সোমবার, ২৫ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

অবসর নারীর অবসরের জীবন

রওশন আরা কবীর

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ প্রবীণ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অসাধারণ সাফল্যে বর্তমান বিশ্বে মানুষ প্রায় ১২০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকেন। জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা অনুযায়ী ৬০ বছর অথবা তার অধিক বয়সের নারী-পুরুষ প্রবীণ বলে গণ্য হবেন। বাংলাদেশ সরকারের মহামান্য রাষ্ট্রপতি ২০১৪ সালে ৬০ বছর বয়স হলেই প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে ‘সিনিয়র সিটিজেন’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। গত ১৫ জুন ছিল বিশ্ব প্রবীণ দিবস, অর্থাৎ বিশ্ব প্রবীণ নির্যাতন প্রতিরোধে সচেতনতা দিবস। মনে রাখা প্রয়োজন আজকে যারা নবীন তারাই কিছুদিন পর প্রবীণে পরিণত হবে। আজকের এ সুন্দর সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতার সুনিপুণ কারিগরই ছিলেন প্রবীণ জনগোষ্ঠী। প্রবীণ নারী-পুরুষের মেধা, মনন ও কর্মময় জীবনের অবদান, অভিজ্ঞতা, সমাজ ও সভ্যতার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই নারী। তাই অর্ধেক নারী জনগোষ্ঠীকে অবহেলিত ও বিচ্ছিন্ন রেখে কোনো দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই নারী ও পুরুষ কাজ করে আসছে। চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী নারীরা ঘরে আর পুরুষরা বাইরের জগতে। অতীতে নারীরা শুধু স্বামী, সন্তান, শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ, দেবরের সেবাযত্ন, রান্না-বান্না এবং যাবতীয় কাজ করার দায়িত্বেই নিয়োজিত ছিল। তবে সভ্যতার উন্নতি ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নারীরা এখন শহর অথবা গ্রামেই বলুন না কেন পুরুষের মতো সব ধরনের কাজেই সমান দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। তারা শুধু বধূ, মাতা, কন্যার ভূমিকাই পালন করেন না বরং সমাজের কাজ, রাষ্ট্রের কাজ এমনকি মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বৈজ্ঞানিক, মন্ত্রী, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও প্রশাসনিক কর্মকা-ে প্রতি ক্ষেত্রে ও প্রতিষ্ঠানেই পুরুষের মতোই কাজ করে সুনাম অর্জন করেছেন। তবে অত্যন্ত দুঃখের বিষয় অপ্রিয় হলেও সত্যি যে, একজন নারী অবসর গ্রহণ করে পরিবারে স্থায়ীভাবে ফিরে এলে পুরুষের মতো সমান মর্যাদা, সহানুভূতি ও সুন্দর জীবন, স্বাধীন-জীবন কাটানোর সুযোগ পায় না। পরিবারে কর্তাব্যক্তি যখন তার কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন, তখন তার সেবা-যত্নের জন্য সবাই ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। আনন্দ প্রকাশ করেন। কর্তা বাবাটি মন খারাপ করার সুযোগই পান না। কিছুদিন পরই দেখা যায় তিনি কোনো সমাজ সেবামূলক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিজেকে নিয়োগ করেছেন এবং সারা দিন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে অথবা আর এতদিনের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা অনুযায়ী কোনো প্রতিষ্ঠানে চুক্তিভিত্তিক কাজ করছেন। তার অবসর জীবনের হতাশা ও গ্লানি তাকে স্পর্শও করতে পারে না। এবার তবে শুনুন দুঃখ ও কষ্টের বিষয় হলেও এটাই বাস্তব যে একইভাবে কোনো পরিবারের গৃহিণী যখন তার বাইরের কর্মস্থলে থেকে অবসর নিয়ে স্থায়ীভাবে পরিবারে বসবাস করেন, তখন কিন্তু বাড়ির সদস্যরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে না। বরং স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এই ভেবে যে, স্ত্রী বা মা যেই হোক না সারাদিন বাড়ি থাকবেন, ভালো রান্না হবে, নাস্তা হবে, সংসারের যাবতীয় কাজ মায়ের ওপর ছেড়ে দিয়ে সবাই নিশ্চিত হবে। অবসরের নারীটি এতদিন তবুও নির্দিষ্ট কতগুলো ঘণ্টা বাইরে ভিন্ন ধরনের কাজে নিয়োজিত থাকত। ভিন্ন একটা পরিবেশ উপভোগ করত। এবার সারা দিন বাড়ি থেকে যাবতীয় সব কাজই হয়তো অবসরের নারীকে একাই সামলাতে হয়। যৌবনে যত বড় চাকরিই করে থাক না কেন যত বেশি অভিজ্ঞতা অর্জন করে আনলেও তার সদ্ব্যবহার করার সুযোগ সবাই পায় না। অথবা পুরুষের পাশাপাশি অবসর নারীদের সুব্যবস্থাও কেউ করে না। তাই বহু সময়েই দেখা যায় অবসর নারীর অভিজ্ঞতা বাক্সবন্দী করাই থেকে যায়। অবসর জীবনে নাতি-নাতনিরা আসে নানুর কাছে জিন-ভূতের আজগুবি গল্প শুনতে। তারা মনে করে, নানুরা বর্তমান যুগের ধ্যান-ধারণা ও জ্ঞান সম্পর্কে কি আর জানবে। তবে নবীনদের ভুলে গেলে চলবে না যে, প্রবীণ ও অবসরের নারীরা এত যুগের অভিজ্ঞতার দিক থেকে কম অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান অর্জন করেননি। অবশ্যই মনে রাখতে হবে অবসরের নারীর অভিজ্ঞতার দিক থেকে বর্তমানের বড় বড় পন্ডিত ও বিশেষজ্ঞদের চেয়ে কম অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান অর্জন করেননি। বিশেষ করে গ্রামগঞ্জে বয়স্ক অনেক নারী এখনো চরমভাবে অবহেলিত, লাঞ্ছিত। হয়তো অনেক নারীর অবসরের দিনগুলো কাটে অনাদর ও অবহেলায়, রোগে শোকে আক্রান্ত অবসরের নারীকে কষ্টসাধ্য কাজ করতে বাধ্য করা হয়। নাতি-নাতনিদের স্কুলে আনা নেওয়া করা, বাড়ি পাহারা দেওয়া, রান্না-বান্না করা, এ ধরনের অনেক কাজ তার ইচ্ছার বিরুদ্ধেও চাপিয়ে দিতে চায়। কিসে তার একটু আরাম হবে কি কাজ করতে অবসরে নারীরা পছন্দ করেন বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন। তা একটু অনেক পরিবারের সদস্যরা চিন্তা করেন না। অবসর জীবনে একটু ঘুরে বেড়ানো, লেখালেখি করা, বাগান করা, আবার কেউ হয়তো ভালো ভালো রান্না মাঝে মধ্যে করতে পছন্দ করেন। তার স্বাস্থ্যের, শরীরের খোঁজ নেওয়া, সঠিক সময়ে চিকিৎসা করা। কিসে স্বাস্থ্য রক্ষা হবে, কি করলে আনন্দে ও উৎফুল্ল থাকবেন। এসব বিষয়ে নবীন সদস্যদের উদাসীন থাকা উচিত নয়। কারণ একদিন তাদেরও বার্ধক্য আসবে, প্রবীণ হবে। অনেক পরিবারে হয়তো অবসরের নারীকে বাড়ির বারান্দায় ছোট একটি কক্ষে অথবা চিলেকোঠায় থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। প্রবীণ নারী-পুরুষ অর্থাৎ অবসরের জীবন কাটানো জনগোষ্ঠী যানবাহনের ভাড়া ও চিকিৎসা খাতের খরচ ৫০ শতাংশ মওকুফ করার ঘোষণা দিয়েছেন।

পিতা-মাতার যদি একাধিক সন্তান থাকে তাহলে সন্তানরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে ঠিক করবে পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ কীভাবে করবে, কে কার সঙ্গে থাকবে। তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোথাও পাঠানো যাবে না। কিংবা বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসা যাবে না। তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করলে, আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। মাতা-পিতার ভরণ-পোষণ না করলে, সেই মাতা-পিতা আদালতে অভিযোগ করলে সন্তানদের এক লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। অর্থ অনাদায়ে তিন মাস পর্যন্ত কারাদন্ড হতে পারে। কিন্তু পরিতাপ বা দুঃখের বিষয় যাই বলা হয় না কেন কতজন পিতা-মাতাই আদালতে যান তার সন্তানদের বিরুদ্ধে নালিশ করতে, বিচার চাইতে। শত অবহেলা, অত্যাচার সহ্য করেও বলে আমার সন্তানরা সুখে থাক। নবীন যুবসমাজই পারে সবকিছু সঠিক পথে পরিচালনা করতে, মূল্যায়ন করতে নারী সমাজ আপনি আমি দেখে যেতে না পারলে মনে রাখবেন, সেদিন বেশি দূরে নয়, হয়তো সেদিন নবীনরা প্রবীণদের মর্যাদা দিবে তাদের অনুসরণ করবে। সমাজকে মনে রাখতে হবে-‘নবীনদের শক্তি আর প্রবীণদের যুক্তি/তবেই হবে দেশমাতৃকার মুক্তি।’

লেখক : সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ বেতার।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর