শিরোনাম
বুধবার, ১৩ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

সম্পর্ক উন্নয়নের প্রস্তাবের ছলে এটা কি নতুন ষড়যন্ত্র

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

সম্পর্ক উন্নয়নের প্রস্তাবের ছলে এটা কি নতুন ষড়যন্ত্র

গত ৭ জানুয়ারি আমাদের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জনাব শাহরিয়ার আলম এমপি পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে কোনো রাখঢাক না রেখেই স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা ঘটানোর অপরাধে পাকিস্তানকে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে হবে। তিনি আরও বলেছেন, বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানিদের ফেরত নিতে হবে এবং আমাদের সম্পদের অংশ ফেরত দিতে হবে।

পাকিস্তানের কাছে ক্ষমা চাওয়ার দাবি, পাকিস্তানিদের ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি এবং আমাদের পাওনা সম্পদের হিসসা ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি প্রথম উচ্চারণ করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৭৪ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশ সফরে আসা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে দেওয়া নৈশভোজ সভায়। জবাবে বেহায়া ভুট্টো বলেছিলেন, তিনি ব্ল্যাঙ্ক চেক নিয়ে আসেননি। ক্ষমা চাওয়ার দাবি ছিল ন্যূনতম, কিন্তু গণহত্যার নায়ক ভুট্টো এ ব্যাপারে মুখই খোলেননি। তিনি সম্ভবত তখনই স্থির করেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে হবে। তিনি পাকিস্তান ফিরে গেলে তার এক সফরসঙ্গী সাংবাদিক বলেছিলেন, বাংলাদেশে শিগগিরই সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারে। আর এক নামিদামি সাংবাদিক জেড এ শেলেরি লিখেছিলেন, যত দিন শেখ মুজিব বেঁচে থাকবেন তত দিন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে না। এর পরের ঘটনাপ্রবাহ সবারই জানা। বঙ্গবন্ধু হত্যায় যে পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ হাত ছিল তাও কারও অজানা নয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় বসে বাংলাদেশকে রূপান্তরিত করার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। পাকিস্তানের কাছে মাফ চাওয়ার দাবি তোলা, সম্পদের হিসসা চাওয়া, পাকিস্তানিদের ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি তো দূরের কথা জিয়া ব্যস্ত হয়ে গেলেন মনোতুষ্টির ভূমিকায়। দেশ ভরে ফেললেন পাকিস্তানি গোয়েন্দা বাহিনী আইএসআই লোকদের দিয়ে। শাহ আজিজ, কর্নেল মোস্তাফিজ, আবদুল আলিম, সোলেমান, বিচারপতি সাত্তার, যাদু মিয়াসহ বহু কুখ্যাত রাজাকার যুদ্ধাপরাধীকে বসালেন মন্ত্রিত্বের কেদারায়, বহু যুদ্ধাপরাধীকে পদায়িত করলেন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পদে, কট্টর যুদ্ধাপরাধী শর্ষিনার পীরকে প্রদান করলেন স্বাধীনতা পদক, জয় বাংলা স্লোগান তুলে দিলেন, পাকিস্তানি সৈন্যদের পরাজয়ের গ্লানি এবং বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বিশ্বনন্দিত ভাষণ মুছে ফেলার জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নাম ও বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে সেখানে তৈরি করলেন শিশু পার্ক, চূর্ণ করে দিলেন ইন্দিরা মঞ্চ। তার উত্তরাধিকারী খালেদা জিয়াও তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে পাকিস্তানিকরণ প্রক্রিয়া চালিয়ে যান বলে তিনিও তার পাকিস্তানি প্রভুদের কাছে দাবিগুলো তোলার কথা ভাবতেই পারেননি। এভাবে ’৭৫-এর পর পাকিস্তানি প্রেতাত্মাদের অধীনে কেটে গেল ২৫টি বছর। পাকিস্তানকে কেউ বিরক্ত করল না বরং তুষ্ট করার কাজ চলতে লাগল। অবশেষে ২০০৮-এ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া সরকার ক্ষমতায় এলে পাকিস্তানি আধিপত্যই শুধু ভেঙে দেওয়া হয়নি, বরং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ইমরান খানের নেতৃত্বে পাকিস্তান পার্লামেন্টে যুদ্ধাপরাধ বিচারের বিরুদ্ধে প্রস্তাব গ্রহণ করে প্রমাণ করেন তারা ’৭১-এ পরাজয়ের গ্লানি মেনে নিতে পারছেন না। ২০০৮ সালে পাকিস্তানি হাইকমিশনার এক বীর মুক্তিযোদ্ধার নামসংবলিত তাদের হাইকমিশনের রাস্তার নাম পরিবর্তন দাবি করে অমার্জনীয় ধৃষ্টতা দেখান যা ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশনের খেলাপ। ২০০০ সালে আওয়ামী লীগের শাসনকালে পাকিস্তানি উপ-হাইকমিশনার ইরফান রাজা চরম ধৃষ্টতা এবং কূটনৈতিক বিধিবিধান লঙ্ঘন করে আমাদের মুক্তিসংগ্রামকে কটাক্ষ করে প্রমাণ করেছেন মাফ চাওয়া, সম্পদের অংশ ফেরত দেওয়া তো দূরের কথা তারা আমাদের স্বাধীনতাকেই মানতে পারছেন না। সেই উপ-হাইকমিশনারকে পরে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে বাংলার পবিত্র মাটি থেকে উচ্ছেদ করা হয়।

