রবিবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

মুজিব শতবর্ষ ও গৃহহীনদের গৃহ প্রদান

ওয়াহিদা আক্তার

মুজিব শতবর্ষ ও গৃহহীনদের গৃহ প্রদান

২০২০ সালের শুরুতেই সারা বিশ্বে করোনাভাইরাস অতিদ্রুত মহামারী আকার ধারণ করে। বাংলাদেশে প্রথম এ ভাইরাসে আক্রান্ত শনাক্ত হয় ওই বছরের ৮ মার্চ। ওসমানী মিলনায়তনে সেদিন নারী দিবসের অনুষ্ঠান ছিল। ফিরে এসে গণভবনে অপেক্ষারত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-সচিবসহ অন্যান্য কর্মকর্তার সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অফিসকক্ষে কথা বলেন। তিনজনের দেহে করোনাভাইরাস (কভিড-১৯) শনাক্ত হয়েছে। একজন ইতালি থেকে ফিরেছিলেন। অসতর্ক ছিলেন। তারা পাবলিক বাসে যাতায়াত করেছেন। আত্মীয়দের বাসায় গিয়েছেন। এভাবে সংক্রমণ ছড়িয়েছেন। এদিকে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে নেওয়া দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানাদির প্রস্তুতি চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল। বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ১৭ মার্চ হবে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে বর্ণাঢ্য উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। ইউরোপ-আমেরিকায় জনসমাগম হতে পারে এমন পূর্বঘোষিত অনুষ্ঠানাদি বাতিলের খবর আসতে শুরু করে। চীনের উহান থেকে দ্রুত বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশ ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। এর মধ্যেই বিরোধী দল গুজব ছড়াতে শুরু করে ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের কারণে বাংলাদেশে করোনার খবর গোপন রাখা হচ্ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কাছে প্রথম আক্রান্ত শনাক্তের খবর শোনামাত্র মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দ্বিধাহীনভাবে জানালেন, ‘অবিলম্বে দেশবাসীকে জানাও। সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। জন্মশতবার্ষিকী নিয়ে বোন রেহানাসহ আমার পরিবারের সদস্যদের সবার যে কোনো বাস্তব পরিস্থিতি মেনে নেওয়ার মানসিক প্রস্তুতি আছে।’ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির জরুরি সভা সন্ধ্যায় গণভবনে ডাকা হলো।

গণভবনের বাংকোয়েট হলে জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটির সদস্য, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুল, রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি উপস্থিত ছিলেন। আরও ছিলেন দেশের সব উচ্চপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা, ক্যাবিনেট সদস্য, শিক্ষাবিদ, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকরা। বঙ্গবন্ধু পরিবারের পক্ষে শেখ হাসিনা সবার মতামত আহ্বান করেন। ভূমিকা বক্তব্যে তিনি জানান, দেশে করোনা আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কীভাবে জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করা হবে সে সম্পর্কে আলোচনার শুরুতে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বেঁচে থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করতে পারছি এটা আমাদের দুই বোনের জীবনে বিশেষ পাওয়া। আল্লাহ রব্বুল আলামিনের কাছে শুকরিয়া।’ তিনি বলেন, ‘৭ মার্চ সিআরআই আয়োজিত জয় বাংলা কনসার্টের স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল অভূতপূর্ব। ১৭ মার্চের জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডের রিহার্সেল শেখ রেহানা ও সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুল তদারকি করছে। এ মুহূর্তে আজ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করেছে দেশে তিনজন করোনাভাইরাস আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে। ভয়াবহ সংক্রামক এ রোগ হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়ায়। জাতীয় পর্যায়ে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কীভাবে রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধ করা হবে সে বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আপনাদের পরামর্শ প্রয়োজন। আমাদের জীবদ্দশায় আমরা আর জন্মশতবর্ষ উদযাপন করতে পারব না।’

জাতীয় কমিটি জানায়, ১ লাখ ৩০ হাজার দাওয়াত কার্ড ছাপা হয়ে গেছে। সংক্রমণের খবর পেলে জনমনে আতঙ্ক ছড়াতে পারে। জনস্বার্থে সমাবেশ বন্ধ করতে হবে। নানা আশঙ্কার কথা প্রকাশ করা হলো।

শেখ রেহানা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু জনগণের। এ অনুষ্ঠান পালন করতে গিয়ে যদি একটি মানুষের জীবনও ঝুঁকিপূর্ণ হয় সে দায়িত্ব অন্তত আমরা দুই বোন নিতে পারব না। আমার আব্বাও তাতে শান্তি পাবে না।’ তখন সবাই মিলে সিদ্ধান্ত হলো অনুষ্ঠান পেছানো হবে ও পুনর্বিন্যাস করে পরিবর্তিত পরিস্থিতির উপযোগী করা হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কীভাবে মুজিব জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন হবে সে বিষয়ে পরামর্শ প্রদানে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ অংশগ্রহণ করেন। সবাই একমত হন, অন্য প্রকারে হলেও মুজিব জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করতে হবে। ১৭ মার্চ জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন শুরু হবে।

সিদ্ধান্ত হয় টিভিতে অনুষ্ঠান সম্প্রচার, স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ, অনলাইন অনুষ্ঠান, ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে করতে হবে। বিদেশি অতিথিদের জানাতে হবে যে অনুষ্ঠান হচ্ছে না। ভিডিও বার্তাসহ ভার্চুয়াল অনুষ্ঠান হবে। অনুষ্ঠানসূচিতে কিছু রদবদল হলেও অনুষ্ঠান না হলেও হতাশা থেকে বেরিয়ে আসতে পারব না। যথাসম্ভব সতর্কতা অবলম্বন করে জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। শেখ রেহানা বলেন, ‘অনুষ্ঠান পেছানো আমাদের জীবনে কোনো বিষয় নয়। এক মাসের জন্য দেশের বাইরে গিয়ে ছয় বছর ফিরতে পারিনি। সবাইকে রেখে গিয়ে ফিরে এসে কাউকে পাইনি। জীবনে আমরা হারিয়েছি যত পেয়েছিও কম নয়। আমরা শ্রদ্ধাবনত চিত্তে পালন করব হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, আমাদের দেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী।’

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জন্মশতবর্ষ অবিচ্ছেদ্য। কোনো কর্মসূচি বাতিল হবে না। সমাবেশ বাদ দিয়ে সীমিত আকারে উদযাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবাইকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘বাংলাদেশের দরিদ্র প্রত্যেক গৃহহীন মানুষকে একটি করে ঘর করে দিন, তাহলে জাতির পিতার আত্মা শান্তি পাবে।’ শুরু হয় মুজিববর্ষ উপলক্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে জমি ও গৃহ প্রদান।

প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না। মুজিববর্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ প্রত্যয়দৃপ্ত অঙ্গীকার বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। প্রণয়ন করা হয় নীতিমালা। জমি আছে ঘর নেই বা জমি নেই ঘর নেই ক্যাটাগরিতে ভাগ করে শুরু হয় দেশব্যাপী কর্মযজ্ঞ। দুই শতক জমির ওপর দুই রুম, রান্নাঘর ও বাথরুম নিয়ে তৈরি হয় ছোট্ট একটি টিনের ছাউনি দেওয়া আধাপাকা বাড়ি। এভাবেই দুঃখী মানুষের স্বপ্নের বাড়ি দেওয়ার জন্য মুজিববর্ষ উপলক্ষে গৃহীত বিশেষ কার্যক্রম শুরু হয়। ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে মুজিববর্ষে বাংলাদেশের একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না। শেখ হাসিনার এ নির্দেশনা বাস্তবায়নে দেশের সব ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য গৃহ প্রদানের নীতিমালা ২০২০ প্রণয়ন করে সারা দেশের ৯ লাখ ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের তালিকা তৈরি করা হয়। প্রথম পর্যায়ে গত ২৩ জানুয়ারি সারা দেশে একযোগে ৬৬ হাজার ১৮৯টি ঘর পেল বাংলাদেশের গৃহহীন দরিদ্র মানুষ। দুই কামরাবিশিষ্ট ঘর, রান্নাঘর, বাথরুমসহ সুদৃশ্য এ আধাপাকা বাড়ি গৃহহীন দরিদ্র মানুষের চোখে আনন্দের অশ্রু এনে দিয়েছে। আবেগতাড়িত অশ্রুভরা কণ্ঠে তাদের অনুভূতি প্রকাশে তাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আনন্দের অশ্রুতে ভেসেছেন।

মানুষকে দেওয়ার আনন্দ বঙ্গবন্ধু পরিবারের অনন্য বৈশিষ্ট্য। ক্ষুধাপীড়িত, দারিদ্র্যপীড়িত বিপন্ন মানুষের পাশে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা কীভাবে থাকেন তা কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আমরা ব্যক্তিগত অনুবিভাগের কর্মকর্তারা তটস্থ থাকি যে কোনো সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার  নির্দেশনা আসতে পারে। সারা দেশ থেকে গরিব-দুঃখী, বিপদগ্রস্ত মানুষ তাঁকে মেসেজ পাঠায়। তিনি সেগুলো পড়ে প্রয়োজনমতো আমাদের নির্দেশনা দেন ব্যবস্থা নিতে এ কথা এখন দেশবাসী জানে। পত্রিকার মাধ্যমে, মেসেজের মাধ্যমে কত শত মানুষের পাশে অনন্য মানবিক শেখ হাসিনা দাঁড়িয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই।

বাসস্থান মৌলিক চাহিদার মধ্যে অন্যতম প্রধান। মাথা গোঁজার একটু ঠাঁই হলে শ্রমজীবী মানুষ যা আয় করে তা দিয়ে উন্নত-জীবন যাপন করতে পারে। তাদের সন্তানরা বিনামূল্যে বই পায়, উপবৃত্তি পায়, স্কুল ফিডিং কর্মসূচির মাধ্যমে দুপুরের টিফিন পায়, তাদের বয়স্ক মা-বাবা বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা পান। তাদের গর্ভবতী স্ত্রীরা মাতৃত্বকালীন ভাতা পান, তাদের প্রতিবন্ধী কোনো সদস্য থাকলে প্রতিবন্ধী ভাতা পায়। এভাবে নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে আমাদের দেশের মানুষকে পরম মমতায় বুকে আগলে রেখেছেন শেখ হাসিনা। তিনিই প্রথম দেশের জনসংখ্যাকে সমস্যা মনে না করে তাদের জনসম্পদে পরিণত করার উদ্যোগ নিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধু বাংলার দুঃখী মানুষের জন্য সারাটা জীবন সংগ্রাম করে, রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছিলেন। স্বাধীনতার পর দেশের দায়িত্ব নিয়ে দেশ গড়ার কাজে হাত দিয়েছিলেন। মানুষকে বলতেন, ‘একটা গাছ লাগিয়ে ফল পেতেও পাঁচ বছর সময় লাগে। আমাকে তিনটি বছর সময় দাও। এই তিন বছর আমি কিছুই দিতে পারব না।’

সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত শিশু রাষ্ট্রের সক্ষমতা বলতে কিছুই ছিল না। ১৯৭২-৭৫ পর্যন্ত তাঁর দেওয়া ভাষণগুলো চোখে পানি এনে দেয়। বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ। শেখ হাসিনা তাঁর যে কোনো স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে শুধু নির্দেশনা দিলেই হয়ে যাচ্ছে অথচ বঙ্গবন্ধু কত কষ্ট করেছেন। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি অপরাধীর শত কৈফিয়ত নিয়ে ভালোবাসার দুঃখী মানুষের সামনে দাঁড়িয়েছেন।

তাঁর জন্মশতবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধুর প্রিয় দুঃখী মানুষ উন্নত জীবনের স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা ছোট একটি আধাপাকা বাড়ি উপহার পাচ্ছে এর চাইতে বড় কর্মসূচি আর হতেই পারে না। আমাদের ছোটবেলার পাঠ্যবইয়ে আসমানীদের ‘একটুখানি হাওয়া দিলেই ঘর নড়বড় করে,/তারি তলে আসমানীরা থাকে বছর ভরে।’ আসমানীদের ভাগ্য নিয়ে শেখ হাসিনা যখনই ক্ষমতায় এসেছেন আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিয়েছেন। তিনি তালিকাভুক্ত সব গৃহহীনকে ঘর দেবেন।

বাংলাদেশে একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না- প্রধানমন্ত্রীর এ অঙ্গীকার বাস্তবায়িত হলে পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশ হবে অনন্য মানবিক কল্যাণ রাষ্ট্র। প্রকৃত অর্থেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উদযাপন সার্থক ও সফল হবে।

পরিশেষে আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশের ভাষা না পেয়ে আমি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আশা’ কবিতার শরণাপন্ন হলাম।

বহুদিন মনে ছিল আশা

ধরণীর এক কোণে

রহিব আপন-মনে;

ধন নয়, মান নয়, একটুকু বাসা

করেছিনু আশা।

গাছটির স্নিগ্ধ ছায়া, নদীটির ধারা,

ঘরে-আনা গোধূলিতে সন্ধ্যাটির তারা,

চামেলির গন্ধটুকু জানালার ধারে,

ভোরের প্রথম আলো জলের ওপারে।

তাহারে জড়ায়ে ঘিরে

ভরিয়া তুলিব ধীরে জীবনের কদিনের কাঁদা আর হাসা;

ধন নয়, মান নয়, এইটুকু বাসা

করেছিনু আশা।

লেখক : অতিরিক্ত সচিব।

সর্বশেষ খবর