শুক্রবার, ২২ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

আদালতের পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশ ব্যাংক

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা নিজেদের স্বার্থে ঠগ, প্রতারক ও অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন মর্মে সম্প্রতি হাই কোর্ট মন্তব্য করেছে। তফসিলি ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তত্ত্বাবধানের আইনগত অভিভাবক হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক আইন দ্বারা আরোপিত দায়দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করায় ব্যাংক ও আর্থিক খাতের জালিয়াতি, দুর্নীতি, অর্থ তছরূপ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। দায়িত্বে অবহেলার কারণে আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতে সৃষ্ট বিপর্যয়ের জন্য দায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় আনা জরুরি বলেও হাই কোর্ট মন্তব্য করেছে। বিদেশে পালিয়ে থাকা প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদার ও তার সহযোগীরা বিআইএফসি থেকে কী পরিমাণ টাকা নিয়েছেন তা নির্ধারণের জন্য একটি স্বতন্ত্র নিরীক্ষক কোম্পানি নিয়োগের নির্দেশনা চেয়ে একটি বিদেশি অংশীদারি প্রতিষ্ঠানের করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উল্লিখিত পর্যবেক্ষণ দিয়েছে হাই কোর্ট। আদালতের এমন পর্যবেক্ষণ সঠিক বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গর্ভনর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ উল্লেখ করেছেন। রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে নামে-বেনামে অনেক প্রতিষ্ঠানের মালিকানা ও কর্তৃত্ব পেয়েছিলেন। তবে কাগজে-কলমে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় আছেন প্রশান্ত কুমার বা পি কে হালদারের মা, ভাই, বান্ধবী ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন। এমনো হয়েছে যে তাদের এক প্রতিষ্ঠানের যা দায় অন্য প্রতিষ্ঠানের তা-ই সম্পদ; তাদেরই এক কোম্পানি ক্রেতা, আরেক কোম্পানি বিক্রেতা। এর মধ্যে পিপলস লিজিং এখন বিলুপ্তির পথে, বাকি কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানও গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমদের মতে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি থাকলে একজন ব্যক্তি এতগুলো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারতেন না। পি কে হালদারের মা, ভাই, বান্ধবী, আত্মীয়স্বজন, তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও তার নিজের ব্যাংক হিসাবে কোটি কোটি টাকা পাওয়া গেছে। এসব অস্বাভাবিক জমা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংককে রিপোর্ট করার কথা, এসব অস্বাভাবিক লেনদেন সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যাখ্যা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকেরও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। তবে আদালত দুটি প্রতিষ্ঠানের মালিকানা হস্তান্তর নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্পর্কে যে কথাটি উল্লেখ করেছে তা সুষ্ঠু আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মারাত্মক অন্তরায়। আদালতের অভিমত অনুযায়ী পিপলস লিজিং আর বিআইএফসির মালিকানা পরিবর্তনে প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মালিকানা পরিবর্তনে যদি প্রতিষ্ঠান দুটির উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি ঘটত বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন সহায়ক ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠত না। মালিকানা হস্তান্তর অবশ্যম্ভাবী করে তুলতেও নাকি বাংলাদেশ ব্যাংক পরোক্ষভাবে কাজ করেছে।

মালিকানা হস্তান্তরের পর প্রতিষ্ঠান দুটি থেকে পি কে হালদার নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। পিপলস লিজিংয়ের পরিচালক পর্ষদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বচ্ছতা না থাকলে তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের একজন পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছিল বলে জানা যায়। পর্যবেক্ষক যদি সত্য ঘটনা রিপোর্ট করে থাকেন এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যদি রিপোর্ট মোতাবেক ব্যবস্থা নেন তাহলে পি কে হালদারের এত অপরাধ করার সুযোগ পাওয়ার কথা নয়। তা ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়মিত পরিদর্শন হয়। ক্যাসিনো ঘটনার বিষয়টি তদন্ত করতে গিয়ে দুদক প্রথম পি কে হালদারের কিছু অপরাধ জানতে পারে। প্রায় ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। কিন্তু দুদক জানার আগে তো বাংলাদেশ ব্যাংকের জানার কথা।

বিগত কয়েক বছর যাবৎ বিভিন্ন কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত দেশের ব্যাংকিং খাত। বর্তমান সরকারের আমলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃতিত্বের পাল্লা ভারী হলেও ব্যাংকিং জগতের আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা সরকারের ভাবমূর্তি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। হলমার্ক, ক্রিসেন্ট গ্রুপ, বিসমিল্লাহ কেলেঙ্কারি ব্যাংকিং জগতের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশ্রয়ে একসময়ের ‘শক্তিশালী’ বেসিক ব্যাংকটির নাজুক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের তৎকালীন চেয়ারম্যানের ক্ষমতা সম্পর্কে সৃষ্ট ইমেজের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক দীর্ঘদিন এ ব্যাংকের অনিয়মের স্তূপ নিয়ে চুপচাপ ছিল, ঘাঁটাতে সাহস করেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের ইমেজ নষ্ট শুরু হয়েছে ডেপুটি গভর্নর নিয়োগে সার্চ কমিটি গঠনের পর। তখন থেকেই ডেপুটি গভর্নর হওয়ার জন্য প্রার্থীদের অনেকে ব্যবসায়ীদের কাছে ধরনা দিতে শুরু করেন। বার্ষিক গোপনীয় রিপোর্টের ভিত্তিতে পদোন্নতি পেয়ে সচিব, সিনিয়র সচিব হতে পারলে নিচু পদমর্যাদার ডেপুটি গভর্নর নিয়োগে সার্চ কমিটি গঠনের যৌক্তিকতা স্পষ্ট নয়। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বা বিভিন্ন করপোরেশনে নির্বাহী প্রধান নিয়োগেও সার্চ কমিটি নেই; এমনকি গুরুত্বপূর্ণ পদ গভর্নর নিয়োগেও সার্চ কমিটি নেই।

আর্থিক অপরাধের বিচার না হওয়ায় সবাই অনিয়মে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে, সংক্রামক ব্যাধির মতো এ অনিয়ম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার প্রত্যাশায় অর্থনৈতিক দুর্বৃত্ত ও অপরাধীদের প্রশ্রয় দেয়, পুষে রাখে- আদালতের এমন পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভাবমূর্তি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুদক থেকে একবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের লাগামহীন অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে অভিযোগ উঠলে জবাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান দুর্নীতি দমন কমিশনের দুর্নীতির প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করেছিলেন। সব প্রতিষ্ঠানই নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করে, পরিষ্কার-পরিশুদ্ধভাবে।

ডিপোজিটরদের অর্থ আত্মসাতে ঠগ ব্যবসায়ী ও প্রতারকরা যাতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রশ্রয় না পায় সে বিষয়ে সচেষ্ট থাকতে পরিশেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে আদালত প্রত্যাশা করেছে। সরকারের কোনো সেক্টর যখন স্বাভাবিক মেকানিজমে কাজ করে না, দৃশ্যমান অনিয়মে সবাই অভ্যস্ত হতে হতে নিয়মাচার প্রতিষ্ঠায় কারও মাথাব্যথা থাকে না তখন বোধহয় আদালত অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীর আরও বেশি সংশ্লিষ্টতা ও সক্রিয়তা আশা করে।

লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক বাংলাদেশ ব্যাংক ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন।

সর্বশেষ খবর