সোমবার, ২৫ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

অদেখা জীবনের নির্মম কষ্টটাই শিক্ষা

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

অদেখা জীবনের নির্মম কষ্টটাই শিক্ষা

জীবন থেকে প্রতিদিন আমরা শিখছি। তবে জীবনের ভিতরটাতে প্রবেশ করা এতটা সহজ নয়। বরং খুব কঠিন। খুব দুর্বোধ্য। যেটা চোখে দেখা যায় না, মন দিয়ে বোঝা যায় না। একটা অদেখা অনুভূতির না বোঝা অতিমানবীয় চশমা দিয়ে দেখতে হয়। ফুল থেকে বিন্দু বিন্দু মধু আহরণ করে মৌমাছি মৌচাকটা গড়ে তোলে। মৌমাছি একটা ঘর পায়। রাজা-রানী-প্রজার সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। কিন্তু ফুল জীবন থেকে যা হারায় তা আর কখনো ফিরে কি পায়? সে হারানোর কষ্টটা ফুল যতটা বোঝে মানুষ কি ততটা বুঝতে পারে? আবার মৌমাছির বিন্দু বিন্দু ঘামে গড়া মৌচাকটা ভেঙে মানুষ সেখান থেকে মধু বের করে আনে। মানুষ এ ঘর ভাঙতে গিয়ে আত্মরক্ষার আবরণ নেয়। হয়তো আমাদের চোখে সেটা আত্মরক্ষার আবরণ। কিন্তু সেটাকে যদি মুখোশ বলি তাতে কি অতিরঞ্জিত কিছু বলা হবে? মানুষ হাতে আগুন নেয়, একটা অসহিষ্ণু মন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘর ভাঙার আনন্দে। মৌমাছির ঘর ভাঙার কষ্টটা মৌমাছি যতটা বোঝে মানুষ কি ততটা বোঝে? এভাবে কষ্ট একটা থেকে আরেকটায় রূপান্তরিত হয়। ফুলের মতো মানুষেরও এমন কষ্টটা আমরা কি কখনো খুঁজে দেখি। মৌমাছির আর্তনাদহীন বোবাকষ্টটা কি আমরা কখনো বুঝে উঠতে পারি? অবুঝ মনের বোধশক্তির চিন্তা দিয়ে তাকে কি ধরতে পারি? হয়তো কেউ বলবে এটা ফুলের কষ্ট নয়, ফুলের ত্যাগ। মৌমাছির মৌচাক হারানোর কষ্ট নয়, মৌমাছির ত্যাগ। প্রকৃতির অলৌকিক ভারসাম্যের সংঘাত-সমঝোতা-অমীমাংসিত রহস্যের সমাধান। অনেকটা অঙ্কের মতো। যার একটা উত্তর থাকে কিন্তু কখনো জীবনের সমীকরণ দিয়ে সেটা মেলানো যায় না।

পেঙ্গুইনের কথা মনে পড়ে গেল। সম্প্রতি বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী ‘বায়োলজি লেটার্স’-এ প্রকাশিত গবেষণায় বলা হচ্ছে, মানুষের মতো পেঙ্গুইনও একে অন্যের সঙ্গে ভাব বিনিময়ে একই রীতি অনুসরণ করে। মানুষ কথা বলার সময় দুটি রীতি অনুসরণ করে। একটি হলো সাধারণত ছোট ছোট শব্দ দিয়ে কথা বলা। আরেকটি হলো কথা বেশি বলার সময় আরও ছোট ছোট শব্দ ব্যবহার করা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, পেঙ্গুইনও নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময় এ নীতিই ব্যবহার করে। বিজ্ঞানবিষয়ক জার্নাল কারেন্ট বায়োলজিতে আরেকটি গবেষণায় বলা হয়েছে, ম্যাগলানিক প্রজাতির মেয়ে পেঙ্গুইনরা খাবারের খোঁজে পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি হারে উত্তরের দিকে মাইগ্রেট বা অভিবাসী হচ্ছে। আর তা করতে গিয়ে পুরুষ পেঙ্গুইনের চেয়ে তিন গুণ বেশি মেয়ে পেঙ্গুইন আহত হচ্ছে বা মারা পড়ছে। পেঙ্গুইন নিয়ে এগুলো গবেষণার ফল। তবে গবেষণার বাইরেও অদেখা মানবিক বোধের সম্পর্কের খোঁজ করাটা খুব কঠিন। কারণ এ বোধটা এতটাই গভীরে থাকে যে সে গভীরের গভীরতায় সবার পক্ষে ঢোকাটা সম্ভব নয়। এ অভূতপূর্ব দুর্লভ শক্তিটা সবার মধ্যে থাকে না। যদি থাকত তবে তা মৃতপ্রায় জনপদে আবার বসতি গড়ার মতো বিস্ময়ের হতো। খরায় মাটি ফেটে চৌচির জনপদে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ার মতো হতো। লেখাটা গার্ডিয়ানে এসেছিল। জো পেরেরা, ব্রাজিলের একজন খেটে খাওয়া দিনমজুর। সারা দিনের কঠিন জীবনযুদ্ধের সঙ্গে লড়তে গিয়ে তার তেলতেলে শরীর থেকে নুয়ে পড়ত কষ্টের ছোট ছোট ঘাম। সেটা যখন কঠিন মাটিতে পড়ত মাটিও যেন মহাসমুদ্র হয়ে যেত। একদিন কাজ থেকে ফেরার পথে জো পেরেরার চোখটা গিয়ে পড়ল একটা পেঙ্গুইনের দিকে। সমুদ্রতটে আটকে পড়া পেঙ্গুইনটা অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় ছটফট করছিল। পাখিটার জন্য পেরেরার বুকটা ধকধক করে উঠল। একটা মায়া এসে শেল বিদ্ধ করল পেরেরার বুকের ভিতরের অদেখা পৃথিবীকে। একজন সাধারণ দিনমজুর। কাঁধের পেছনে ঝুলছে না বড় বড় ডিগ্রির কাগজের মহামূল্যবান সার্টিফিকেট। কিন্তু মহামূল্যবান তার একটা মন ছিল, সেখানে কাগজের সার্টিফিকেটের কোনো মূল্য নেই। পেরেরা না জানে পরিবেশসংক্রান্ত বড় বড় থিউরি, না জানে প্রাণী সংরক্ষণের বিজ্ঞানসম্মত জটিল প্রক্রিয়া। জানে কেবল প্রাণ দিয়ে প্রাণকে ভালোবাসতে। মায়ার অদৃশ্য টানে পেরেরা পেঙ্গুইনটিকে তার বাসায় নিয়ে আসেন। টানা আট মাসের পরিচর্যায় পেঙ্গুইনটিকে সে সুস্থ করে তোলেন। যে পেঙ্গুইন জলের প্রাণী, কি এক দুর্বোধ্য সম্পর্কের টান পেঙ্গুইনটি যে ডাঙায় আছে তাকে কখনো বুঝতেও দেয়নি। মানুষ ও প্রাণীর মধ্যে একটা ঝাপসা ঝাপসা কিন্তু খুব গাঢ় একটা সম্পর্ক কখন যে জীবনের সম্পর্কের ভিত্তি গড়ে দিয়েছে তা বোধহয় কেউ বুঝে উঠতে পারেনি। চোখের জলে জো পেরেরা পাখিটিকে বিদায় জানালেও প্রাণের টান কোথায় যেন একটা খোদাই করা পাথরে জীবনের না বোঝা কবিতা লিখেছিল। এর পরে কেটে গেছে একটি বছর। কাজ থেকে ফেরার পথে জো পেরেরার চোখের সঙ্গে একটা পেঙ্গুইনের চোখ পড়ে। পেরেরাকে অনুসরণ করে হাঁটতে থাকে পেঙ্গুইনটা। হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে তার বাড়িতে। বিস্মিত পেরেরা। চোখ যেন মাথায় ওঠে। এটা তো সেই পেঙ্গুইন যাকে সে সারিয়ে তুলেছিল। পৃথিবীতে মানুষ স্বার্থপর হয়। অকৃতজ্ঞ হয়। কিন্তু পেঙ্গুইনের মতো প্রাণীরা হয় না। এখানেই বুঝি মানুষ আর প্রাণীর পার্থক্য। এখানেই বুঝি মানুষের সঙ্গে জড়বস্তুর পার্থক্য। এরপর প্রতি বছরই প্রায় ৫ হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে পেঙ্গুইনটি জো পেরেরার কাছে আসে। কয়েক মাস সময় কাটায়। তারপর ফিরে যায়। এটা সম্পর্কের টান না অন্য কিছু তা হয়তো বিজ্ঞান জানে না। দর্শন জানে না। মনস্তত্ত্ব জানে না। কোনো কাব্য, মহাকাব্যও জানে না। হয়তো পেরেরা আর পেঙ্গুইনটাও জানে না। তবে না জানা থেকে যা শেখা যায় জানার থেকে তা শেখা যায় না। রহস্যটা এখানেই। যেটা বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল রহস্যের মতো কিনা জানি না। তবে কিছু তো একটা আছে যা সামনে থেকে মানুষ দেখতে পায় না। পেছন থেকেও দেখে না। মন থেকেও দেখে না। কিন্তু একটা দাগহীন চিহ্ন অস্তিত্বের কোথায় যেন বড়শিতে হেচকা টানের মতো থেকে যায়। একটা কথা অনেক দিন থেকেই বলা হচ্ছে, বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে নাকি জাহাজ, নৌকা বা আকাশপথে যাওয়ার সময় উড়োজাহাজ রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে যায়। তার আর কখনো খোঁজ মেলে না। কেউ বিজ্ঞান দিয়ে একে ব্যাখ্যার চেষ্টা করেন। কেউ এগুলোকে নিছক দুর্ঘটনা হিসেবে দেখেন। আর কেউ কেউ একে পত্রপত্রিকার ষড়যন্ত্রতত্ত্ব হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেন। কারণ তারা মনে করেন পত্রপত্রিকা তাদের কাটতি বাড়ানোর জন্য সবটাতেই রহস্যের গন্ধ খুঁজে বেড়ায়। সব রহস্য হয়তো রহস্য নয়, তবে কিছু একটা বোধ কেমন যেন মানুষকে অদেখা একটা পৃথিবী দেখানোর জন্য তাড়িয়ে বেড়ায়। সেখানে যতটা শেখা যায় ততটাই হারানোর ভয় থাকে। অন্তর্যামী সব জানেন। সব কি রহস্য না কৌতুক। রবীন্দ্রনাথের কবিতাটা কানে এসে ধাক্কা দিল এভাবেই-

এ কি কৌতুক নিত্য-নুতন

ওগো কৌতুকময়ী!

আমি যাহা কিছু চাহি বলিবারে

বলিতে দিতেছ কই?

অন্তর মাঝে বসি অহরহ

মুখ হতে তুমি ভাষা কেড়ে লহ,

মোর কথা লয়ে তুমি কথা কহ

মিশায়ে আপন সুরে।

সে মায়া মুরতি কি কহিছে বাণী!

কোথাকার ভাব কোথা নিলে টানি!

আমি চেয়ে আছি বিস্ময় মানি’

রহস্যে নিমগন!

জীবনটা যদি একটা কৌতুক হয় তবে যেটা হাসায় সেটা কৌতুক নয়, যেটা কাঁদায় সেটাই কৌতুক। মানুষ যখন কাঁদে মানুষ তখন জীবনবোধের পেছনের দরজা বন্ধ করে খোলা জানালা দিয়ে শেখে। উইলিয়াম শেকসপিয়র বলতেন, ‘অভাব যখন দরজায় এসে দাঁড়ায়, ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়।’ জার্মান কবি গ্যেটে শেকসপিয়ার সম্পর্কে বলেছিলেন, ঘড়ির অন্তরকে ভালো করে জানতে হলে শুধু কাচটি সরিয়ে ডায়াল পরীক্ষা করলে চলে না, ডায়ালের নিচে কলকব্জা পরীক্ষা করতে হয়। শেকসপিয়র তেমনিভাবে মানুষের অন্তর্লোক পর্যন্ত দেখে নিয়েছিলেন।

তবে কিছু লেখা ঘেঁটে পেলাম : ‘শেকসপিয়রের নাটক, সনেট আর কবিতার বাইরে তাঁকে জানার খুব বেশি সুযোগ নেই। আরেকটি সূত্র হচ্ছে গির্জা এবং কোর্টের নথিপত্র। তাই অনেকেই প্রশ্ন তোলেন যে সাহিত্যকর্মগুলোর জন্য শেকসপিয়র এত সমাদৃত সেগুলো হয়তো আদতে তাঁর হাতে লেখাই হয়নি। শেকসপিয়র কেবল স্কুলে কিছু দিন পড়াশোনা করেছিলেন। এ রকম একজন মানুষের পক্ষে এমন সব সাহিত্যকর্ম সম্ভব নয়।’ যে লেখাগুলো আমরা বলছি শেকসপিয়রের সে লেখা নাকি তার অন্যের রচনা তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে। একটা সন্দেহের তীর। সেটা বুকটাকে একটু আঘাত হয়তো করল। সেটা যদি মিথ্যা হয় তবে ওথেলো, ম্যাকবেথ, হ্যামলেট, রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট এগুলোর ভাগ্যে কী আছে কে জানে। যেমন রোমিও ও জুলিয়েটের ভাগ্যটা তারা বুঝে ওঠেনি, সময় বুঝেছে। রোমিওকে মনপ্রাণ উজাড় করে ভালোবাসত জুলিয়েট। তবে জুলিয়েটের বাবা এতে বাদ সাধলেন। কাউন্ট প্যারিসকে বিয়ে করার জন্য জুলিয়েটের ওপর চাপ দিলেন। একজন নারী। কতক্ষণ এ মনস্তাত্ত্বিক লড়াইটা করবে সে জানে না। জুলিয়েট গোপনে সন্ন্যাসীর কাছে গিয়ে পরামর্শ চাইলেন। সন্ন্যাসী বললেন, ‘বাবার অবাধ্য হয়ো না। আমি তোমাকে একটা ওষুধ দিব যা খেলে মনে হবে তুমি মরে গেছ। তবে সেটা মনে হলেও আসলে তুমি মরবে না। ওষুধের প্রতিক্রিয়া শেষ হলে তুমি আবার জীবিত হয়ে উঠবে।’ জুলিয়েট ওষুধটা খেয়ে ফেলল। নিথর দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। সবাই ভাবল সে মারা গেছে। শত্রু নিধনের পর রোমিও প্রবেশ করল জুলিয়েটের সমাধি ক্ষেত্রে। কিন্তু রোমিওর তো জুলিয়েট হারিয়ে গেছে। আছাড়ি-বিছাড়ি খেল রোমিও। জুলিয়েটের পাশে ওষুধ দেখে ভাবল জুলিয়েট তাকে না পেয়ে আত্মহত্যা করেছে। রোমিও সেই বিষাক্ত ওষুধ তার নিজের মুখে ঢেলে দিল। মৃত্যু হলো রোমিওর। ওষুধের প্রতিক্রিয়া শেষ হলে জুলিয়েট প্রাণ ফিরে পেল।

কিন্তু হায়, তার প্রাণের প্রাণ রোমিও যে আর নেই। কী হবে আর তার বেঁচে থেকে। রোমিওর কোমরের খাপ থেকে ছোরাটা বের করে সজোরে নিজের বুকে বসিয়ে দিল জুলিয়েট। দু-এক বার ছটফট করে চিরকালের মতো নিশ্চল হয়ে গেল তার দেহ। এটা কি ট্র্যাজেডি? এটা কি কৌতুক না অদেখা কিছু? যেখানে সব বোঝা কঠিন। তার পরও অনেক অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর খোঁজা। খুঁজতে গিয়ে শেখা। হয়তো এমন করেই শিখতে গিয়ে যেটা শেখা হয় না সেটাই শেখা হয়ে যায়।

লেখক : শিক্ষক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।

সর্বশেষ খবর