শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৪ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

ইসলামের আলোকে করোনার ভ্যাকসিন

মাওলানা শাইখ মুহাম্মাদ জামালুদ্দিন

ইসলামের আলোকে করোনার ভ্যাকসিন

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম -সূত্রে জানা গেছে, করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনে শূকরের চর্বির উপাদান ব্যবহারের কারণে ইউরোপ-আমেরিকার মুসলমানরা এ ভ্যাকসিন নিতে অনীহা প্রকাশ করছেন। করোনার ভ্যাকসিন হালাল না হারাম এ সম্পর্কে কোরআন-সুন্নাহ কী বলে আসুন জেনে নিই। কোনো কোনো ভ্যাকসিন কোম্পানি শূকরের চর্বি ব্যবহারের বিষয়টি অস্বীকার করেছে। সত্যিই যদি করোনার ভ্যাকসিন অথবা অন্য কোনো ওষুধে শূকরের চর্বি ব্যবহার হয়ে থাকে তাহলে এ ব্যাপারে আমাদের দুটো মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে। প্রথমত, বিকল্প কোনো ওষুধ পাওয়া না গেলে জীবন বাঁচানোর জন্য হারাম উপাদানে তৈরি ওষুধও ব্যবহার করা সম্পূর্ণ জায়েজ। এ ব্যাপারে সুরা বাকারার ১৭৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘একান্ত নিরুপায় অবস্থায় গুনাহ করার ইচ্ছা ছাড়া শুধু জীবন বাঁচানোর জন্য হারাম খাদ্য খেলে কোনো অপরাধ নেই।’ সুরা মায়েদার ৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘গুনাহ করার ইচ্ছা ছাড়াই কেউ যদি জীবন বাঁচানোর জন্য বাধ্য হয়ে হারাম খায় তার জেনে রাখা উচিত আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’

এ দুটো আয়াত প্রমাণ করে জীবন বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনমত হারাম খেলে কোনো গুনাহ হবে না। করোনার ভ্যাকসিন তো আমরা খাচ্ছি না, শরীরে পুশ করছি মাত্র। জীবন বাঁচানোর জন্য হারাম খাওয়া যদি জায়েজ হয় তাহলে শূকরের চর্বি ব্যবহৃত ভ্যাকসিন ব্যবহার করা কেন জায়েজ হবে না! হজরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ ও জুবায়ের ইবনে আওয়াম (রা.) চর্মরোগে আক্রান্ত হলে রসুল (সা.) তাদের রেশমি পোশাক পরার অনুমতি দিয়েছিলেন। এ থেকে বোঝা যায় রোগের কারণে হারাম বস্তু ব্যবহার করা জায়েজ। (ড. ইউসুফ আল কারজাভি, আল হালাল ওয়াল হারাম ফিল ইসলাম, ৭৬ পৃষ্ঠা।)

এবার দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গিটি নিয়ে আলোচনা করা যাক। সুরা আনয়ামের ১১৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমাদের জন্য যা যা হারাম করা হয়েছে আল্লাহ তা সুস্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন।’ এ সুরারই ১৪৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘ইহুদিদের জন্য গরু ও ছাগলের চর্বি হারাম করেছি। তবে পিঠ, পেট ও হাড়ের সঙ্গে লেগে থাকা চর্বি হালাল ছিল।’ তার মানে একটি প্রাণীর কী এবং কতটুকু অংশ হালাল বা হারাম তা আল্লাহর কিতাবে স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়। সুরা মায়েদার ৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত পশু, রক্ত ও শূকরের মাংস।’ লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, আয়াতে ‘লাহমুল খিনজির’ বলা হয়েছে। লাহমুন অর্থ গোশত। করোনার টিকায় শূকরের গোশত ব্যবহার করা হচ্ছে না। ব্যবহার করা হচ্ছে চর্বি। চর্বির আরবি হলো শাহমু। তার মানে শূকরের মাংস হারাম, চর্বি সরাসরি কোরআনের আয়াতের আলোকে হারাম নয়। আয়াতে ‘শূকরের মাংস’ শব্দটা খাস। শুধু মাংসই হারাম। চর্বি বা শূকরের অন্যান্য বিষয় যদি হারাম হতো তাহলে আল্লাহ বলতেন, তোমাদের জন্য শূকর হারাম করা হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ স্পষ্ট করে ‘শূকরের মাংস’ বলে দিয়েছেন।

তার মানে কি আমরা বলতে চাচ্ছি শূকরের চর্বি হালাল? না, আমরা মোটেও সে কথা বলছি না। আমরা তাই বলছি যা মিসর ও মালয়েশিয়ার একদল আধুনিক আলেম বলেছেন। তাদের ফতোয়া হলো, ওষুধে ব্যবহৃত শূকরের চর্বি হারাম নয়। প্রক্রিয়াজাত করায় চর্বি বা জেলাটিন থেকে শূকরের বৈশিষ্ট্য ও নাজাসাত দূর হয়ে যাওয়ার কারণে তা হালাল হয়ে যায়। সৈয়দ আমির আলী ‘দ্য স্পিরিট অব ইসলাম’ গ্রন্থে স্পষ্ট বলেছেন, শূকরের কোনো অংশ থেকে প্রক্রিয়াজাত করে নাজাসাত তথা অপবিত্রতা দূর করতে পারলে তা ব্যবহার করা জায়েজ হবে। হালাল প্রাণীর যেমন সবকিছুই হালাল নয় তেমনি হারাম প্রাণীরও সবকিছু হারাম নয়। গরুর প্রস্রাব-পায়খানা হারাম, কিন্তু গরুর গোবর যদি শুকিয়ে যায় তাহলে তা পবিত্র হয়ে যায়। ‘একবার একটি মৃত ছাগল দেখে রসুল (সা.) বলেছেন, তোমরা এর চামড়া শোধন করে ব্যবহার কর। সাহাবিরা বললেন, ওটা তো মরে গেছে। তিনি বললেন, মরা ছাগল খাওয়া হারাম, কিন্তু দাবাগাত-প্রক্রিয়াজাত করে ব্যবহার করা তো হারাম নয়।’ বুখারি,  মুসলিম। বুখারির অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘উম্মুল মোমিনিন সওদা (রা.) বলেন, ‘একটি ছাগল মরে গেলে আমরা তার চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে মশক বানিয়ে ব্যবহার করি এবং তাতে খেজুরের শরবত পান করি।’

তাহলে ‘আল্লাহ যা হারাম করেছেন, তাতে শেফা নেই’- এ হাদিসের ব্যাখ্যা কী? বুলুগুল মারামের কিতাবুল হুদুদে এ হাদিসটি এসেছে। উম্মে সালামা (রা.) নবী (সা.) থেকে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। মুহাদ্দিসদের গবেষণায় হাদিসটি সহি। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ যা হারাম করেছেন তাতে রোগমুক্তি নেই।’ এ হাদিসের অনেক ব্যাখ্যা রয়েছে। মনে রাখতে হবে, শূকরের চর্বি সরাসরি ব্যবহার করা হালাল সে কথা আমরা বলছি না। আমরা বলছি, প্রক্রিয়াজাত করে তা ব্যবহার করা জায়েজ। অবশ্য বিশেষজ্ঞ আলেমদের ভিন্নমতও রয়েছে। শূকরের চর্বি যদি চিকিৎসায় ব্যবহার করা হারাম হতো তাহলে তো এতে মরণঘাতক করোনাভাইরাসের শেফা থাকত না। এ জন্যই কোরআনে আল্লাহ শূকরের মাংস হারাম করেছেন। চর্বির কথা উল্লেখ করেননি। আল্লাহ অবশ্যই জানতেন একদিন পৃথিবীর বুকে মরণব্যাধি করোনাভাইরাস আসবে, দুনিয়া উলট-পালট হয়ে যাবে। তখন মানুষ এর ভ্যাকসিন আবিষ্কারে শূকরের চর্বি ব্যবহার করবে। কেউ যদি শূকরের চর্বি ব্যবহার হয়েছে এ অজুহাতে ভ্যাকসিন না নেয় তাকে আমি কোরআনের এ সতর্কবাণী শুনিয়ে দিতে চাই- ‘তোমরা নিজেকে নিজে মেরে ফেল না।’ সুরা বাকারা আয়াত ১৯৫।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, জামালি তালিমুল কোরআন।

সর্বশেষ খবর