যমে। যে রাজকীয় বিমানে বঙ্গবন্ধু লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে ফিরেছিলেন সেই রাজকীয় বিমানের একটা ডেমোনস্ট্রেশন দেওয়া হয়েছিল। আলোক বিচ্ছুরণের মাধ্যমে পিতার বিমান থেকে নামতে দেখানো হয়েছিল। এ নিয়ে কিছু লিখেছিলাম। যদি ভাষ্যকার অমন না বলতেন, বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি ইংল্যান্ড থেকে দিল্লি হয়ে যে বিমানে এসেছিলেন সেই মডেলের বিমান বাংলাদেশ কিনেছে এবং যেভাবে বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন ঠিক সেভাবেই তাঁর আসা জনগণের সামনে জীবন্ত করে তোলার জন্য লাইট অ্যান্ড সাউন্ডের মাধ্যমে ’৭২-এর ১০ জানুয়ারিতে শ্রোতা-দর্শকদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। খুব আগ্রহ নিয়ে বসেছিলাম মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ছোটবোন রেহানা, ভাগ্নে জয় থেকে ৫-৬ চেয়ার পরে এক সারি পেছনে। কিন্তু যখন বিমান উড়ে এলো আমাদের সামনে তখনই মনটা কেমন যেন বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। পেট মোটা ওই ধরনের বিমানে তো বঙ্গবন্ধু সেদিন আসেননি। অথচ ধারাভাষ্যকার বারবার বলছিলেন, ‘যে বিমানে বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন হুবহু সেই মডেলের বিমান ব্রিটেনের কাছ থেকে বাংলাদেশ কিনেছে।’ বড় হোঁচট খেয়েছিলাম। কেন এমন হবে? একটা বিমান দিয়ে মহড়া দেওয়া পিতার আসার ডেমোনস্ট্রেশন দেওয়া আর যে ধরনের বিমানে এসেছিলেন সেই বিমানের জায়গায় অন্য বিমান গুঁজে দেওয়া- এ তো মারাত্মক ইতিহাস বিকৃতি। কেন অমন হয়েছিল প্রশ্ন করলেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। কেন যেন সবাই আছে তাদের মতো করে নতুন নতুন ইতিহাস রচনা করতে। এসব দেখে মাঝেমধ্যে হতাশ যে হই না তা নয়। কারণ যে কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা নিজের মতো করে সাজাতে গেলে ইতিহাসের অঙ্গহানি হয়। সেজন্য ব্রিটেন থেকে ফেরা বিমানের ছবি দিয়েছিলাম। আকাশ-পাতাল পার্থক্য তাতে। যে বিমানের ডেমোনস্ট্রেশন দেওয়া হয়েছিল তা ছিল পেট মোটা এক কার্গো বিমান। যার কাজ মাল বহন। আর বাঙালি জাতিকে সম্মান দেখাতে ব্রিটেনের রানীর ব্যবহৃত বিমান তাঁকে দেওয়া হয়েছিল যা দেখলেই বুক জুড়িয়ে যায়। ঢাকা বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে থাকা ছবি দেখে মনে হচ্ছিল গর্বে যেন বিমানটির চারদিকে দ্যুতি ছড়াচ্ছে, আলোকিত করে তুলছে দিগি¦দিক। তারপর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যে যা পারছিলেন ইচ্ছেমতো করছিলেন। কোনো কোনো অনুষ্ঠানের বলার মতো কিছুটা মান ছিল, কোনো কোনোটার একেবারেই ছিল না। বঙ্গবন্ধুকে জাতির সামনে তুলে ধরা বিশ্বের সামনে তুলে ধরার যে মহান প্রয়াস ছিল উদ্যোগটির মধ্যে তা খুব একটা সফল হয়নি। সারা বছর বঙ্গবন্ধু শতবর্ষ পালনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু যা ছিলেন তাই আছেন। বরং কোনো কোনো জায়গায় তাঁকে ছোট করা হয়েছে। মানুষ ভাবে এক আল্লাহ করেন আরেক। ২৬ মার্চ থেকে করোনার প্রাদুর্ভাবে প্রায় সবকিছু বন্ধ, দায়সারা। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সারা বছর দায়সারা অনুষ্ঠান কার্যকলাপ দেখে আনন্দের বদলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে যারপরনাই মর্মাহত হয়েছি। আমি কিছু কিছু বিষয়ের সঙ্গে কোনোভাবেই আপস করতে পারি না, নিজেকে গুলিয়ে ফেলতে পারি না। এক. পাকিস্তান হানাদারদের পাক বাহিনী বলা। পাকিস্তানকে শর্টকাটে কোনোখানে পাক বলা গেলেও পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে কোনোমতেই নয়। কত পন্ডিত অবলীলায় হানাদার পাক বাহিনী বলে লিখে চলেছেন। হানাদার হানাদারই। হানাদারের চাইতে খারাপ কিছু হতে পারে না। কিন্তু সেই হানাদারকে যখন পাক বলা হয় তখন হৃদয় চৌচির হয়ে যায়। পাকিস্তানি হানাদাররা কী করে পাক হয়- যারা খুন করেছে, নারী ধর্ষণ করেছে, জ্বালাও-পোড়াও করেছে তারা যদি পাক বাহিনী হয় তাহলে দুই দিন পর কি মুক্তিবাহিনী নাপাক বাহিনী হবে? ভেবে কোনো রাস্তা খুঁজে পাই না। কেন এত বছর পরও এত অন্যায়, জোর-জুলুম, এত হত্যা-নির্যাতনের পরেও হানাদাররা আমাদের অনেকের কলমের ডগায় পাক বাহিনী হিসেবে উঠে আসে? কী এর রহস্য? দু-এক জন বিজ্ঞ এও বলেন, পবিত্র অর্থে কেউ পাকিস্তানি হানাদারদের পাক লেখে না। পাকিস্তানকে শর্টকাট করতে পাক বাহিনী লেখে। কী বলব! ছোটখাটো করে পাকিস্তানকে পাক বা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পাক আর আল্লাহ রসুল পাকের মধ্যে সাধারণ মানুষ কীভাবে পার্থক্য খুঁজবে? পাকিস্তানের পাক অপবিত্র আর আল্লাহ রসুল হাদিস কোরআন পাক পবিত্র এসবের পার্থক্য বের করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের কতই না পেরেশানি হবে। সব সময় বলার চেষ্টা করেছি, পাকিস্তানিরা কখনো পাক নয়, হানাদার পাকিস্তান বাহিনী তো নয়ই। তারা সব সময় নাপাক। কবে আমাদের অন্ধের মতো পাক বাহিনী বলার অভ্যাস দূর হবে তা আল্লাহ জানেন। ঘৃণা আর প্রেম একই রকম। একটা ভালো আর একটা মন্দ। যার ঘৃণা নেই তার কোনো প্রেমও নেই। ঘৃণিতকে যে ঘৃণা করতে জানে না বা পারে না তার থেকে অসহায় অপদার্থ আর কে হতে পারে। কিন্তু আমাদের মুখ থেকে হানাদাররা এখনো পাক পবিত্র হয়ে বেরিয়ে আসে। আরেকটা ব্যাপার আমাকে দারুণ পীড়া দেয় তা হলো ৭ মার্চের ভাষণ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ আমাদের জাতীয় সম্পদ, শ্রেষ্ঠ অহংকার। বিশ্বে এ ধরনের দু-তিন-চারটির বেশি ভাষণ নেই। বঙ্গবন্ধু যদি আমেরিকান্ডরাশিয়া-চীন অথবা জার্মানিতে জন্মাতেন তাহলে তাঁর ৭ মার্চের ভাষণ হতো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ। ছোট্ট দেশে জন্মেছিলেন বঞ্চনা আর দারিদ্র্য যে দেশকে অক্টোপাসের মতো চারপাশ থেকে বেঁধে রেখেছিল। সে দেশের একজন নেতার অমন অসাধারণ ভাষণ গুনমানের দিক থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ হলেও অনেকেই তার মূল্য দিতে চায় না। তবু ইউনেস্কো স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ্বের সম্পদ হিসেবে। কিন্তু আমরাই তাকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিচ্ছি না। জাতীয় দিনগুলোয় ব্যর্থ আওয়ামী ভাবাপন্ন লোকজনদের কাজই হলো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ বাজানো। আনুষ্ঠানিকভাবে মর্যাদা দিয়ে ভাষণটি বাজালে তা যথাযথ হতো। কিন্তু কোনোখানে সভা-সমাবেশ ডাকা হয়েছে সেখানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের রেকর্ড, শব্দযন্ত্র পরীক্ষার জন্য ৭ মার্চের রেকর্ড, আওয়ামী লীগের কাঙালি ভোজে লোক জড়ো করার জন্য ৭ মার্চের ভাষণ- এসব আমার চোখে জাতির পিতার ৭ মার্চের ভাষণের গুরুতর অবমাননা। অনেকবার অনেক জায়গায় বলেছি, অনেকেই ব্যাপারটি হৃদয়ঙ্গম করেছেন, প্রতিকারের চেষ্টাও করেছেন। অনেকে আবার বুঝতেও পারেননি। আর ইদানীং আওয়ামীপন্থিদের বিবেক-বিবেচনা ভোঁতা হয়ে গেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী না বললে এখন কারও কানে পানি যায় না। কতবার কতভাবে বলেছি, নেত্রীও এখন পর্যন্ত একবারের জন্য বললেন না, যেখানে সেখানে নয়, ৭ মার্চের ভাষণ যথাযোগ্য মর্যাদায় বাজাতে হবে। কত কিছুর কত আদেশ-নির্দেশ প্রতিদিনই আসে। কিন্তু ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে নেত্রীর কোনো মন্তব্য বক্তব্য আসে না। বুঝতে পারি না দুর্বলতা কোথায়? আশা করব এ বছরই বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত শতবর্ষে তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাষণ নিয়ে এই যে ছেলেখেলা এসব বন্ধের কার্যকর প্রয়াস সরকার নেবে- এমনটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা।

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ। সে যুদ্ধে প্রত্যক্ষ যোদ্ধাদের নিয়ে ইদানীং যে মাদারীর খেলা চলছে তাতে মুক্তিযুদ্ধ মহিমান্বিত না হয়ে কলঙ্কিত হচ্ছে। জামুকা নামে মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই করার যে কমিটি করা হয়েছে তা সত্যিই অপ্রয়োজনীয়। বছরের পর বছর একে বানাচ্ছে ওকে বাদ দিচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ ছেলেখেলা নয় আর মুক্তিযোদ্ধা তো নয়ই। সেই মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে নানা ধরনের রংতামাশা হচ্ছে। স্বাধীনতার পরে জন্ম এমনও কেউ কেউ ‘ও মুক্তিযোদ্ধা না, অমুকে ভুয়া’ এসব বলে কী যে লেজেগোবরে অবস্থা বলার মতো নয়। গত বছর রাজাকারের এক তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। সেখানেও অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার নাম ছিল। আমি ভীষণ মর্মাহত হয়েছিলাম। বগুড়া যুবলীগের সভাপতি আবদুল খালেক খসরুর নামও সেখানে ছিল। সে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধযুদ্ধে প্রথম শহীদ। শুনছি মার্চে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রকাশ করা হবে। আল্লাহ জানেন সেখানে কত রাজাকারের জায়গা হবে। ইদানীং সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই চলছে। যাদের নাম তালিকায় নেই তাদের তালিকাভুক্তিতে চেষ্টা থাকতেই পারে। কারণ স্বাধীনতার পর এ ঘাটের পানি ও ঘাটে, ও ঘাটের পানি এ ঘাটে কত চলাফেরা করেছে তার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর অনেক মুক্তিযোদ্ধা একসময় মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিতে ভয় পেত। বিশেষ করে কাদেরিয়া বাহিনীর হাজার হাজার যোদ্ধা বছরের পর বছর পালিয়ে বেড়িয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্তি হওয়া দূরের কথা, পালিয়ে বেড়িয়েও রক্ষা পায়নি। অনেকেই জেলে গেছে। সে যে কী নির্যাতন ভোগ করেছে তা লেখায় তুলে ধরা যাবে না। এর মধ্যে আবার যারা স্বাধীনতার পর থেকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত, অনেকে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা তাদের নতুন করে যাচাই-বাছাই শুরু হয়েছে। কেউ একবারও ভাবছে না চোর-ডাকাতের মতো তাদের যদি মাঝেমধ্যেই এমন পরীক্ষা দিতে হয়, যাচাই-বাছাই হয় তাহলে তাদের সামাজিক মর্যাদা থাকে কোথায়? জীবনে একবার জামুকার মূল অফিসে গিয়েছিলাম। সে এক মারাত্মক বিড়ম্বনা! মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদারদের সামনাসামনি বাধা দিলে তারা ব্যাপক গোলাবর্ষণ করে। ৩ ইঞ্চি মর্টারের এক গোলায় বাথুলি বাজারে দুজন আহত হয়। একজন হাবিবুর রহমান তালুকদার বীরপ্রতীক, অন্যজন আনছারুল আলম। হাবিবুর রহমান তালুকদার বীরপ্রতীক খেতাব পেয়েছে, যুদ্ধাহত ভাতা পাচ্ছে আর আনছারুল আলম এখন পর্যন্ত তালিকাভুক্তই হতে পারেনি। তাই গিয়েছিলাম মেজর ওয়াকার বীরপ্রতীকের সঙ্গে কথা বলতে। তাদের আলোচনার শেষ নাম ছিল আনছারুল আলম। লেখা ছিল নামঞ্জুর। আমি প্রশ্ন তুলেছিলাম একই গোলায় আহত দুজন- একজন যুদ্ধাহত বীরপ্রতীক, অন্যজন এখনো তালিকাভুক্তও নয় এটা কী ধরনের বিচার? মেজর ওয়াকার কার্যবিবরণী এনে সঙ্গে সঙ্গে কমিটির চেয়ারম্যান মোতাহার হোসেন এমপির সঙ্গে কথা বলে আমায় বলেছিলেন, আমরা এটা গ্রহণ করলাম। কিন্তু দুই মাস পেরিয়ে গেলেও তা এখনো গ্রহণ করা হয়নি। তাই মাঝেমধ্যে মনে হয় এজন্যই কি আমরা স্বাধীনতার পরপর বঙ্গবন্ধুর এক কথায় সমস্ত অস্ত্র তার পায়ের কাছে বিছিয়ে দিয়েছিলাম। তার কাছ থেকে কোনো লিখিত নিইনি- এটাই কি আমার বিশ্বাসের অপরাধ? সেদিন দেখলাম যাচাই-বাছাই তালিকায় হাবিবুর রহমান বীরবিক্রমের নাম। হাবিবুর রহমান বীরবিক্রম লেখা হয়নি। লেখা হয়েছে মরহুম হাবিবুর রহমান, পিতা-মৃত আবুল কাশেম, গ্রাম- সাধুর গলগন্ডা, ঘাটাইল। কমান্ডার হাবিবুর রহমান কাদেরিয়া বাহিনীর এক উল্লেখযোগ্য যোদ্ধা। জাহাজমারা কমান্ডার হিসেবে বিশ্ববিখ্যাত। বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ইংল্যান্ডের হাউস অব কমন্সে মেজর হাবিবের জাহাজমারার ঘটনা তুলে ধরেছিলেন। এমপি পিটার শোসহ অনেকেই দীর্ঘ সময় কমন সভায় আলোচনা করেছিলেন। সেই হাবিবুর রহমান বীরবিক্রমকে প্রমাণ দিতে হবে সে আদৌ মুক্তিযোদ্ধা কিনা! এর চাইতে দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে। যুদ্ধাহতদের, খেতাবপ্রাপ্তদের, গেজেটভুক্তদের যদি আবার যাচাই-বাছাই করতে হয়, ইচ্ছা করলেই মুক্তিযোদ্ধাকে অমুক্তিযোদ্ধা বলা যায় তাহলে এসব লানত নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না। স্বাধীনতার পর কাদেরিয়া বাহিনীর উদ্যোগে পল্টনে বাংলাদেশের প্রথম জনসভা, সেখানেও রবিবারের পূর্বদেশে বেশ বড় করে হাবিবুর রহমান বীরবিক্রমের ছবি ছাপা হয়েছিল। জামুকার বিচারে সে আজ প্রশ্নবিদ্ধ। তাহলে সে কীভাবে বীরবিক্রম হলো? যারা বীরবিক্রম খেতাব দিয়েছিলেন তারা কী কিছুই ভেবে দেখেননি? আজকাল না হয় কাগজ বানানো যায়। এ খেতাবের জন্য ’৭১-এর ডিসেম্বরেই সুপারিশ করা হয়েছিল। সে সময় ইচ্ছা স্বাধীন কিছু বানানোর পথ ছিল না। হাবিব তো মারা গেছে ১০-১২ বছর। সে মারা গেছে বলেই তার নামের আগে মরহুম লেখা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু তারও দুই-আড়াই যুগ আগে সে বীরবিক্রম খেতাব পেয়েছে, চিঠিতে তা উল্লেখ করা হয়নি। এসব অনিয়মের বিচার কোথায়? যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আবদুল বাছেত, কোনো দিন তাকে নিয়ে কোনো কথা ছিল না। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা শুরু হওয়ার সময় থেকে সে ভাতা পেয়ে এসেছে। প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারি করেছে। অবসরে গিয়ে এখন সে মুক্তিযোদ্ধাই না! একবার গেজেট করা আবার তা বাতিল করা এ তো আইয়ুব খানের শাসনের সময়ের মতো। আইয়ুব-মোনয়েমের সময় ছাত্রনেতা শেখ ফজলুল হক মণির দুবার এম এ ডিগ্রি বাতিল করা হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তেমনটাই শুরু হয়েছে। এ অশুভ তৎপরতা থেকে এখনই সরে আসতে জামুকাকে বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি। না হলে গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের এ যাচাই-বাছাইয়ের নামে দেশে আগুন জ্বলবে, সরকারের জন্যও বুমেরাং হবে। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

লেখক : রাজনীতিক।

www.ksjleague.com

সর্বশেষ খবর