সোমবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

রসুল (সা.)-এর সঙ্গে সাহাবাদের সম্পর্ক

আল্লামা মাহমূদুল হাসান

তিরমিজির এক হাদিসে বর্ণিত, জনৈক সাহাবি রসুল (সা.)-কে প্রশ্ন করেছিলেন, সৃষ্টির মধ্যে সর্বাধিক শক্তিশালী বস্তু কোনটি? উত্তরে তিনি বলেছেন, জমিন। সাহাবি প্রশ্ন করেন, এর চেয়েও কি শক্তিশালী কোনো বস্তু আছে? রসুল ইরশাদ করলেন- হ্যাঁ, পাহাড়। সাহাবি প্রশ্ন করলেন, এর চেয়েও কোনো শক্তিশালী বস্তু আছে কি? রসুল ইরশাদ করলেন- হ্যাঁ, লোহা। সাহাবি প্রশ্ন করলেন, এর চেয়ে অধিক শক্তিশালী কোনো বস্তু আছে কি? রসুল ইরশাদ করেন- হ্যাঁ, আগুন। সাহাবি প্রশ্ন করলেন, এর চেয়ে অধিক শক্তিশালী কোনো বস্তু আছে কি? রসুল ইরশাদ করলেন- হ্যাঁ, পানি। সাহাবি প্রশ্ন করলেন, এর চেয়ে অধিক শক্তিশালী কোনো বস্তু আছে কি? রসুল ইরশাদ করলেন- হ্যাঁ, বাতাস। সাহাবি প্রশ্ন করলেন, এর চেয়ে অধিক শক্তিশালী কোনো বস্তু আছে কি? রসুল ইরশাদ করলেন- হ্যাঁ, মানুষ। এরপর সাহাবি আর কোনো প্রশ্ন করেননি। মানুষ সৃষ্টির সেরা এবং শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে মানুষই প্রধান জাতি। এমতাবস্থায় রসুলকে মাটির তৈরি মানুষ না বলে নূরের তৈরি মানুষ বলে আকিদা পোষণ করার অর্থ হচ্ছে এই যে, রসুল জাতিগতভাবে প্রধান নন; বরং দ্বিতীয় স্তরের। নবীর প্রতি এহেন অসম্মানজনক আচরণ কেবল অশোভনীয়ই নয়; বরং মূর্খতারও পরিচায়ক। বস্তুত মাটির তৈরি থেকে নূরের তৈরিকে অধিক সম্মানজনক মনে করা বোকামির পরিচায়ক; যা ধর্ম বিষয়ে অজ্ঞতার অনিবার্য পরিণতি। সঠিক জ্ঞানার্জনের মাধ্যমেই কেবল এ অজ্ঞতার অবসান হতে পারে।

এই হাদিসে পর্যালোচনার অন্যতম একটি বিষয় হচ্ছে, প্রশ্নকারী সাহাবি বিশ্ব রসুলের কাছে পুনঃপুনঃ প্রশ্ন করা অব্যাহত রাখেন। তিনি বিশ্ব রসুলের প্রথম উত্তরকেই সর্বশেষ উত্তর হিসেবে ধরে নিতে পারেননি। তার মনে পুনঃ প্রশ্নের উদ্রেক হয়। বিশ্বনবীও ধারাবাহিক উত্তর দিয়ে তাঁর অনুসন্ধিৎসা নিবারণ করেন এবং সবশেষে স্বীয় অন্তরে লুকিয়ে থাকা চূড়ান্ত সত্যটি প্রকাশ করেন।

স্বভাবগত মিলের কারণেই রসুলেপাক ওহি নাজিলের আগেই আল্লাহর চাহিদাকে বুঝতে সক্ষম হতেন এবং রসুলের সঙ্গে মিলের কারণে সাহাবায়ে কেরাম রসুলের অন্তরের চাহিদা অনুধাবনে সক্ষম হতেন। এটা ইলমে গায়েব নয়; বরং এটা হচ্ছে স্বভাবগত মিল এবং নিদর্শনাবলির মাধ্যমে অনুধাবন। হজরত ওমর এরূপ কারণেই অনেক হুকুম-আহকামের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করতেন। আর সে মতে পবিত্র কোরআনে আয়াত নাজিল হতো অথবা রসুল (সা.) অনুরূপ হুকুম রচনা করতেন। এ কারণেই রসুল (সা.) সাহাবাদের প্রতি অত্যন্ত আস্থা ব্যক্ত করে তাদের উম্মতের জন্য মাপকাঠি বলে ঘোষণা দিয়েছেন- আমার এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত পালন করা তোমাদের ওপর অত্যাবশ্যকীয়। তোমরা এর ওপর দৃঢ়পদ থাক। আমার সাহাবিরা নক্ষত্রতুল্য। তাদের যে কাউকে তোমরা অনুসরণ করবে হেদায়াত পাবে। অন্যত্র ইরশাদ করেছেন, ‘আমি এবং আমার সাহাবিদের অনুসৃত পথই মুক্তির পথ।’

প্রশ্নকারী এই সাহাবি রসুলের সঙ্গে স্বভাবগত মিলের কারণে রসুলের অন্তরের গোপন বিষয় অনুধাবনে সক্ষম হন যে, এটাই রসুলের শেষ উত্তর নয়। তাই শেষ উত্তরের জন্য তাঁর অন্তর অধীর হয়ে ওঠে এবং একের পর এক প্রশ্ন অব্যাহত রেখে রসুলের উত্তর লাভ করে শেষ প্রশ্ন করে থেমে যান। এই হাদিসের সর্বশেষ যে বিষয়টি পর্যালোচনার দাবি রাখে-তা হচ্ছে শেষ প্রশ্ন করে সাহাবির নীরবতা অবলম্বন; সাহাবি তার ধারাবাহিক প্রশ্ন অব্যাহত না রেখে তিনি কেন নীরবতা অবলম্বন করলেন? এর উত্তর এই যে, তিনি পরবর্তী প্রশ্ন এবং উত্তর অনুধাবনে সক্ষম ছিলেন। প্রশ্নের উদ্দেশ্য হয় অভিজ্ঞতা অর্জন বা অজানা বিষয়ে অবগতি লাভ করা। তর্ক-বিতর্কে অবতীর্ণ হওয়া অথবা কাউকে অযথা প্রশ্ন করা প্রশ্নের উদ্দেশ্য হতে পারে না।

সাহাবি পরবর্তী প্রশ্ন না করে নীরব ভূমিকা পালন করেছেন। কারণ তিনি বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, যদি আমি প্রশ্ন করি, মানুষের চেয়েও কি শক্তিশালী কোনো কিছু আছে তাহলে রসুল উত্তর করবেন হ্যাঁ আছে, আর তিনি হচ্ছেন মহান রাব্বুল আলামিন। যিনি সমস্ত ক্ষমতার মূল উৎস। যার ক্ষমতাই মূলত ক্ষমতা, যার ক্ষমতা অসীম-অনন্ত। রসুলের সঙ্গে স্বভাবগত মিলের কারণেই উক্ত সাহাবি এরূপ অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

রসুলের সঙ্গে সাহাবাদের এই স্বভাবগত মিল ও সর্বক্ষেত্রে সাদৃশতা তাদের মধ্যে বিশ্ব রসুলের স্বভাব-চরিত্রের প্রতিফলনের ফলাফল। স্বয়ং রসুলেপাকের মধ্যে হক এবং সত্যাকর্ষণ-এই দুই শক্তি বিদ্যমান ছিল। আল্লাহপাকের অধিক নিকটতম হওয়ার কারণে বিশ্ব রসুল ওহি ব্যতীতই আল্লাহপাকের অভিপ্রায় অনুধাবনে সক্ষম হতেন। এ কারণেই কেবল ওহি নয়; বিশ্বনবীর ইজতেহাদও শরিয়তের অকাট্য প্রমাণ হিসেবে স্বীকৃত। তিনি ইজতেহাদ করে কোনো হুকুমের সূচনা করলে তা আল্লাহর পক্ষের হুকুম বলে বিবেচিত হয়।

‘তিনি নিজের পক্ষ থেকে কিছু বলেন না, যা বলেন, আল্লাহর ইঙ্গিতেই বলেন।’ আল্লাহর নৈকট্যের কারণে যেমন বিশ্বনবী (সা.) আল্লাহর চাহিদা ও অভিপ্রায় অনুধাবনে সক্ষম হতেন, তেমনিভাবে একই কারণে সাহাবাগণও রসুলে পাকের চাহিদা অনুধাবনে সক্ষম হতেন। বিশ্বরসুলের সঙ্গে তাদের স্বভাবগত মিল, গভীর আকর্ষণ, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা-ভক্তির কারণেই তারা তা অনুধাবনে সক্ষম হতেন। হজরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ বলেন যে, হজরত ওমর ফারুক এভাবে শরিয়তের ২২টি হুকুম অনুধাবনে সক্ষম হন। পরবর্তীকালে হজরত ওমরের সেই অনুধাবন মোতাবেক আয়াত অবতীর্ণ হয়। হজরত ওমর এ নিয়ে গৌরব করতেন। হজরত রসুলেপাক এ জন্যই তাঁকে এই উম্মতের ‘মুহাদ্দাস’ খেতাবে ভূষিত করেছেন।

লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ।

সর্বশেষ খবর