ঢাকার পাকিস্তানি হাইকমিশন নবাব সিরাজউদ্দৌলার আমলের কাশিমবাজার কুঠির মতো সারাক্ষণ ষড়যন্ত্রের মানমন্দির। ২০১৫ সালে এক বাঙালি জঙ্গি আদালতে স্বীকার করে, পাকিস্তান হাইকমিশনের ফারিনা আরশাদ নামক এক কূটনীতিক জঙ্গি তৎপরতা চালানোর জন্য তাকে প্রচুর টাকা দিয়েছে। সেই ফারিনা আরশাদকেও বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত করা হয় ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে। ২০১৬ সালে মাজহার খান নামক আরেক পাকিস্তানি কূটনীতিককে বনানী পুলিশের একটি দল গ্রেফতার করে বাংলাদেশের জঙ্গিদের অর্থ প্রদানের প্রমাণসহ বনানী থানায় কয়েক ঘণ্টা আটক রাখার পর পাকিস্তান হাইকমিশন কূটনৈতিক দায়মুক্তির দাবি তুলে তাকে ছাড়িয়ে নেয়। তারপর সেই মাজহার খানকেও বাংলাদেশ থেকে উৎখাত করা হয়।

২০০৪ সালের গ্রেনেড আক্রমণ করে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করার পরিকল্পনায় যে পাকিস্তানের সিদ্ধান্তকারী ভূমিকা ছিল তার প্রথম প্রমাণ অবিস্ফোরিত গ্রেনেডগুলোর গায়ে পাকিস্তান অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির ছাপ এবং দ্বিতীয় প্রমাণ সেই আক্রমণে দুজন পাকিস্তানি নাগরিকের অংশগ্রহণ যাদের দুজনকেই আমাদের বিচারিক আদালত ফাঁসির দন্ডে দন্ডিত করেছে। এদের একজন পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়ব এবং অন্যজন জইশ-ই-মুহাম্মদের সদস্য। ২০০০ সালে ঢাকার পাকিস্তানি হাইকমিশন যে বিএনপি-জামায়াতকে নির্বাচনে জয়ের জন্য প্রচুর টাকা দিয়েছিল সে কথা সে সময়ের আইএসআইয়ের প্রধান কর্মকর্তা, এক জেনারেল পাকিস্তানি আদালতে প্রকাশ্যেই স্বীকার করেছে। তাদের ষড়যন্ত্র এখনো চলমান।

২০১৩ সালে র‌্যাব যেসব জঙ্গিকে উত্তরা থেকে গ্রেফতার করে তার মধ্যে ছিল এক পাকিস্তানি, যে ছদ্মবেশে পিআইএর একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রাফিক কর্মকর্তার পরিচয়ে ঢাকায় থাকলেও আসলে সে ছিল পাকিস্তান গোয়েন্দা বাহিনী আইএসআইয়ের কর্মকর্তা, যাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার।

এর আগে ৩ ডিসেম্বর জননেত্রী শেখ হাসিনা একই হাইকমিশনারকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক বলে দিয়েছিলেন ১৯৭১-এ পাকিস্তান বাংলাদেশে যে গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল তা ক্ষমার অযোগ্য, পাকিস্তানকে কখনো ক্ষমা করা যাবে না, এ ক্ষত চিরদিন থাকবে, এটা ভোলা যাবে না। আইনের একটি তত্ত্বকে বলে তামাদি আইন, যার অর্থ দেওয়ানি মামলা নির্ধারিত সময়ে না করলে সেটি তামাদি আইনে বাতিল হয়ে যায়। জননেত্রী শেখ হাসিনা পাকিস্তানি দূতকে বলেছিলেন পাকিস্তানকে ক্ষমা করা যাবে না। তা থেকে আন্দাজ করা যায় যে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ এখন তামাদিতে বাতিল হয়ে গেছে এবং তাই হওয়ার কথা, কেননা ৫০ বছরেও তারা ক্ষমা চাওয়ার কথা না ভেবে বরং আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালিয়ে গেছে, ’৭১-এর পরাজিত অপশক্তিকে অর্থ দিয়ে এবং অন্যান্যভাবে লালনপালন করছে, এখনো ভাবছে বাংলাদেশকে আবার কীভাবে পাকিস্তানের ছাতার নিচে আনা যায়, কীভাবে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দলকে ক্ষমতাচ্যুত করা যায়, কীভাবে যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থনে পার্লামেন্টে প্রস্তাব পাস করা যায়। সেদিন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ক্ষমা চাওয়া, সম্পদ ফিরিয়ে দেওয়া, পাকিস্তানিদের ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলার পরও কিন্তু পাকিস্তানি হাইকমিশনার এ প্রসঙ্গে নীরবতা অবলম্বন করে ছিলেন। শুধু তাই নয়, এরপর আলজাজিরা টেলিভিশনে বক্তব্য দেওয়ার সময়ও ক্ষমার ব্যাপারে কিছু বলেননি। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষও এখন পর্যন্ত ক্ষমার ব্যাপারে মুখ খোলেনি। আলজাজিরায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানি দূত ক্ষমা প্রসঙ্গ উল্লেখ না করে এক অর্থে মিথ্যাচারেরই আশ্রয় নিয়েছেন ভ্রান্ত তথ্য দেওয়ার মানসে যা নিন্দনীয়। পাকিস্তানের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশে পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা ক্ষমতায় আসবে বলে তাদের স্বপ্ন কখনো পূরণ হবে না। আলজাজিরায় হাইকমিশনার বলেছেন, ঝগড়া-বিবাদ ভুলে সম্পর্ক উন্নত করা উচিত। কিন্তু ঝগড়া-বিবাদ ভোলার প্রথম এবং অপরিহার্য পদক্ষেপ হতে পারত ’৭১-এ গণহত্যা, গণধর্ষণসহ পাকিস্তান বাংলাদেশে যেসব নিকৃষ্ট ধরনের নির্যাতন করেছে তার জন্য শর্তহীন ক্ষমা প্রার্থনা, আন্তর্জাতিক আইন মোতাবেক আমাদের পাওনা অর্থ ফেরত দেওয়া, বাংলাদেশে থেকে যাওয়া পাকিস্তানিদের ফিরিয়ে নেওয়া এবং ’৭১-এ গণহত্যাকারী যেসব সৈন্য বেঁচে আছে তাদের বিচার করা। শুধু তাই নয়, ঢাকাস্থ পাকিস্তান হাইকমিশনে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সরকারের পতন ঘটানোর জন্য এবং প্রতিবেশী দেশে অশান্তি সৃষ্টির জন্য যেসব ষড়যন্ত্র প্রমাণিতভাবে অতীতে করা হয়েছে, তা শতভাগ বন্ধ করার নিন্ডিদ্র নিশ্চয়তা দেওয়া।

হাইকমিশনার আলজাজিরাকে বলেছেন, পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য বাংলাদেশে ভিসা সহজ করা উচিত। এর মধ্যেও ষড়যন্ত্রের গন্ধ রয়েছে। এটা করলে বহু পাকিস্তানি জঙ্গি আমাদের দেশে এসে ষড়যন্ত্র এবং জঙ্গি কার্যকলাপ করার সুযোগ পাবে যা অতীতে করার নজির রয়েছে। আমরা ভুলে যেতে পারি না, ২১ আগস্ট গ্রেনেড আক্রমণের ঘটনায় দুজন পাকিস্তানি জঙ্গি সম্পৃক্ত ছিল, আদালত যাদের ফাঁসির দন্ডে দন্ডিত করেছে।

জননেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পাকিস্তান ১৯৭১-এ যে গণহত্যা, গণধর্ষণ, ধ্বংসযজ্ঞসহ অমানবিক অপরাধসমূহ করেছে তা ক্ষমার অযোগ্য, এজন্য পাকিস্তানকে কখনো ক্ষমা করা যাবে না, এগুলো কখনো ভোলা যাবে না, এ ক্ষত চিরস্থায়ী।

নিশ্চিতভাবে প্রধানমন্ত্রীর কথা এবং সিদ্ধান্ত শুধু শিরোধার্যই নয়, অক্ষরে অক্ষরে যৌক্তিকও বটে, নেত্রীর কথার পেছনে জনসমর্থন নিরঙ্কুশ। এমন অপরাধ আছে যা ক্ষমার অযোগ্য। পাকিস্তানিরা এবং এ দেশে তাদের দোসররা যা করেছে তা যে ক্ষমার অযোগ্য সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

গত ১০ জানুয়ারি এক টেলিভিশন টকশোয় দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এক প্রথিতযশা বিশেষজ্ঞ এবং গবেষক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন অর রশিদ যা বললেন, তা জননেত্রীর কথারই প্রতিফলন। তিনি বলেছেন, ক্ষমার কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। ক্ষমা চাইলেই ক্ষমা করতে হবে এমনটি নয়, বলে অধ্যাপক হারুন বলেছেন, ৩০ লাখ লোককে পাকিস্তানিরা এবং তাদের দেশি অনুচররা হত্যা করেছে তাদের বংশধররা, যে ৫ লাখ নারীকে নির্যাতন করেছে, তারা নিশ্চয়ই পাকিস্তানকে ক্ষমা করবে না। তিনি আরও বলেছেন, পাকিস্তান একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র যে দেউলিয়া হওয়ার পথে। সুতরাং সে দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক রাখারই তো কোনো প্রয়োজন নেই, সম্পর্ক উন্নয়ন দূরের কথা। তিনি আরও বলেছেন, ঢাকাস্থ পাকিস্তান হাইকমিশন নামক কাশিমবাজার কুঠিতে প্রতিনিয়ত ষড়যন্ত্র হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকারের বিরুদ্ধে। মানুষের বিরুদ্ধে বিধায় এ হাইকমিশন বন্ধ করে দেওয়াই আমাদের স্বার্থের জন্য মঙ্গলকর। অধ্যাপক হারুন অর রশিদের কথাগুলো শুধু জননেত্রীর কথার প্রতিফলনই নয়, বরং যুক্তির দাঁড়িপাল্লায় সর্বোচ্চ ওজনের প্রদর্শক। আজ যদি ৩০ লাখ শহীদের বংশধরদের জিজ্ঞাসা করা হয়, যদি ৫ লাখ ধর্ষণের শিকার নারীকে জিজ্ঞাসা করা হয়, তাদের খুব কমসংখ্যকই ক্ষমা করার পক্ষে বলবে। আমরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন টকশোয় শহীদ ডা. আলিম চৌধুরীর স্ত্রী শ্যামলি নাসরিন চৌধুরীর কথা শুনি, তাঁদের কন্যা ডা. নুজহাত সম্পার কথা শুনি, শহীদ মুনির চৌধুরীর পুত্র আসিফ মুনির তন্ময়ের কথা শুনি, শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেনের ছেলে তৌহিদ রেজা নূর এবং গণহত্যার শিকার অন্যদের উত্তরসূরির কথা শুনি, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর কথা শুনেছি। তাঁদের কথা থেকে পরিষ্কার বলতে পারি, তাঁরা পাকিস্তানি পিশাচদের ক্ষমা করবেন না। যুক্তরাষ্ট্র আণবিক বোমার আঘাতে জাপানে ২ লক্ষাধিক নিরীহ মানুষ হত্যার পর ক্ষমা চেয়েছে, কিন্তু জাপানের মানুষ যে ক্ষমার আবেদন গ্রহণ করেনি সেটার ব্যাপারে বিতর্ক নেই। পাকিস্তান দেউলিয়া হওয়ার পথে বলে উপাচার্য মহোদয় যা বলেছেন, তার পক্ষে সবচেয়ে বড় প্রমাণ পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু চীন কর্তৃক সম্প্রতি পাকিস্তানকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া ধার প্রদানে অস্বীকৃতি। চীন বলেছে, পাকিস্তানি অর্থনীতি যেহেতু নাজুক অবস্থায় সেহেতু তাদের টাকা ধার দেওয়া যাবে না যদি পাকিস্তান কোনো জোরালো গ্যারান্টি না দেয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একান্ত শান্তিবাদী একজন মানুষ, যার জন্য তিনি মহাকাব্য লিখতে পারেননি। তিনি ক্ষমা করাকে মহত্তের নিদর্শন বললেও ক্ষমার অযোগ্য ঘটনায় ক্ষমার বিরুদ্ধেই মত দিয়েছেন এই বলে ‘ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা হে রুদ্র, নিষ্ঠুর যেন হতে পারি তথা তোমার আদেশে।’ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষায়, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায়, পাকিস্তানিকরণ প্রক্রিয়া ঠেকাতে কবিগুরুর কথা মনের গভীরে গেঁথে রাখার বিকল্প নেই। তা ছাড়া পাকিস্তান ক্ষমা চাইবে এমন ধারণা করাও দিবাস্বপ্নের মতো। যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিবাদে তাদের সংসদে নিন্দা প্রস্তাব তোলে তারা নিশ্চয়ই ক্ষমা চাওয়ার কথা ভাবছে না। তার চেয়েও বড় কথা তারা বাংলাদেশে নির্যাতন চালানোর জন্য অনুতপ্ত নয়। বরং এখনো ভাবছে তারা ঠিক করেছে। বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য ভারত প্রচেষ্টা শুরু করেছে। পাকিস্তানের কথা যদি সত্যি সত্যিই ছলনাহীন হয় তবে বাংলাদেশে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য যে প্রক্রিয়া চলছে তা সফল করার জন্য দৃশ্যমান ভূমিকা রেখে পাকিস্তানকে সর্বপ্রথম প্রমাণ করতে হবে তারা তাদের অপরাধ স্বীকার করছে, অনুশোচনা করছে তাই এখন প্রায়শ্চিত্ত করতে চায়।

 

                লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।

সর্বশেষ খবর