বুধবার, ১৩ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

ভাসানচরই এখন রোহিঙ্গাদের কাছে শান্তির চর

শাহীন রেজা নূর

ভাসানচরই এখন রোহিঙ্গাদের কাছে শান্তির চর

আমার বিশিষ্ট এক সাবেক বিদেশি কূটনীতিক বন্ধু সম্প্রতি ভাসানচর আশ্রয় কেন্দ্র ঘুরে এসে তার যে বিস্তারিত বিবরণ আমার কাছে মেলে ধরেন তাতে আমি তার জবানিতে একটি নিবন্ধ রচনার কথা দিয়েছি তাকে আর সে মোতাবেক নিম্নোক্ত এ লেখাটি প্রস্তুত করেছি :

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কাছে বদলে গেছে নোয়াখালীর ভাসানচরের নাম। তাঁরা এখন বলছেন, ‘এ তো আমাদের কাছে শান্তির চর!’ কক্সবাজারের অস্থায়ী আশ্রয়স্থলের তুলনায় ভাসানচর অনেক বেশি খোলামেলা। পরিকাঠামোও অনেক শক্তপোক্ত। অন্যদের কাছে ভাসানচরের গুণগান শুনে অন্য রোহিঙ্গারাও এখন স্বেচ্ছায় আসতে চাইছেন এ চরে। আর মুক্তকণ্ঠে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে। ভাসানচরে ঢুকতেই চোখে পড়বে বিশাল এক ফ্লেক্স। ফ্লেক্সের মূলবার্তা ‘আশ্রয়ণের অধিকার/শেখ হাসিনার উপহার।’ দেশবাসীর মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করতে তাঁর চেষ্টার ত্রুটি নেই। একগুচ্ছ প্রকল্প হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশে আশ্রিত মিয়ানমারের লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্য সাময়িক বাসস্থানের ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা দেশনেত্রী শেখ হাসিনা। তাই ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা খরচ করে ভাসানচরে গড়ে উঠেছে লাখো মানুষের আবাসস্থল। ইতিমধ্যে ৩ হাজার ৭৫২ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী সেখানে বসবাস করছেন। তাঁরা উচ্ছ্বসিত। আর তাঁদের কাছ থেকে ভাসানচরের প্রশংসা শুনে অন্যরাও এখনই স্বেচ্ছায় যেতে চাইছেন তাঁদের শান্তির চরে।

১০ বছরের সইফুলের আনন্দের আর সীমা নেই। ২৯ ডিসেম্বর সে এসে পৌঁছেছে স্বপ্নের জগতে। কক্সবাজারের কাছে তাদের আগের শিবিরের সঙ্গে ভাসানচরের কোনো তুলনাই করতে চায় না সে। নিজেই বলছে, ‘দারুণ জায়গা এটা। ওখানে তো নড়চড়া করারই সুযোগ পেতাম না! এখানে দিব্যি খেলছি, ঘুরছি। সমান মাটি। প্রচুর জায়গা। দারুণ লাগছে।’ অভিভূত।

২. তার কিশোর মন। সইফুলের মতোই মধ্যবয়সী মরিয়ম খাতুনও উচ্ছ্বসিত। তিনি বললেন, ‘এটা আমাদের কাছে শান্তির চর। অন্যদের কাছে আগেই শুনেছিলাম। এখানে এসে দেখছি আরও ভালো ব্যবস্থা রয়েছে আমাদের থাকার।’ দুই মেয়ের বাবা আবুল কালাম আত্মীয়দের কাছে ভাসানচরের প্রশংসা শুনে নিজেই আসতে চান এ চরে। এখন এসে খুব খুশি তিনি। সফি আলমের মতে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা অনেকেই এখন আসতে চাইছেন ভাসানচরে। প্রথম দিকে তাদের মনে আশঙ্কা ছিল। বিভ্রান্তি ছড়ানোরও চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু এখন নিজেরাই বুঝতে পারছেন কত ভালো বন্দোবস্ত হয়েছে তাঁদের জন্য।

২৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ নৌবাহিনীর পাঁচটি নৌযানে দ্বিতীয় দফায় ১ হাজার ৮০৪ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে নিয়ে আসা হয় ভাসানচরে। এর আগে তাদের সবাইকে কক্সবাজার থেকে বাসে আনা হয় চট্টগ্রাম। সেখানে থাকান্ডখাওয়ার সুবন্দোবস্ত ছিল। চট্টগ্রাম বোট ক্লাব বন্দর থেকে তাদের নিয়ে আসা হয় ভাসানচরে। প্রথমে বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তারা ভেবেছিলেন দ্বিতীয় দফায় ৫০০ থেকে ৭০০ শরণার্থী আসতে পারে। কিন্তু তাঁদের ধারণা ভুল প্রমাণ করে ১ হাজার ৭৭২ জন স্বেচ্ছায় ভাসানচরে আসার জন্য নাম লেখান। পরে সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৮০৪। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর কমডোর এ এ মামুন চৌধুরী এ কর্মসূচির পরিচালক। রোহিঙ্গা পুনর্বাসন কর্মসূচিটির পোশাকি নাম আশ্রয়ণ ৩ প্রজেক্ট। মামুন জানান, ভাসানচরে প্রথম ব্যাচের বাসিন্দারাই সরকারের কাজ সহজ করে দেন। তারাই হয়ে ওঠেন ভাসানচরের দূত। আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশীদের কাছে পৌঁছে যায় ভাসানচরের পরিকাঠামোগত সুবিধার কথা। আর এতেই কাজ হয়। রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় আসতে চান ভাসানচরে। আর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন স্মরণ করিয়ে দেন, এ ব্যবস্থাও সাময়িক। কারণ শরণার্থী শব্দটিই সাময়িক।

৩. ভাসানচর নিয়ে কোনো কোনো দেশ বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। গণমাধ্যমের এ বিষয়ে আরও বেশি সতর্ক ও সত্যনিষ্ঠ হওয়া জরুরি। ২০১৭ সাল থেকেই বাংলাদেশ মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গাদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী ২০১৭ সালে মাত্র ১১ দিনে ১ লাখ ২৩ হাজার ৬০০ রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন।

মোট শরণার্থী ৫ লাখের বেশি। কিছু কিছু দেশ অপপ্রচার চালালেও ভারতসহ একাধিক দেশ বাংলাদেশের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তিন বছরের বেশি অতিক্রান্ত হলেও মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধানে এখানে কোনো ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। ফলে শরণার্থী সমস্যা এখনো মেটেনি। শরণার্থীদের কক্সবাজারের পাহাড়ি এলাকায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থেকে ভাসানচরের খোলামেলা পরিবেশে বসবাসের সুবিধা করে দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।

নোয়াখালীর এ চরে গড়ে তোলা হয়েছে লক্ষাধিক মানুষের বসবাসের উপযুক্ত পরিকাঠামো। রয়েছে চিকিৎসা পরিকাঠামো। নিরাপত্তাব্যবস্থাও আধুনিক। পরিকাঠামোর দিক থেকে অতি উন্নত ব্যবস্থা। এখানে শরণার্থীরা নিজেদের জীবন ও জীবিকার প্রায় সব রকম সুবিধা পেতে পারেন। এ চরে বিভিন্ন সময়ে ৩০৬ জন রোহিঙ্গা আগেই আশ্রয় নিয়েছিল। এর আগে ৪ ডিসেম্বর প্রথম দফায় ১ হাজার ৬৪২ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে বাংলাদেশ সরকার ভাসানচরে পুনর্বাসন দেয়। দ্বিতীয় দফায় ১ হাজার ৮০৪ শরণার্থী ২৯ ডিসেম্বর সেখানে পৌঁছে। এর মধ্যে ৮৪৮ জনই শিশু। শিশুরা মহাখুশি ভাসানচরে হেসে-খেলে বেড়ানোর সুযোগ পেয়ে। তাদের পড়াশোনারও বন্দোবস্ত রয়েছে। শিশুরাও বেড়ে উঠবে মহানন্দে। খুশি তাই বড়রাও।

 

                লেখক : কবি ও সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর