শনিবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

নৈতিকতা ও মানবিকতা

জাকারিয়া চৌধুরী

নৈতিকতা ও মানবিকতা

নৈতিকতা ও মানবিকতা বিবর্জিত এখনকার মানবসমাজের গন্তব্য কোথায় ভাবতে গেলে ভয় ও দুর্ভাবনা ছাড়া কিছু দেখি না। অতীতে মানবজীবন নৈতিকতা ও মানবিকতা পূর্ণ ছিল বলব না। তবে তা এখনকার মতো সমাজ থেকে এত ব্যাপকভাবে উধাও হয়ে যায়নি। নীতিকথা শোনার, বন্ধুত্ব করার, ভালোবাসার সময় নেই মানুষের হাতে। মানুষ হন্যে হয়ে দৌড়াচ্ছে অর্থ ও আধিপত্যের পেছনে অতৃপ্ত ও অশান্ত মনে। অল্পে তুষ্ট থেকে সহজ-সরল, সুস্থ ও সুন্দর জীবনযাপনে আমাদের অনীহা। আমরা যা পাই তার চেয়ে বেশি চাই অন্যদের বঞ্চিত করে হলেও। জীবন আমরাভিত্তিক না হয়ে হয়েছে আমিভিত্তিক। আমার বৈষয়িক অর্জন যদি সমষ্টির কষ্টের কারণ হয় আমি তার ধার ধারি না। আমি ভোগে বিভ্রান্ত ও বিবেকহীন স্বেচ্ছাচারী আধুনিক মানুষ। আমরা মানবিক না হয়ে হয়েছি দানবিক। এ দানবকে জোগান দিতে গিয়ে বিশ্ব এখন মহাবিপদে। কিছু লোকের দানবীয় চাহিদা মেটাতে গিয়ে পৃথিবী এখন ভারসাম্যহারা। মানুষের হাতে ক্ষমতা আছে পৃথিবীকে মুহূর্তে ধ্বংস করে দেওয়ার মজুদ পারমাণবিক বোমা দিয়ে; অথচ একটা নগণ্য ও অদৃশ্য ক্ষুদ্র বীজাণুকে দমাতে পারছেন না পৃথিবীর হাজার হাজার বিজ্ঞানী এখনো। ইতিমধ্যে প্রাণ হারিয়েছে ১৯ লাখের বেশি মানুষ নীরব ও রক্তপাতহীন করোনার সঙ্গে যুদ্ধে। আরও কত হারাবে কে জানে? আর কত দুর্যোগের পথ পাড়ি দিতে হবে? এক দুর্যোগ পার না হতেই আরেক দুর্যোগ দেখা দেবে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে আগামীতে আরও বড় দুর্যোগ ঘটার আশঙ্কার কথা। পরিবেশবিজ্ঞানীদের কথা অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নিত্যনতুন রোগের উৎপত্তি ঘটবে। যুক্তরাজ্যের প্রিন্স হ্যারি বলেছেন, করোনা হলো প্রকৃতিপ্রদত্ত প্রতিশোধ। অনৈতিক ও অমানবিক আমাদের কর্মকান্ডে পৃথিবী এখন বেসামাল। অর্থবিত্ত ও প্রতাপের মোহে আর সব করণীয় ভুলে মানুষ এখন ছন্দহারা, দিশাহারা। ফলে মানবমনে নেমে এসেছে শূন্যতা, হতাশা, অস্থিরতা ও বিষণœতা। ‘করোনা’ এখন মানুষকে এক পতাকাতলে দাঁড় করিয়েছে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে আমাদের এক হয়ে চলতে হবে বেঁচে থাকতে হলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ মানুষে মানুষে হওয়ার আগে যুদ্ধ হবে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের। এ যুদ্ধে হারা মানে মানব-অস্তিত্ব বিলীন হওয়া। আমাদের ক্ষতিকর কর্মকান্ডের ফলে প্রাকৃতিক তান্ডব থেকে রক্ষা পেতে হলে প্রয়োজন আমাদের চিন্তা-চেতনা ও সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। মানুষ সামাজিক জীব মানব-অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার তাগিদে। আর সেই সমাজে পচন রোধের জন্য আবশ্যিক প্রতিষেধক মানবতা ও নৈতিকতা। এ দুই স্তম্ভ ছাড়া সমাজের আর সব অর্জন শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়বে।

আছে কি আমাদের সমাজে বিবেক ও ভালোবাসার স্থান? যেটুকু বা আছে তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি আছে অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার, নিপীড়ন ও শোষণ। পত্রপত্রিকা ও সব মিডিয়ায় খারাপ খবর ছাড়া ভালো খবর খুব একটা চোখে পড়ে না। এ দুঃসহনীয় জীবনযাত্রা থেকে উত্তরণের পথটা কী? বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি থেকে আমরা কি সে জ্ঞান পাব? নিশ্চয়ই না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সব জ্ঞানের শেষ নয়, সব সমস্যার সমাধান নয়। নৈতিকতা ও মানবিকতার বন্ধন ছাড়া সমাজে ধ্বংস নামবে আর সব সফলতা সত্ত্বেও। প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি যখন সমাজের একমাত্র লক্ষ্য তখন কি মানবতা ও নৈতিকতার বীজ বপন করা যাবে মানুষের মনে? সে জন্য প্রয়োজন শৈশবকাল থেকে মানুষকে নৈতিকতা ও মানবিকতার শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করা আর সব শিক্ষার সঙ্গে। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিটি স্তরে পাঠ্যসূচিতে এ শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা দরকার। আমাদের এ গুণাবলির চর্চা করতে হবে সচেতন মনে। ‘শক্তি যার জীবন তার’ বিবর্তনবাদের প্রবক্তা চার্লস ডারউইনের এ তত্ত্ব প্রকৃতির নিয়ম ও পরিসরে প্রযোজ্য। মানব জাতির বেলায় এ নীতি মেনে নেওয়া মানে পশুজীবনে নেমে যাওয়া। মানবসভ্যতার উত্থান-পতন এক চলমান প্রক্রিয়া। আল্লাহ আল কোরআনে বারবার উল্লেখ করেছেন মানবসমাজে যখনই নৈতিকতা, মানবিকতা ও স্রষ্টা-সচেতনতা লোপ পায় তখন তিনি সে সভ্যতা ধ্বংস করে দেন প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাধ্যমে যেমন ঝড়, তুফান, খরা, অতিবৃষ্টি, ভূমিকম্প, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, মহামারী ইত্যাদি দিয়ে। আল্লাহ আরও বলেছেন, আমরা মাটি খুঁড়ে বিলীন হয়ে যাওয়া বিভিন্ন সভ্যতার নির্দশন দেখতে পাব কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক যুগের আরও অনেক সভ্যতা আছে যার চিহ্নমাত্র আমরা খুঁজে পাব না। আজকের সভ্যতা কি তেমনই এক ধ্বংসপ্রক্রিয়ার সম্মুখীন নয়? আমি সে ভয়ে ভীত। অন্যদের মধ্যে সে উৎকণ্ঠতা তেমন একটা নেই দেখে আমি বিস্মিত। আমরা ‘চোখ থাকিতে অন্ধ’ না আমি অন্ধ? ইতিহাস সম্পর্কে কার্ল মার্কসের মতাদর্শ অনুযায়ী ইতিহাসের গতি পরিবর্তন হয় শ্রেণিসংগ্রামের দ্বন্দ্ব থেকে আর কোরআনের বাণী অনুযায়ী ইতিহাসের পট পরিবর্তন ঘটে ন্যায়-অন্যায়ের দ্বন্দ্ব থেকে। স্রষ্টা মানুষের মন সৃষ্টি করেছেন ন্যায়-অন্যায়ের, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বিদ্বেষ-ভালোবাসা প্রভৃতির দ্বন্দ্ব দিয়ে। বলা যেতে পারে ‘দৈবিক দানবিকতা’ মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য। আমরা কোন পথে চলব সে স্বাধীনতা আছে আমাদের। পশুজীবনে এ সমস্যা নেই। কিন্তু মানুষ চলে সচেতন মনে বেঁধে দেওয়া সামাজিক নিয়মে। আর সে ক্ষেত্রে আমরা ভুল করলে সমাজ হয় অমানবিক ও অনৈতিক, বেশির ভাগ মানুষের জীবন হয়ে ওঠে দুঃসহনীয়। শুধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রচেষ্টায় আমরা এখনকার মহাসংকট থেকে রেহাই পাব না। প্রয়োজন অন্য সব শিক্ষার সঙ্গে স্রষ্টা ও সৃষ্টিমুখী হয়ে নৈতিকতা ও মানবিকতার অনুশীলন। স্রষ্টা ও সৃষ্টি ভুলে কেবলই নিজে ভোগের যে জীবনধারা তা অন্তঃসারশূন্য, অর্থহীন। আমাদের তেজস্বী ও দূরদর্শী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমার বিনীত অনুরোধ- তিনি যেন এ ব্যাপারে নেতৃত্বদান করে জাতিকে সঠিক পথ দেখান। মনে রাখতে হবে, স্বাধীন বাংলাদেশের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিল শুধু অসম অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, বাংলাদেশকে নৈতিক ও মানবিকতার বিচারেও এক আদর্শিক দেশ হিসেবে গড়ে তোলা। তিনি এ আদর্শ লালন করেছেন জীবনভর এবং জীবন দিয়ে। বঙ্গবন্ধু যখন দেখলেন পশ্চিমা ধাঁচের প্রচলিত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ধারায় তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব নয় তখন তিনি নতুন পথের সন্ধানে বাকশাল গঠন করেছিলেন এবং তখনই দেশে-বিদেশে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র নতুন উদ্যমে দানা বাঁধে। শেখ হাসিনা ও রেহানা বাদে পরিবারের সব এবং কিছু নিকটাত্মীয়সহ বঙ্গবন্ধু শহীদ হন আততায়ীদের হাতে। এ ছিল মানব ইতিহাসের এক জঘন্যতম রাজনৈতিক হত্যাযজ্ঞ। বঙ্গবন্ধু প্রথাগত পেশাদার রাজনীতিবিদ ছিলেন না, ছিলেন ইতিহাসের এক আদর্শিক মহান নেতা। আমরা যেন তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশ গড়ায় শরিক হই- নববর্ষে এই আমার আশা।

লেখক : সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।    ইমেইল : [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর