রবিবার, ১৭ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

বইমেলা নিয়ে সংশয় কেন

সাদাত হোসাইন

বইমেলা নিয়ে সংশয় কেন

লেখালেখির সূত্রে লেখক, প্রকাশক, পাঠক এ তিন পক্ষের সঙ্গেই একটা নিবিড় সম্পর্ক বা জানাশোনা আমার রয়েছে। এর সূত্র ধরেই একটা বিষয় খুব বুঝতে পারি, তা হলো বাংলাদেশে প্রকাশনা শিল্প আসলে কী অবস্থায় রয়েছে। বা একটি শিল্প (ইন্ডাস্ট্রি) হয়ে উঠতে হলে তাদের কী দরকার।

সবার আগে যা দরকার তা হলো সক্ষমতা। এ সক্ষমতা আসলে কীসের অনেকেই হয়তো নাক সিটকিয়ে বলবেন, ‘বাজারি’ লেখক সাদাত হোসাইন তো বই বিক্রির কথাই বলবেন।

জি, আপনার ধারণা সঠিক হয়েছে, আপনি জয়যুক্ত হয়েছেন। সত্যি কথা বলতে, হ্যাঁ, আমি বই বিক্রির কথাই বলব। কিন্তু কেন সে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। বই নিয়ে, বইয়ের প্রকাশনা কিংবা নিদেনপক্ষে আমার একটা বইয়ের দোকান থাকবে এ রকম স্বপ্ন দেখা লোকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। কিন্তু একটা অতি সাধারণ দৃশ্য প্রায় সময়ই আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। দৃশ্যটি হলো বই নিয়ে শুরু হওয়া এমন অসংখ্য উদ্যোগ বা স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত আর আলোর মুখ দেখে না। কিংবা মাঝপথে বা শুরু হতেই মুখ থুবড়ে পড়ে।

এ দৃশ্যগুলো আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়, কারণ ঘটনাগুলো এত হরদম ঘটে, এত বেশি স্বাভাবিক যে একে আলাদা করে দৃষ্টি দেওয়ার প্রয়োজন বলে আর মনে হয় না। মনে হয়, ‘আরে দূর, এটাই তো হওয়ার কথা ছিল!’

আর স্বাভাবিক বলেই প্রতি বছর অসংখ্য নতুন ছোট ছোট প্রকাশনা সংস্থার জন্ম যেমন আমাদের আলোড়িত করে না, আলাদা করে চোখে পড়ে না, তেমনি বছর ঘুরে বছর আসার আগেই এদের মৃত্যুও না। বন্ধ হয়ে যাওয়াটাও না।

প্রতি বছর অসংখ্য বইয়ের দোকান বা আড়ম্বর করে উদ্বোধন করা শোরুম আমাদের চোখে পড়ে। সেগুলো দেখে আমরা কতটা আমোদিত হই আমি নিশ্চিত নই, তবে এটি নিশ্চিত যে মনের ঈশান কোণে শঙ্কার কালো মেঘ ঠিকই উঁকি দেয়, ‘কয় দিনের জন্য এই দোকান কত দিন চলবে ভাড়াই তো উঠবে না।’

কথা সত্য। ভাড়া আসলেও ওঠে না। দোকান বন্ধ হয়ে যায়। নান্দনিক অলঙ্করণ আর স্বপ্নের সমাধি ঘটে পরের মাসের ফাস্টফুডের দোকানের ডেকোরেশনে। কাপড়ের দোকানের আয়োজনে। ‘গ্রন্থকানন’ বা ‘আলোর মিছিল’ নামক বইয়ের লাইব্রেরির সমাধির ওপর সগৌরবে গড়ে ওঠে ‘স্পাইসি চিকেন, রেডি কিচেন, ঝটপট হট শট পিৎজা’র দোকানে। পাকিস্তানি লন আর ভারতীয় লেহেঙ্গার ফ্যাশন হাউসে।

এসব আমাদের চোখ সয়ে গেছে। ফলে বইয়ের দোকান নিয়ে বুকের ভিতর ক্ষয়ে যেতে আমাদের বয়েই গেছে!

মাঝেমধ্যে হয়তো বার দুই জিব চুকচুক করে আফসোস প্রকাশ করি। তারপর সে জিবে ওই স্পাইসি চিকেন আর হট পিৎজা চেখে আঃ উঃ করতে করতে ফেসবুকে ‘চেক-ইন’ দিই। ততক্ষণে আরও আরও বইয়ের দোকান, স্বপ্নালু চোখ জগতের সব শোক বুকে চেপে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুপথের যাত্রী হয়।

হ্যাঁ, হয়।

আমরা যখন ‘এর বই কিনবেন কেন তার বই কিনবেন কেন তার তো কিছু হয় না, সে কোনো লেখকই না’, এমন মুহুর্মুহু ঝগড়ায় ফেসবুক প্রকম্পিত করি তখন ছাপাখানা বন্ধ হয়ে যায়, কারণ বইয়ের পাঠক নেই, বাঁধাইখানার শ্রমিক বেকার হয়, কারণ ছাপার জন্য যে অল্প পরিমাণ বই আসে তাতে তাদের জীবিকা নির্বাহ হয় না। প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। কিংবা ওই ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকে। অপেক্ষায় থাকে আবার জমবে মেলা।

মেলা কি আসলেই জমবে জমবে কি না জানি না। শুনছি বইমেলা হবে না। বা অনিশ্চিত। তার আগে আরও অনেক কিছু শুনেছি বছরজুড়েই। এ করোনা শুরুর পর থেকেই দেশে কতগুলো বইসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান চোখের পলকে ‘নাই’ হয়ে গেছে, সে খবর আমরা রাখিনি। এ ঢাকা শহরেই কতগুলো বইয়ের স্বপ্ন দেখা নান্দনিক প্রচেষ্টা তাদের ব্যবসা গুটিয়ে বাড়ির পথ ধরেছে, সে খবরও রাখিনি। কতগুলো বন্ধ হওয়ার অপেক্ষায় ধুঁকে ধুঁকে টিকে আছে, সে খবরও না।

আমরা জানি না, বইসংশ্লিষ্ট অন্য যে স্টেকহোল্ডাররা (প্রকাশক, লেখক, ছাপাখানা কর্মী, মালিক, বাঁধাই ঘর কর্মী ইত্যাদি) রয়েছেন, তাদের কার কী অবস্থা এ খাতে প্রণোদনা আছে কি না আমার জানা নেই। হয়তো লাগেই না। নিশ্চয়ই বইয়ের প্রকাশনার সঙ্গে যারা যুক্ত হন তারা সবাই স্বাবলম্বী, স্বাবলম্বী না হলে কি আর কেউ নান্দনিক চর্চার সঙ্গে যুক্ত হয় কে জানে এটাই হয়তো ভাবনা। আর এ ভাবনার কারণেই হয়তো লেখক যখন বই বিক্রির জন্য প্রচার চালান তখন আমাদের গাত্রদাহ হয়। প্রকাশক যখন তাঁর লেখককে নিয়ে সরব হন তখন আমাদের যন্ত্রণা তৈরি হয়।

কিন্তু আমরা কখনই ভাবি না যে এ বইয়ের ভাবনা, লেখা থেকে শুরু করে উৎপাদন- এ পুরো প্রচেষ্টার সঙ্গেই অসংখ্য মানুষের শ্রম, মেধা, সময় যুক্ত।

এ প্রত্যেকটি মানুষের জীবন-জীবিকা বই বিক্রির ওপরই নির্ভরশীল।

আমরা যে ঝা চকচকে বইয়ের দোকান-স্টল দেখি, সেটা সাজাতে পয়সা লাগে, ওই জায়গাটুকুর ভাড়া লাগে, ওই স্টলে কাজ করা ছেলেমেয়েগুলোকে বেতন দিতে হয়।

আমরা যে শোরুমগুলো দেখি সেখানেও একই হিসাব। আর এসব হিসাব মেলানোর একমাত্র উপায় ওই বই বিক্রি।

বই বিলাসদ্রব্য না মৌলিক চাহিদা এটা মানুষ কেন কিনবে কখন কিনবে এ প্রশ্নের উত্তর আমি সম্ভবত জানি না বা জানতে চাই না। তবে আমাদের বাস্তবতায় এ প্রশ্নটি সত্যিকার অর্থেই সহজ।

আরও সহজ যখন করোনার মতো কঠিন পরিস্থিতি তৈরি হয়। কারণ বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার তুলনায় বই কেনা লোকের সংখ্যা কেন এমন বিস্ময়কর রকম কম তা রীতিমতো রহস্যের বিষয়। বইমেলা ছাড়া সারা বছর প্রকাশকসহ বইসংশ্লিষ্ট অন্যরা আসলে কীভাবে বেঁচে থাকেন তাও রহস্য।

সত্যিকার অর্থেই রহস্য।

এ রহস্য উদঘাটিত হয়নি। বরং প্রকাশকরা এক বইমেলার বই বিক্রির অর্থ দিয়ে সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন, দাঁতে দাঁত চেপে ক্যালেন্ডারের পাতা গুনতে থাকেন আবার কবে বইমেলা আসবে ওই ফেব্রুয়ারির এক মাস। তারপর আবার এক বছর অপেক্ষা। যন্ত্রণাময় অপেক্ষা।

সে এক বছর এবার সম্ভবত কয়েক বছরের যন্ত্রণা দিয়েছে তাদের। কারণ করোনা! সার্বিকভাবে একটি নাজুক অর্থনৈতিক সামর্থ্য, ক্রয়ক্ষমতা ও শঙ্কা তৈরি হয়েছে মানুষের। এ সময়ে মানুষ যতটা সম্ভব হিসাব করেই তাঁর মৌলিক চাহিদা পূরণের চেষ্টা করেছে। চাল, আটা, নুন, তেলের হিসাব কষে কিনতে চেয়েছে।

হাজার হাজার মানুষ থাকার ভাড়া না দিতে পেরে শহর ছেড়েছে। চাকরি হারিয়েছে। সেখানে বই বই কে কিনবে বই কি মৌলিক চাহিদা এ না কিনলে, না পড়লে বাঁচা যায় না

আচ্ছা, বই এ দেশের মানুষের কত নম্বর চাহিদার তালিকায় থাকবে ১০০ ৫০০ হাজার কতজনের এগুলো হাস্যকর প্রশ্ন মনে হয় হতে পারে। কিন্তু এটাই বাস্তবতা। আরও বাস্তবতা এ করোনায় সে বই বিক্রি ‘বেশির ভাগ’ প্রকাশকই আশঙ্কাজনক রকম কম। অথচ তাদেরও খেয়েপরে বাঁচতে হয়। দোকান ভাড়া দিতে হয়। ওই যে দোকানের তাকে একটা বই সাজিয়ে রাখতে দেখেন ওই বইটা রাখতে যে এক ইঞ্চি জায়গা লাগে, ওই জায়গাটুকুর ভাড়ারও হিসাব কষতে হয়। একটা বই কত দিন অবিক্রীত থেকে কতটুকু জায়গা দখল করে রাখল এ হিসাবটা মাথায়, মনে ও খিদা জরজর পেটে রাখতে হয়। রাখতে হয় ওই দোকানের বাইরে অবিক্রীত বহু বই স্তূপ করে রাখার জন্য যে গুদামঘরখানা ভাড়া করা হয়েছে সেখানার হিসাবও।

তার পরও তারা অপেক্ষায় থাকেন বইমেলার। এবারও ছিলেন। এমনকি বইমেলার জন্য বুক বেঁধে অপেক্ষায় থাকা বহু প্রকাশক আগেভাগেই অনেক বই ছেপেও ফেলেছিলেন। এ দুর্দিনে যেটুকু টাকা সঞ্চয়ে ছিল সেটুকুও বিনিয়োগ করে ফেলেছেন কিংবা ধারদেনা করেই কাজে নেমে পড়েছিলেন অনেকে। কারণ, বছর শেষের এ বইমেলাই তো তাদের নবান্ন নিয়ে আসবে।

কৃষক যেমন মৌসুম শেষে ফসল ওঠার অপেক্ষায় থাকেন, তারপর গঞ্জে গিয়ে সেই সোনালি ফসল বিক্রি করে আলোঝলমলে মুখে ঘরে ফেরেন, যদিও তিনি জানেন এ ফসলে ফি বছর অবধি যেতে ভারি কষ্ট হয়ে যাবে, তার পরও ওই মৌসুম শেষে ফসল ওঠার অপেক্ষায়ই তারা থাকেন। বইয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাও।

তাহলে এই যে বইমেলার ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে গেল, বারবার তারিখ পরিবর্তিত হচ্ছে, সংশয়ের দোলাচালে দুলছে। এটা কি ঠিক নয় নিশ্চয়ই ঠিক।

কারণ, এ বইমেলা থেকেই একমাত্র করোনাভাইরাস ছড়াতে পারে, নিশ্চয়ই এমন কোনো গবেষণালব্ধ তথ্য তাদের কাছে রয়েছে। সম্ভবত এটাই কভিডের একমাত্র প্রজনন ক্ষেত্র।

করোনার মতো মহামারীতে দেশের সব শপিং মল চলছে, নিউমার্কেট যেন ঈদের আগের চানরাতের মতো সরগরম, দোকানপাট খোলা, সিনেমা হলে নিত্যনতুন সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে, রাস্তাঘাটে জনজট ও যানজট, উভয়ই নিজেদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে, কোথাও ‘তিল ঠাঁই আর নাহিরে’। বাংলাদেশ-নেপাল ফুটবল ম্যাচে গ্যালারিভর্তি দর্শকের হুল্লোড়ে কান পাতা দায়!

চলছে ওয়াজ-মাহফিল, সভা-সমাবেশ, জনজমায়েত। এমন এক দেশে বইমেলা বন্ধ রাখার যুক্তি আসলে কী যুক্তি কি এত সংশয়ের দ্বিধার শঙ্কার তা আমি জানি না। তবে সবকিছু দেখেশুনে সন্দেহ করি, সম্ভবত কারণ ওই একটাই। কোনো এক অলৌকিক উপায়ে নিশ্চয়ই নিশ্চিত হওয়া গেছে, কেবল বইমেলাই করোনার প্রজনন ও প্রসারের উর্বরতম ক্ষেত্র! কেবল এ বইমেলার কারণেই সে ছড়িয়ে পড়তে পারে দিগ্বিদিক।

তা ছাড়া এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নিশ্চয়ই হাওয়া খেয়ে বাঁচতে পারে। কিংবা বইয়ের ভিতর ছাপা হওয়া জ্ঞান গলাধঃকরণ করেও। পারে না হয়তো।

না হলে বইমেলাটাও অন্য সবকিছুর মতোই নির্দ্বিধায় হতে পারবে না কেন করোনার নিরাপত্তার বিষয়টাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে এমনকি মাসখানেক পিছিয়ে হলেও। যেখানে করোনা পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটছে বলে রোজ শোনা যাচ্ছে। বলছে বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাসও। সেখানে সামাজিক দূরত্বটাকে যতটা সম্ভব অগ্রাধিকার দিয়েই তো হতে পারে বইমেলা!

কী জানি! আজকাল কত কিছুই তো বুঝি না। না হয় এটাও না বুঝলাম।

 

                লেখক : কথাশিল্পী।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর