শুক্রবার, ২৯ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

করোনাকালের বার্ষিক খতিয়ান

শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন

করোনাকালের বার্ষিক খতিয়ান

বাংলাদেশে কি কখনো করোনা নামের কোনো মহামারী এসেছিল? করোনা মহামারীর প্রকোপ আরম্ভ হওয়ার পর এক বছর না যেতেই বাংলাদেশের নগর-বন্দর-গ্রাম-মফস্বলের হাটে-ঘাটে-মাঠে যে লোকসমাগম, যে হইচই ও উৎসব, যে নির্বাচনী দ্বৈরথ, মুখোশ ছাড়াই যে মনুষ্য কলরব তাতে কারও মনে যদি এ প্রশ্ন দেখা দেয় তাকে কি দোষ দেওয়া যাবে? এ কথাও ঠিক যে যুদ্ধ-মহামারী-প্রাকৃতিক দুর্যোগ যাই আসুক  মহাকাল তার নিজ গতিতে নির্মোহভাবে নিরন্তর এগিয়ে চলে। তবে ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লবের মতো ঘটনা ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তন করে দেয়; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো মনুষ্যসৃষ্ট দুর্বিপাক ৭ কোটি মানুষের মৃত্যু ঘটায়, ধ্বংসযজ্ঞ-কনসেনট্রেশন ক্যাম্প ও গ্যাস চেম্বারের মধ্য দিয়ে মানবাধিকার সর্বজনীন চরিত্র লাভ করে; প্লেগ-কলেরা ও স্প্যানিশ ফ্লুর মতো মহামারী কোটি কোটি মানুষকে নিয়ে যায় জীবনের ওপারে। আবার কোনো কোনো ঘটনা চোখের সামনে ঘটতে দেখেও মানুষ তার গুরুত্ব বুঝতে পারে না। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার সেনাবাহিনীর সঙ্গে যখন রবার্ট ক্লাইভের বাহিনীর যুদ্ধ চলছিল, তখন পাশের ধান খেত থেকে কৃষক সেটি অবলোকন করছিল। কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে শুধু বাংলা-বিহার-ওড়িশা নয়, পুরো ভারত উপমহাদেশের পরাধীনতা শুরু হয়ে গেল। তারা ধারণাই করতে পারেনি এরপর ভারত, ভারতীয় রাজ্যসমূহ, বার্মাসহ সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কুক্ষিগত হবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর ছয়-সাত মাস চলে গেলেও আমেরিকা, পাকিস্তান, চীন ও আরব রাষ্ট্রগুলো বুঝতে পারেনি বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। আর সাবধানী ও সুযোগসন্ধানী উচ্চশিক্ষিত লোকেরা, আমলা, সেনা কর্মকর্তারা তো স্বাধীন হওয়ার শেষ দিন পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারের চাকরি করেছেন। তারপর বাংলাদেশ সরকারের চাকরিতে বহাল হয়ে রাষ্ট্রের সব সুবিধার মালিক হয়েছেন। আর যে কৃষক-শ্রমিক ও খেটে খাওয়া মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে তাদের আবারও দাঁড়াতে হয়েছে দারিদ্র্য, ক্ষুধা, মঙ্গা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে করোনাকালের ধারাবিবরণী কীভাবে লিখিত হবে আমি জানি না। তবে নিশ্চিত করে এ কথা বলা যায় বৈশি^ক ইতিহাসে করোনা মহামারী ভয়াবহ এক বিপর্যয় বলে চিত্রিত হবে। কেননা করোনা মহামারী মানুষের সভ্যতার বড়াইকে ধূলিজর্জরিত করে দিয়েছে। চারটি শিল্পবিপ্লব, জীববিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নয়নকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে করোনা মহামারী বিস্তৃত হয়েছে দেশ থেকে দেশান্তরে; কেড়ে নিয়েছে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ; অর্থনীতিকে পিছিয়ে দিয়েছে কয়েক যুগ। মানুষ বনাম প্রকৃতির যুদ্ধে প্রকৃতি জয়ী হয়েছে। প্রকৃতি শুধু বলেছে, চারপাশের বাস্তুসংস্থানের সঙ্গে মিলেমিশে বাঁচার চেষ্টা কর। নইলে প্রকৃতির প্রতিশোধে বিপন্ন হতে পারে হোমো সেপিয়েন্সদের অস্তিত্ব! একজন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি কিছ ুদিন আগে আমার কাছে তাঁর কিশোর বয়সে দেখা কলেরা মহামারীর ভয়াবহ স্মৃতি রোমন্থন করছিলেন। তিনি নির্বাক শোকের কথা বলছিলেন, তিনি বাংলার গ্রামে গ্রামে নিঃস্তব্ধ লাশের সারি ও সেসবের সৎকারের কথা বলছিলেন। তিনি বলছিলেন, কলেরায় তখন ১ হাজার লোকের মধ্যে ৯৯৯ জনই মৃত্যুবরণ করত। গ্রামে কলেরা মহামারী দেখা দিলে মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়ে যেত। শুধু মৃত্যু আর মৃত্যু! এত মৃত্যু যে গোসল-জানাজা ছাড়াই লাশগুলো নামিয়ে দেওয়া হতো গণকবরে। করোনা মহামারীর সময় বাংলাদেশে আমাদের এমন দৃশ্য দেখতে হয়নি। তবে ইউরোপ ও আমেরিকার অবস্থা ছিল ভয়াবহ!

