বুধবার, ২০ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

লড়াইয়ের দ্বিতীয় পর্ব, আমরা কি প্রস্তুত?

মনজুরুল আহসান বুলবুল

লড়াইয়ের দ্বিতীয় পর্ব, আমরা কি প্রস্তুত?

১. বাঙালির বড় শক্তি বোধ হয় এর রসশক্তি! বিপদ-আপদ, ঝড়-ঝাপটা সব মোকাবিলা করে জীবনযাপনের বড় শক্তি এটি। ওই যে বাঙালি কবির সরল কথা : ‘... বাঘের সাথে যুদ্ধ করিয়া আমরা বাঁচিয়া আছি/আমরা হেলায় নাগেরে খেলাই/নাগেরই মাথায় নাচি।’

২. করোনার এ কঠিন সময়ে যুদ্ধ করেই বেঁচে আছি। প্রতিদিন আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা ঘাড়ের ওপর শ্বাস ফেলছে। ‘ভ্যাকসিন এই এলো বলে’ বুকভরা ভরসা নিয়ে বেঁচে থাকি প্রতিদিন। ভ্যাকসিন কবে আসবে, কারা আগে পাবে, কম দামে-বেশি দামে নাকি বিনামূল্যে এসব নিয়ে মাঠ গরম। কারা ব্যবসা পেল, কারা কত লাভ করল তাই নিয়ে গরম রাজনীতিও।

৩. ভ্যাকসিন এখনো আসেনি। আসলে কী কী ঘটতে পারে, সাংবাদিকদের কেমন রিপোর্ট করতে হতে পারে তার রস গড়াচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে। কাউকে বা কোনো বিশেষ প্রতিষ্ঠান বা অঞ্চলকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য নয়, নিছক নির্মল রস আস্বাদনের জন্যই সেখান থেকে কিছু নিচ্ছি। কৃতজ্ঞতা তাদের প্রতি যিনি বা যারা এ রস ছড়িয়ে দিয়েছেন, সৃজন করেছেন।

বাংলাদেশে করোনা ভ্যাকসিন আসার পর আমাদের গণমাধ্যমে কী ধরনের শিরোনাম দেখা যেতে পারে? আসুন চোখ বুলাই একবার :

বরিশালে উপজেলা চেয়ারম্যানের বাসায় খাটের নিচ থেকে ৫ হাজার ফাইল করোনা ভ্যাকসিন উদ্ধার।

জিনজিরায় নকল করোনা ভ্যাকসিনের কারখানায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান!

রাজধানীর অভিজাত এলাকার এক ফার্মেসি থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ ৩ হাজার ফাইল করোনা ভ্যাকসিন উদ্ধার করেছে র‌্যাব।

করোনা ভ্যাকসিন হালাল না হারাম এ নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুই গ্রুপের সংঘর্ষে শতাধিক আহত, গ্রেফতার ৩ শতাধিক।

অনলাইনে নকল করোনা ভ্যাকসিনের রমরমা ব্যবসা। সরকার শিগগিরই নতুন অনলাইন নীতিমালা প্রণয়ন করবে, জানালেন মন্ত্রী।

করোনা ভ্যাকসিনের ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে সরকারি দলের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত ৩, মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রশাসন।

বন্ধুরাষ্ট্র ভারত আসন্ন পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে ইলিশের বিনিময়ে ১ লাখ ডোজ করোনা ভ্যাকসিন উপহার দিতে চায়।

করোনা ভ্যাকসিন কিনলে ২৫% ছাড়; ওষুধ দোকান সমিতির ঘোষণা।

করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি। তিন মন্ত্রী আর পাঁচ সংসদ সদস্যকে দুদকে তলব!

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নিয়ে লাগামছাড়া দুর্নীতি, এক মাসে ৩ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা পাচার!

করোনা ভ্যাকসিনের দুর্নীতিতে সরকার জিরো টলারেন্স দেখাবে : সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক।

গৃহবন্দী নেত্রীকে আগে না দিয়ে অন্যকে ভ্যাকসিন দেওয়ার চেষ্টা হলে দেশ অচল করে দেওয়া হবে : বিরোধী দলের মহাসচিব।

ক্যাসিনো সম্রাটের পর এবার করোনা ভ্যাকসিন সম্রাট আটক, নগদ ১৭০ কোটি টাকা ও প্রায় ২৩ মিলিয়ন ডলার জব্দ।

করোনা ভ্যাকসিন দুর্নীতির জন্য জিয়াউর রহমান দায়ী- কাদের। এ ভ্যাকসিন যে একদিন লাগবে সে ঘোষণা জিয়াই প্রথম দিয়েছিলেন- মির্জা।

করোনা ভ্যাকসিন জালিয়াতি মামলায় শতাধিক সরকারি কর্মকর্তার নাম। একাধিক আমলার বেগমপাড়ায় গমন। পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে জাস্টিন ট্রুডোকে দুদকের চিঠি।

ভ্যাকসিন কারা আগে পাবে তাই নিয়ে দ্বন্দ্ব : (অব.) আমলারা আগে চান। মাঠের আমলাদের দাবি : অবসর নিয়ে তারা থাকেন বাড়িতে, কাজ করেন চুক্তিতে, তাদের জীবনের অবসানও নেই, অবসর নেই। কাজেই মাঠের আমলাদের আগে দেওয়া হোক।

ভ্যাকসিন নেওয়া আর না নেওয়াদের মধ্যে ফুটবল ম্যাচ, ময়মনসিংহে। ফলাফল গোলশূন্য ড্র।

সর্বশেষ খবর : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) বলেছে, বাংলাদেশের জনগণ যে করোনা ভ্যাকসিন ব্যবহার করে আসছে তা আসলে করোনা ভ্যাকসিন নয়। এটি খেজুরের রস আর ডাবের পানি মিশ্রিত এক প্রকার পানীয়। বাংলাদেশকে কঠিন সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ।

৪. ওপরের বিষয়গুলো নিছকই কৌতুক। তবে বাস্তবতা হচ্ছে : করোনার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় পর্যায়ের লড়াই শুরু হয়েছে। আমরা কি প্রস্তুত? প্রশ্নটি সবার জন্যই, কিন্তু আলোচনা করছি গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের নিয়ে।

প্রথম পর্যায়ের যুদ্ধে অনেক বেশি মূল্য দিয়ে আমাদের সফলতা এসেছে। এ যুদ্ধ ছিল একেবারেই নতুন। অজ্ঞাত এক শত্রুর বিরুদ্ধে। করোনাযুদ্ধে সারা বিশ্বে মারা গেছেন ৫০০-এর বেশি সাংবাদিক, আক্রান্ত হয়েছেন অনেক গুণ বেশি। বাংলাদেশের করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বা আক্রান্ত গণমাধ্যমকর্মীর সংখ্যাও কম নয়।

লড়াইয়ের দ্বিতীয় পর্যায় এখন বিশ্বজুড়ে। ভ্যাকসিন দেওয়ার যে মহাযজ্ঞ শুরু হয়েছে এর সংবাদ কভার করার জন্যও প্রস্তুতি দরকার। সঠিক তথ্য জানানোই সাংবাদিকদের কাজ। নিজে বিভ্রান্ত হওয়া নয়, মানুষকেও বিভ্রান্ত করা নয়।

আমাদের দেশে করোনা ভ্যাকসিন আসবে শিগগিরই। লাখ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়া হবে লাখ লাখ মানুষের দেহে। ভ্যাকসিন আনা, সংরক্ষণ ও দেওয়ার জন্য ব্যবস্থাপনা যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন এ বিষয়ে তথ্য ব্যবস্থাপনায়ও। যারা ভ্যাকসিন আনবেন, সংরক্ষণ করবেন এবং জনগণকে দেবেন তাদের যেমন তথ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে তেমনি সাংবাদিক হিসেবে সঠিক সময়ে সঠিক তথ্য জানানোর জন্য গণমাধ্যমকেও প্রস্তুতি নিতে হবে।

এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রে দুটি ভ্যাকসিন অনুমোদন পেয়েছে (ফাইজার-বায়োএনটেক ও মডার্না)। দুটিই করোনার বিরুদ্ধে কার্যকর তবে শতভাগ নয়। এ সত্যটি কোম্পানিগুলোই বলেছে। কাজেই এ ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও কেউ কেউ করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন, কারও অ্যালার্জি থাকলে এ ভ্যাকসিনে পার্শ¦প্রতিক্রিয়া হতে পারে, কোনো বিশেষ রোগে আক্রান্তদের মৃত্যুও হতে পারে। তার মানে এই নয় এ ভ্যাকসিন ভুয়া, কোনো কাজের নয়। এ ধরনের কথা বলা হবে স্পর্শকাতরতা তৈরি। যা কোনো কাজে আসবে না বরং ভয় ছড়াবে।

কাজেই ভ্যাকসিন নিয়ে রিপোর্ট করতে গেলে প্রয়োজন অতিসতর্কতা। প্রয়োজন প্রকৃত বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে বৈজ্ঞানিক সত্যটি জেনে নেওয়া। সাংবাদিকদের এ তথ্যটিও জানাতে হবে : ভ্যাকসিন নেওয়ার পর কোনো পার্শ¦প্রতিক্রিয়া হলে তার চিকিৎসা কীভাবে এবং কোথায় করতে হবে। সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগকে এসব বিষয় স্পষ্টভাবে গণমাধ্যমকে জানাতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন : কোনো ভ্যাকসিন নেওয়ার পর প্রতি ১০ লাখের মধ্যে এক দশমিক তিন জনের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হাতে পারে। করোনা ভ্যাকসিনেও এ রকমটা হওয়া অস্বাভাবিক নয়।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বলছে : করোনার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত জয়ী হওয়ার একমাত্র জবাব নিজেকে হার্ড ইমিউনিটির পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। আর চিকিৎসার মাধ্যমে সুরক্ষা হচ্ছে ভ্যাকসিন নেওয়া। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে, মারা গেছে প্রায় ৪ লাখ। এর মধ্যেও সাম্প্রতিক এক জরিপ বলছে : ২৭ থেকে ৩৭ ভাগ আমেরিকান নাগরিক বলছেন তারা ভ্যাকসিন নেবেন না। গণমাধ্যম যদি ভ্যাকসিন নিয়ে ভীতিকর খবর ছড়ায় তাহলে এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। তবে অন্য এক জরিপের তথ্য : যুক্তরাষ্ট্রের ৭১ ভাগ মানুষ ভ্যাকসিন নেওয়ার পক্ষে যদি বিশেষজ্ঞরা এটি অনুমোদন করেন এবং সবাইকে বিনামূল্যে দেওয়া হয়।

সাধারণত একটি ভ্যাকসিন তৈরিতে যে সময় লাগে করোনা ভ্যাকসিন তার চাইতে অনেক কম সময়ে তৈরি হয়েছে। এর পরীক্ষার সময়ও কম। যাদের ওপর পরীক্ষা চালানো হয়েছে সে সংখ্যাও খুব বেশি না। আর এ নিয়ে ব্যবসা আর রাজনীতিও কম হয়নি, হচ্ছে না। রাশিয়া না চীন, ভারত না যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র না ব্রাজিল এ ঘেরাটোপ তো আছেই। সে জন্যই বিভ্রান্তি ছড়ানোর আশঙ্কা বেশি। সে জন্য গণমাধ্যমের সতর্কতা জরুরি।

৫. ২৮ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের সানডিয়েগো টেলিভিশনে শিরোনাম করা হলো : ভ্যাকসিন নেওয়ার আট দিন পর এক নার্সের করোনা পজিটিভ ধরা পড়েছে। কিন্তু টেলিভিশনটি এ কথা বলেনি, ওই নার্স তার প্রথম ডোজটি নিয়েছিলেন মাত্র, দ্বিতীয় ডোজটি নেননি। সাধারণত প্রথম ডোজটির ১০ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে প্রথম ডোজের কার্যকারিতা শুরু হয়, দ্বিতীয় ডোজটি নিতে হয় ২৮ দিন পর। এখন নার্সটি কি প্রথম ডোজ নেওয়ার আগেই আক্রান্ত হয়েছিলেন, পরে পরীক্ষায় ধরা পড়ে? এ প্রশ্নগুলোর জবাব খোঁজা হয়নি। নরওয়েতে ভ্যাকসিন নিয়ে মৃত্যু ঘটনার তদন্ত হচ্ছে, অনুসন্ধানী সাংবাদিকরাও মাঠে নেমেছেন। ফেসবুক বলছে : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের মন্তব্য ছাড়া ভ্যাকসিন বিষয়ে যে কোনো তথ্য তারা তুলে নেবে। ইউটিউবও আগে একই ধরনের ঘোষণা দিয়েছে।

৬. জীবনের সহজ অনুষঙ্গ হিসেবে হাস্যরস চলুক। কিন্তু যে বিষয়টির সঙ্গে মানুষের জীবন-মরণ সমস্যা জড়িয়ে সে বিষয় নিয়ে হেলাফেলা নয়। শুধু ভ্যাকসিন আনা আর তা দেওয়া এটিই একমাত্র কাজ নয়। করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে বড় কোনো অব্যবস্থাপনার যেন সৃষ্টি না হয় সে জন্য সরকারের প্রস্তুতি যেমন জরুরি তেমনি এ বিষয়ে তথ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রস্তুতিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

লড়াইয়ের দ্বিতীয় পর্বে মাঠে নামার আগে আসুন সবাই নিজের প্রস্তুতি ঝালিয়ে নেই, কারণ এ যুদ্ধটিও হবে দীর্ঘমেয়াদি।

               

                লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর