বুধবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

বালক মুহাম্মদ (সা.)-কে দেখে পাদরি বুঝেছিলেন ইনি সেই মহামানব

এম এ মান্নান

বালক মুহাম্মদ (সা.)-কে দেখে পাদরি বুঝেছিলেন ইনি সেই মহামানব

মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থাতেই তাঁর বাবা আবদুল্লাহ ইন্তেকাল করেন। তাঁর বয়স যখন ছয় বছর তখন মা আমিনা মারা যান। মায়ের ইন্তেকালের পর তিনি দাদা আবদুল মুত্তালিবের তত্ত্বাবধানে আর দাদার ইন্তেকালের পর চাচা আবু তালিবের কাছে লালিত হন। ৫৮২ খ্রিস্টাব্দে আবু তালিব এক কাফেলার সঙ্গে সিরিয়ায় রওনা হলেন ব্যবসায়িক সফরে। যাত্রার প্রাক্কালে ১২ বছরের বালক মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সঙ্গে যাওয়ার আবদার করলেন। চাচা তাঁর আবদার উপেক্ষা করলেন না। ভাইয়ের ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে সফরে বের হলেন। কাফেলা বসরায় পৌঁছে যাত্রাবিরতি করল। সেখানে ছিলেন বুহাইরা নামে এক খ্রিস্টান পাদরি। এক গির্জায় তিনি থাকতেন। খ্রিস্টধর্মে তিনি ছিলেন বড় আলেম। ওই গির্জায় একটি আসমানি কিতাব রক্ষিত ছিল বহু যুগ ধরে। পুরুষানুক্রমে ওই জ্ঞানের উত্তরাধিকার চলে আসছিল। কথিত আছে, বুহাইরা তাঁর গির্জায় বসেই একটা আশ্চর্য ব্যাপার দেখতে পান। তিনি কাফেলার এগিয়ে আসার সময় দেখেন, সমগ্র কাফেলার মধ্যে একমাত্র বালক মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আকাশ থেকে একখ- মেঘ ছায়া দিয়ে চলেছে। এরপর কাফেলা একটা গাছের ছায়ায় যাত্রাবিরতি করলে মেঘ ও সেই গাছের ডালপালা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর ঝুঁকে ছায়া দিতে লাগল। এ দৃশ্য দেখে বুহাইরা গির্জা থেকে বেরিয়ে এলেন এবং লোক পাঠিয়ে কাফেলার লোকদের বলে পাঠালেন, ‘হে কুরাইশ বণিকগণ! আমি আপনাদের জন্য খাওয়ার বন্দোবস্ত করেছি। আপনাদের মধ্যে ছোট-বড় দাস বা মনিব সবাইকে এসে খাদ্য গ্রহণ করতে অনুরোধ করছি।’

সে আহ্বানে কাফেলার সবাই খেতে গেলেন। অল্পবয়স্ক হওয়ায় রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাফেলার বহরের সঙ্গে গাছের ছায়ায় বসে রইলেন। খাওয়ার জন্য সমবেত কুরাইশ বণিকদের সবাইকে ভালোভাবে পরখ করে বুহাইরা সেই পরিচিত হাবভাব ও চালচলনের কোনো লক্ষণ কারোর মধ্যে দেখতে পেলেন না, যা বালক মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যে দেখেছিলেন। তাই তিনি বললেন, হে কুরাইশ অতিথিবৃন্দ! আপনাদের কেউই যেন আমার খাবার গ্রহণ থেকে বঞ্চিত না থাকেন। তারা বললেন, ‘হে বুহাইরা! যারা এখানে আসার মতো তারা সবাই এসেছেন। শুধু একটি বালক কাফেলার বহরে রয়েছে। সে কাফেলার মধ্যে কনিষ্ঠতম।’ বুহাইরা বললেন, ‘না, তাঁকে বাদ রাখবেন না। তাঁকেও ডাকুন। সেও আপনাদের সঙ্গে খাবার গ্রহণ করুক।’ বুহাইরার কথামতো বালক মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে  নিয়ে আসা হলো। এ সময় বুহাইরা তাঁর সমগ্র অবয়ব গভীরভাবে দেখতে ও দেহের বিশিষ্ট নিদর্শনগুলো পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। যার বিবরণ তিনি পূর্ববর্তী আসমানি কিতাবে পেয়েছেন। সমাগত অতিথিদের সবার খাওয়া শেষ হলে এবং তারা এক এক করে বেরিয়ে গেলে বুহাইরা রসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, ‘হে বৎস! আমি তোমাকে লাত ও উজ্জার দোহাই দিয়ে অনুরোধ করছি, আমি যা জিজ্ঞাসা করব তুমি তার জবাব দেবে।’ রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘আমাকে লাত-উজ্জার দোহাই দিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করবেন না। আল্লাহর শপথ! আমি ওই দুই দেবতাকে সর্বাধিক ঘৃণা করি।’ বুহাইরা বললেন, ‘আচ্ছা তবে আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলছি, আমি যা জিজ্ঞাসা করব তুমি তার জবাব দেবে।’ রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘ঠিক আছে, কী কী জানতে চান বলুন।’ এরপর বুহাইরা তাঁকে নানা কথা জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। তাঁর ঘুমন্ত অবস্থার কথা, তাঁর দেহের গঠন-প্রকৃতি ও অন্যান্য অবস্থার কথা। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সব প্রশ্নের যা জবাব দিলেন তা বুহাইবার জানা তথ্যের সঙ্গে হুবহু মিলে গেল। তারপর তিনি তাঁর পিঠ দেখলেন। পিঠে দুই কাঁধের মধ্যবর্তী স্থানে নবুয়তের মোহর অঙ্কিত দেখতে পেলেন। মোহর অবিকল সেই জায়গায় দেখতে পেলেন যেখানে বুহাইরার পড়া আসমানি কিতাবের বর্ণনা অনুসারে থাকার কথা ছিল। এসব করার পরে বুহাইরা আবু তালিবকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বালকটি আপনার কে?’ তিনি বললেন, ‘আমার ছেলে।’ বুহাইরা বললেন, ‘সে আপনার ছেলে নয়, এই ছেলের পিতা জীবিত থাকতে পারে না।’ আবু তালিব বললেন, ‘বালকটি আমার ভাইয়ের ছেলে।’ বুহাইরা বললেন, ‘ওর বাবার কী হয়েছিল?’ আবু তালিব বললেন, ‘এই ছেলে মায়ের পেটে থাকতেই তার বাবা মারা গেছে।’ বুহাইরা বললেন, ‘ঠিক, এ রকম হওয়ার কথা। আপনার ভাইয়ের ছেলেকে নিয়ে ঘরে ফিরে যান। খবরদার! ইহুদিদের থেকে ওকে সাবধানে রাখবেন। আল্লাহর কসম! তারা যদি এ বালককে দেখতে পায় এবং আমি তাঁর যে নিদর্শন দেখে চিনেছি তা যদি চিনতে পারে তাহলে তারা ওর ক্ষতিসাধনের চেষ্টা করবে। কেননা আপনার ভাইয়ের ছেলে অচিরেই এক মহামানব হিসেবে আবির্ভূত হবেন।’ এরপর রসুল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিয়ে তিনি তাড়াতাড়ি স্বদেশে ফিরে গেলেন। সিরাতে নববি, ইবনে হিশাম।

লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক।

সর্বশেষ খবর