কভিড-১৯ মহামারীর প্রথম ছোবলে চীন, ইউরোপ ও আমেরিকা মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়েও আমেরিকা, ব্রিটেন ও ইতালির অবস্থা খারাপ। এপ্রিল-মের দিকে ইউরোপের কয়েকটি শহরে বিশাল আকৃতির শকটে লাশ ভরে ভরে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছিল গণকবরে। মহামারীক্লিষ্ট চীন, আমেরিকা ও ইউরোপের মানুষের অন্তরাবর্তন দেখে আমরা শঙ্কিত হয়েছিলাম। পিপিই পরে করোনা আক্রান্তের চিকিৎসা চলছে, মনে হচ্ছিল একদল অ্যাস্ট্রোনট মৃত্যুপথযাত্রী একজনকে ঘিরে আছেন, মৃত্যু হলেই তাকে নিয়ে যাওয়া হবে দূর আকাশের ছায়াপথে। পরিবার-পরিজনের কেউই তার কাছে যেতে পারছে না; মৃত্যুর সময়ে কোনো কোমল হাতের একটু ছোঁয়া স্পর্শ করতে পারছে না তার চিবুক; প্রিয়তম পুত্র বা কন্যাদের কেউ বুকে মাথা ঠেকিয়ে বলতে পারছে না, ‘মা/বাবা, তুমি খুব শিগগিরই সেরে উঠবে। আমরা আবার লাল কৃষ্ণচূড়া দেখব, আমরা আবার সাগরের তীরে বসে ঝলমলে জোছনা দেখব।’

আমরা উৎকণ্ঠিত হয়ে ভেবেছিলাম, ইউরোপ-আমেরিকার অবস্থা বাংলাদেশের হলে পথে পথে লাশ পড়ে থাকবে। প্রথম দিকে পাঁচ-সাতটি হাসপাতাল ঘুরে অনেকের মৃত্যুও হয়েছে। হাসপাতাল নেই, আইসিইউ নেই, ভেন্টিলেটর নেই- সে কি অবস্থা! মহামারীর বিস্তারে তৈরি হলো উৎকণ্ঠা, চিত্তোদ্বেগ ও বিকার। আবার শঙ্কা ও নৈরাশ্যে অনেকের মধ্যে জন্ম নিল অতি-আশাবাদ। অনেকে ভাবল মহামারীতে জীবনের অনিত্যতা দেখে লুটেরা, দুর্বৃত্ত ও দুর্নীতিবাজরা আত্মসংশোধনে প্রবৃত্ত হবে। লুটপাট, দুর্নীতি, অপরাধ, সন্ত্রাস এসব বন্ধ হবে। একেবারে বন্ধ না হলেও অনেকটা কমবে বলে অনেকে সুনিশ্চিত প্রত্যয়ে থিতু হয়েছিল। কিন্তু ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ইনকরিজিবল’, ঝাঁকে ঝাঁকে তাদের আবিষ্কার করে আশাবাদীরা হতোদ্যম হতে লাগল। দেখা গেল শুধু মন্ত্রী-আমলাই নন, স্বাস্থ্য বিভাগের ড্রাইভার-খানসামারাও শত কোটি টাকার মালিক!

করোনার প্রথম দিকে ইতালি-ফেরত স্বামীকে দেখে স্ত্রী পালিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে; আপন ছেলেমেয়ে ও জামাই মিলে জ্বারক্রান্ত মাকে করোনা সন্দেহে ফেলে দিয়ে এলো গাজীপুরের শালবনে; করোনা-আক্রান্ত ব্যক্তি ও পরিবারকে একঘরে করে দিতে লাগল শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা; ডাক্তার ও সাংবাদিকদের বাড়িছাড়া করতে উঠেপড়ে লেগে গেল বাড়িওয়ালারা। এই কয়েক মাস আগের কথা। কিন্তু কি ভয়াবহ ও মর্মান্তিক! মৃত্যুভয়ে আতঙ্কিত মানুষের বিকারগ্রস্ত আচরণ। মুখগুলো পা-ুর; চোখে নির্বিকার নির্মোহ; মনে হয়েছিল প্রদোষকালীন বিষণœতা গ্রাস করেছে সমগ্র পৃথিবীকে। বাংলাদেশে মৃত্যুর হার ছিল আশাতীতভাবে কম। বিপুলসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হলেও ঘরে বসেই সুস্থ হতে শুরু করল। ভয় কেটে যেতেই স্রোতের মতো মানুষ বেরিয়ে আসতে লাগল। নগরীর পথে পথে আগের দুর্গন্ধ, যানজট, হল্লা ও নাগরিক নৈরাজ্য।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সময়মতো সাধারণ ছুটি তুলে নেওয়ার ব্যবস্থা করে এবং জীবিকাসংশ্লিষ্ট কর্মকান্ড অব্যাহত রেখে সাহসী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কাজ করেছিলেন। নইলে হতদরিদ্র ও নিম্নমধ্যবিত্তরা না খেতে পেয়ে মারা যেত। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতের বেহাল অবস্থা বেহালতর হলো। উচ্চমাধ্যমিকের অটো পাস মানহীন শিক্ষার কফিনে প্রমাণ সাইজের একটি পেরেক ঠুকে দিল। লুটেরা ব্যবসায়ীদের হাজার হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা দেওয়া হলেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনলাইনে ক্লাস করার জন্য বিনামূল্যে ডাটা দেওয়া হলো না।

করোনাকালে কৃষি, শিল্প, সেবা খাতে প্রতিদিন গড় ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা; নিম্নবিত্তের আয় কমল ৭৫ ভাগ এবং চরম দারিদ্র্যের সংখ্যা বৃদ্ধি পেল ৬০ ভাগ। এমন দুরবস্থার মধ্যেও থেমে থাকেনি লুটপাট ও দুর্নীতি। করোনা সার্টিফিকেট নিয়ে সাহেদ-সাবরিনাদের প্রতারণায় সারা বিশ্ব শিউরে ওঠে। পিপিই ও মাস্ক নিয়ে উজির-নাজিরদের দুর্নীতিতে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে অনেক চিকিৎসক ও পুলিশ কর্মকর্তাকে। মার্চ থেকে জুন এ তিন মাসে ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বেড়েছে ৩ হাজার ৪১২।

সাহেদ-সাবরিনাদের প্রতারণা, বাড়িওয়ালাদের দায়িত্বহীন আচরণ, জনপ্রতিধিদের ত্রাণ চুরি, সন্তান কর্তৃক মা-বাবাকে ফেলে আসা, জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতা- এ রকম অনেক নেতিবাচক কর্মকান্ডের মধ্যেও মানুষ এগিয়ে এসেছিল মানুষের জন্য। ডাক্তাররা এগিয়ে এসেছিলেন অসীম সাহসিকতা নিয়ে। চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে অনেকের মৃত্যু হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ‘মানবিক পুলিশ’-এর অনন্য উদ্যোগ নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। অনেক স্বেচ্ছাসেবী মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে করোনায় মৃতদের লাশ সৎকার করেছেন; অনেকে বিলিয়েছেন ত্রাণ ও খাবার। করোনাকালে আমরা হারিয়েছি অসংখ্য জ্যেষ্ঠ নাগরিক। আমাদের জ্ঞানরাজ্য ও সাংস্কৃতিক জগতের কয়েকটি উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। এ মৃত্যুগুলো আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি করেছে, তবে তাদের যাত্রা করিয়ে দিয়েছে অসীমলোকের চিরকালীনতার পথে। জীবনানন্দ দাশের ভাষায়, ‘মানুষের মৃত্যু হ’লে তবুও মানব থেকে যায়;/ অতীতের থেকে উঠে আজকের মানুষের কাছে/প্রথমত চেতনার পরিমাপ নিতে আসে। ... প্রতিটি মানুষ তার নিজের স্বতন্ত্র সত্তা নিয়ে/অন্ধকারে হারায়েছে;/তবু তা’রা আজকের আলোর ভিতরে/সঞ্চারিত হ’য়ে উঠে আজকের মানুষের সুরে ...’

জগদ্বিখ্যাত সুফি সাধক কবি মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি বলেছেন, Our death is our wedding with eternity. বাঙালির পথপ্রদর্শক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘অনুধ্যানে মানুষ নিরন্তর গতিশীল, কাল হতে কালান্তরে, যুগ হতে যুগান্তরে তথা সীমা হতে অসীমলোকে মানুষের নিত্য অভিসার চলছে।’ মানব জীবনের মহিমাকে রবীন্দ্রনাথ কখনোই মৃত্যুর দাম্ভিকতার মধ্যে হারিয়ে যেতে দেননি। রবীন্দ্র অনুধ্যানে মৃত্যু জীবনের ধ্বংসকারী শক্তি হিসেবে চিত্রিত না হয়ে জীবনের সম্পূরক শক্তি হিসেবেই অভিষিক্ত হয়েছে। আমরাও মৃত্যুকে জীবনের সম্পূরক শক্তি হিসেবে মেনে নিয়ে জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে এক চিরকালীন মেলবন্ধন রচনা করতে চাই। তবে এটাই চাই যে স্বাস্থ্য বিভাগের অব্যবস্থাপনা, মন্ত্রী-আমলাদের দুর্নীতি ও সাহেদ-সাবরিনাদের প্রতারণার কারণে যেন কারও মৃত্যু না হয়। প্রত্যেকেই যেন তার পার্থিব দায়িত্ব মসৃণভাবে সম্পন্ন করে অনিবার্য মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে সীমা হতে অসীমলোকে যাত্রা করতে পারে।

            লেখক : অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর