বুধবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

মৃত্যুঞ্জয়ী কর্নেল (অব.) শওকত আলী

হাসান-উজ-জামান

মৃত্যুঞ্জয়ী কর্নেল (অব.) শওকত আলী

১৯৩৭ সালের ২৭ জানুয়ারি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার লোনসিংহ বাহের দিঘির পাড় গ্রামে জন্ম নেন জাতীয় বীর কর্নেল (অব.) শওকত আলী। ১৯৭৫ সালে জাতির জনকের নির্মম হত্যাকান্ডের পর যখন ধরে নেওয়া হতো সেনাবাহিনী মানেই বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগ বিদ্বেষী, ওই চরম দুঃসময়ে আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত ফাঁসির মঞ্চ থেকে ফিরে আসা কর্নেল (অব.) শওকত আলী রাজনৈতিক মঞ্চে আবির্ভূত হন। ১৯৭৭ সালে আওয়ামী লীগে যোগদান করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের মনে আশার আলো প্রজ্বালিত করেছিলেন। প্রসঙ্গত, পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রিত প্রচারমাধ্যম যেটিকে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করে দমিয়ে রাখার সুদূরপ্রসারী চক্রান্তে নেমেছিল সেটির প্রকৃত নাম ছিল ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য’ মামলা। ওই মামলার অভিযুক্ত সবার আশু উদ্দেশ্য ছিল সশস্ত্র পন্থায় পাঞ্জাবি শাসক গোষ্ঠীর কোপানল থেকে জাতিকে মুক্ত করে বাঙালি জাতির নিজস্ব আবাসভূমি সৃষ্টি তথা বিশ্বমানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। তার রাজনৈতিক গ্রন্থ ‘সত্য মামলা আগরতলা’ গ্রন্থে তিনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের গোপন অথচ ব্যাপক প্রস্তুতির কথা উল্লেখ করেছেন, যা ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম প্রস্তুতি।

যেহেতু শওকত আলী ছাত্রজীবন থেকেই ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং বঙ্গবন্ধুর মতাদর্শে দীক্ষিত তাই স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সেনাবাহিনীতে যোগদান করে এ বাহিনীর পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু খুনি মোশতাক-জিয়া নিয়ন্ত্রিত সেনাবাহিনী থেকে ১৯৭৫ সালের ২৩ অক্টোবর স্বাভাবিক কারণেই চাকরিচ্যুত হন। ফলে আদর্শিক কারণে ১৯৭৭ সালে আওয়ামী লীগে যোগদানের মধ্য দিয়ে জনকল্যাণে আত্মনিয়োগ করেন।

সামরিক স্বৈরাচার জিয়ার শাসনামলে তদানীন্তন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জিয়ার তলপিবাহকে পরিণত হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত ও কলঙ্কিত করার চেষ্টায় লিপ্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার প্রতিবাদে নৈতিক দায়বদ্ধতা থেকে কর্নেল (অব.) শওকত আলীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ (মুসপ), কর্নেল (অব) শওকত আলীর নেতৃত্বে মুসপ সিদ্ধান্ত নেয়, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চৈঃস্বরে উচ্চারণের পাশাপাশি আমাদের শুভেচ্ছা বিনিময়ের মাধ্যম হবে জয় বাংলা, যা করমর্দনের সময়, আলিঙ্গনের সময়, সহযোদ্ধাদের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় সমস্বরে ও উচ্চকণ্ঠে উচ্চারিত হতো। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণেই মুসপ থেকে প্রথম জোরালোভাবে জাতির জনকের হত্যার বিচারের পাশাপাশি মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী তথা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি উত্থাপিত হয়। কর্নেল (অব.) শওকত আলীর উদ্যোগের কারণে তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংগঠন থেকে যুদ্ধাপরাধীদের মুখোশ উন্মোচনের লক্ষ্যে প্রকাশিত হয় ‘একাত্তরের দালালেরা যা বলেছে যা করেছে’ এবং ‘একাত্তরের দালালেরা কে কোথায়’। এ দুটি প্রকাশনা জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়ন তথা শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্নের লক্ষ্যে গঠিত ট্রাইব্যুনালের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।

কর্নেল (অব.) শওকত আলী তাঁর ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনে মাত্র ৩৯ জনের মধ্যে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং মোট ছয়বার তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। অভাবনীয় জনপ্রিয়তার কারণে প্রতিটি নির্বাচনেই এলাকাবাসী (শরীয়তপুরের নড়িয়া ও পরবর্তীকালে নড়িয়া-সখীপুর নিয়ে গঠিত নির্বাচনী এলাকা) তাঁকে সমর্থন জুগিয়েছে। জাতির জনকের সঙ্গে তিনি আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত (২৬ নম্বর) না হলে পাকিস্তান আমলে তাঁকে ক্যাপ্টেন থাকাকালে চাকরিচ্যুত ও কারাবন্দী হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি নিতে হতো না। ফলে পদোন্নতি পেয়ে আরও বড় সামরিক আমলা হতে পারতেন, অনেক আরাম-আয়েশে জীবনযাপন করতে পারতেন। কিন্তু ছাত্রজীবন থেকে দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ এই মানুষটি সেনাবাহিনীতে কমিশন র‌্যাংকে চাকরিতে যোগদান সত্ত্বেও দেশকে পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসন-শোষণের হাত থেকে রক্ষার্থে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা তথা বাঙালি নিজস্ব আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মৃত্যুর ঝুঁকি নিতেও দ্বিধাবোধ করেননি।

নবম সংসদে সদস্য নির্বাচিত হলে কর্নেল (অব.) শওকত আলী ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার হন। তখন অ্যাভোকেট মো. আবদুল হামিদ স্পিকার পদে বহাল ছিলেন। বলা বাহুল্য, ডেপুটি স্পিকারের মর্যাদা পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদার সমতুল্য এবং প্রটোকল অনুসারে রাষ্ট্রের ৫ নম্বর পদ। ২০১৩ সালের ২৪ জানুয়ারি ভারপ্রাপ্ত স্পিকার হিসেবে তিনি অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথবাক্য পাঠ করান। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি জটিলতা, নিউমোনিয়া, ডায়াবেটিসসহ বার্ধক্যজনিত লাইফ সাপোর্টে থাকার পর গত বছরের ১৬ নভেম্বর সোমবার কর্নেল (অব.) শওকত আলী তাঁর অসংখ্য ভক্তকে ফেলে বিদায় নিয়েছেন। তাঁর প্রয়াণের মধ্য দিয়ে জাতি একজন পরীক্ষিত, ত্যাগী, আদর্শবান জাতীয় বীরকে হারাল। যিনি সহজ-সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থেকে সদা হাস্যোজ্জ্বল এই মানুষটি সমগ্র জীবন সাধারণ মানুষের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করেন। জাতির জনকের মতাদর্শে অবিচল থেকে বারবার মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে রাজনৈতিক মঞ্চে নিজেকে সোচ্চার রেখেছেন। আজ ৮৪তম জন্মবার্ষিকীতে মৃত্যুঞ্জয়ী জাতীয় বীর কর্নেল (অব.) শওকত আলীর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

 

                লেখক : ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ (মুসপ)।

সর্বশেষ খবর