শিরোনাম
বুধবার, ২০ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

উজ্জ্বল পঞ্চাশে মুস্তাফিজ শফিকে অভিবাদন

সেলিনা হোসেন

উজ্জ্বল পঞ্চাশে মুস্তাফিজ শফিকে অভিবাদন

মুস্তাফিজ শফি মূলত একজন সাংবাদিক। তিনি জীবনের পঞ্চাশ অতিক্রম করেছেন। সাংবাদিকতায়ও অতিক্রম করেছেন জীবনের অর্ধেক। একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি। ক্রমে ক্রমে আজ এ ক্ষেত্রে মুস্তাফিজ শফি বলতে গেলে খ্যাতির বিস্তৃত পরিমন্ডলে। তাঁর কর্মপরিধি অনেক বিস্তৃত। সাংবাদিকতা তাঁর মুখ্য বিষয় হলেও শুধু এর গন্ডিবদ্ধই শফি থাকেননি। কবিতা, কথাসাহিত্য, গান ও গল্প লেখায়ও সমান্তরাল এগিয়ে চলেছেন। বহুমাত্রিক কাজের মধ্য দিয়ে শফি পঞ্চাশেই অর্জনের ঝুলি অনেকখানি পরিপূর্ণ করেছেন। এতগুলো ক্ষেত্রে একসঙ্গে কাজ করা সহজ নয়। বিশেষ করে সাংবাদিকতার মতো পেশায় যুক্ত থেকে অন্য কাজ নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পাদন করা নিশ্চয়ই কঠিন বিষয়। এ কঠিনকেই তিনি সহজ করে তুলেছেন, চলেছেন। তাঁর এ অগ্রযাত্রা নিঃসন্দেহে প্রজন্মের প্রতিনিধিদের কাছে অনুসন্ধানযোগ্য হয়ে থাকবে। কথাসাহিত্য ও কবিতায় দাপুটে বিচরণ তাঁর জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় মনে করি। শৈশবেই তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। নব্বই দশকের কবি শফির কবিতাভান্ডার আজ অনেকখানি সমৃদ্ধ। ‘একাত্তরের বিজয়িনী’ গ্রন্থটি তাঁর অনেক কাজের মধ্যে অনন্য মনে করি। বইটির ভূমিকা আমিই লিখেছি। এ বইয়ের জন্য তিনি পেয়েছেন বেসরকারি মোবাইল অপারেটর রবির সম্মাননা। আমি ওই বইয়ের ভূমিকায় লিখেছি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নারীর জীবন অধ্যয়নের একটি বড় দিক। নারীরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কত বড় সহায়ক শক্তি ছিলেন, তা নানাভাবে বিভিন্ন গবেষক ও ঔপন্যাসিকের লেখায় উঠে এসেছে। এরই ধারাবাহিকতায় ‘একাত্তরের বিজয়িনী’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পর্বের প্রেক্ষাপটে অনন্য একটি দলিল। নারী মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মকাহিনিতে তাদের পরবর্তী জীবনযুদ্ধের চিত্রও উঠে এসেছে, ‘একাত্তরের বিজয়িনী’ গ্রন্থে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও নারী মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে অবদানের যে অধ্যায়গুলো এ গ্রন্থে উঠে এসেছে তা নিঃসন্দেহে ব্যাপকভাবে সঠিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। ‘একাত্তরের বিজয়িনী’ গ্রন্থটি পরিশ্রমলব্ধ সম্পদ। শুধু যুদ্ধক্ষেত্র কিংবা সামাজিক অঙ্গনেই নয়, একাত্তরের মহান পর্বে নারীরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কীভাবে ভূমিকা রেখেছেন সে সবই উঠে এসেছে এ গ্রন্থের পাতায় পাতায়। নানা ক্ষেত্রে, নানাভাবে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের এসব অবদান-ভূমিকা প্রজন্মের প্রতিনিধিদের বিশদভাবে জানার ক্ষেত্রে ‘একাত্তরের বিজয়িনী’ অন্যতম সহায়ক একটি গ্রন্থ হিসেবে চিত্রিত হয়ে থাকবে তা আমার বিশ্বাস। নারীর জীবন এবং নারীর অধ্যয়নকে মেলাতে গিয়ে নারীর জীবনের যে চিত্র প্রতিফলিত হবে এর পরস্পর সংযুক্তি ঘটবে সাহিত্যে। শফি এ কাজটিও খুব নিখুঁতভাবে করেছেন। অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের নারীর জীবন অস্পষ্ট ছায়ার মতো দেখা যায়; যে দেখায় আলো নেই। নারীর জীবন খুঁজে দেখার প্রকৃত চেষ্টা বহু ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। এ সূত্রে বলতেই হবে, ‘একাত্তরের বিজয়িনী’ এরই গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত। শুধু রণাঙ্গনের যোদ্ধাই যোদ্ধা নন।

একাত্তর পর্বে যেসব নারী বিভিন্নভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন তাদের গৌরবের জায়গাটা অনেকেই না দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বুজেছেন। এই নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক তথ্য উঠে এসেছে ‘একাত্তরের বিজয়িনী’ গ্রন্থে। মুস্তাফিজ শফির ‘জিন্দালাশ অথবা রমেশ ডোম’ উপন্যাসটি যেন বাস্তবের স্বচ্ছ আয়না। ২০১৮ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করতে গিয়ে একটি সিরিজ প্রতিবেদনের সূত্রে তাঁর চিন্তায় গ্রোথিত হয় এ উপন্যাসের উপাদান। ডোমেরা আমাদের সমাজে অবহেলিত। সামাজিক ক্ষেত্রে তাদের দেখা হয় ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে। রমেশের ভাষায়, ডোমেরা জিন্দালাশ। আমাদের সমাজে এমন অনেক মানুষ আছেন যারা জিন্দালাশ হয়েই বেঁচে আছেন। দুই রমেশের বর্ণনাসূত্র আর শফির কল্পনাসূত্রের সংমিশ্রণে রচিত ‘জিন্দালাশ অথবা রমেশ ডোম’ উপন্যাসটি পাঠকমন স্পর্শ করতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে করি। মানুষ স্বপ্নের চেয়েও বড়- এ বাক্যটি শুধু নিছক একটি বাক্যই নয় এর ব্যাপকতা অনেক বেশি। স্বপ্নময় জীবন ও সমাজ নির্মাণের আকাক্সক্ষা মানুষকে তাড়িত করে। সমাজ ও জীবনের গন্ডিবদ্ধতা থেকে মুক্তি কিংবা উত্তরণের জন্য স্বপ্ন বড় সহায়ক শক্তি। শফির উপন্যাসটি এ বিষয়ে পাঠকমনে নাড়া দিতে সক্ষম। অনুসন্ধিৎসু মন যে কোনো বিষয়ের গভীরে যেতে চায়। শফি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করতে গিয়ে তা-ই করেছেন এবং এ জন্য তাঁর অর্জনের ঝুলিও পঞ্চাশেই অনেকটা পূর্ণ করতে পেরেছেন। কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন শফি। তিনি একটি জাতীয় দৈনিকের জন্মবেদনার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে দৈনিক সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের গুরুদায়িত্ব পালন করছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর দক্ষতা-যোগ্যতা-দূরদর্শিতার প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন বলেই মনে করি। পত্রিকাটির সঙ্গে লেখালেখির সূত্রে আমারও সম্পৃক্ততা রয়েছে এবং এ জন্যই গভীরভাবে পত্রিকাটি পর্যালোচনা করি এবং এর পৃষ্ঠায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করি। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতামূলক যে কটি গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার রয়েছে তার অনেকটাই শফি অর্জন করেছেন। নব্বইয়ের দশকে লেখালেখিতে গভীর মনোনিবেশ করে অল্প সময়েই খ্যাতির বিস্তৃত সীমানায় নাম লিখেয়েছেন তিনি। এটাই তাঁর বড় অর্জন। সবশেষে বলব, সাহিত্য ক্ষেত্রে তাঁর শক্ত অবস্থান থাকলেও তিনি আমাদের মাঝে বিশেষভাবে পরিচিত একজন সাংবাদিক হিসেবে। তাঁর কর্মজীবনের শুরু যেহেতু এ মাধ্যমে সেহেতু এর গুরুত্বটা সব সময়ই আলাদা হয়ে থাকবে। তবে সাংবাদিক পরিচয়ের দরুন তাঁর কবি-ঔপন্যাসিক-গীতিকার পরিচয়ও আড়ালে যে থাকবে না এও তো ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়ে গেছে। তাঁর সামনে আরও বিস্তর সময় পড়ে আছে। নিশ্চয় শফি এই সময়ে নিজেকে আরও বেশি বিকশিত করতে সক্ষম হবেন। মৌলিক লেখালেখির ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে তাঁর যে আলাদা স্থান তৈরি হয়েছে তা আরও পুষ্ট হোক। শফি, আপনার জীবনের সব ক্ষেত্র, সব স্তর সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হোক। সব ক্ষেত্রেই থাকুন স্বকীয়। ‘উজ্জ্বল পঞ্চাশ’ পরবর্তী সময়ে আরও উজ্জ্বল হোক।

                লেখক : কথাসাহিত্যিক।

সর্বশেষ খবর