সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

জাস্টিস আবু সাঈদ চৌধুরীকে নিয়ে লেখা উপন্যাস ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট’

আজিমউদ্দিন আহমেদ

জাস্টিস আবু সাঈদ চৌধুরীকে নিয়ে লেখা উপন্যাস ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট’

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন জাস্টিস আবু সাঈদ চৌধুরী। বেঁচে থাকলে ২০২১ সালের ৩১ জানুয়ারি তিনি ১০০ বছরে পা দিতেন। তাঁর এ শততম জন্মবার্ষিকীতে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে ইতিহাসভিত্তিক একটি উপন্যাস ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট’। লিখেছেন কানাডা প্রবাসী লেখক আকতার হোসেন। স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষে আগামী ১৮ মার্চ-১৪ এপ্রিল, ২০২১-এ অনুষ্ঠিতব্য বইমেলায় এ বইটি প্রকাশ করবে ঢাকার ‘নন্দিতা প্রকাশ’। আশা করা যাচ্ছে বইটির ইংরেজি অনুবাদও একই সময় পাওয়া যাবে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রবাসী মুজিবনগর সরকার, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বহির্বিশ্ব ও জাতিসংঘে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল। বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে জারিকৃত ২১ এপ্রিল, ১৯৭১ সালে তাঁর নিয়োগপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। এ নিয়োগ প্রাপ্তির অনেক আগে থেকেই তিনি প্রবাসী বাঙালিদের সংগঠিত করে জনমত সৃষ্টির কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ২৭ মার্চ ১৯৭১ ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার মধ্য দিয়ে তাঁর কার্যকরী পরিকল্পনা শুরু হয়। মিস্টার প্রেসিডেন্ট বইটিতে আবু সাঈদ চৌধুরীর প্রথম দিনের কর্মকান্ড দিয়ে শুরু করে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখে বঙ্গবন্ধু ঢাকায় ফিরে এলে বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন আবু সাঈদ চৌধুরী এবং তিনিই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রীর শপথ-বাক্য পাঠ করিয়েছিলেন। আবু সাঈদ চৌধুরীকে এত বড় সম্মান দেওয়ার কারণ হলো মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তাঁর গৌরবোজ্জ্বল সাফল্যময় কর্মকান্ড। অথচ আমাদের জানার কৌতূহলের অভাবে ইতিহাসের অতল অন্ধকারে হারিয়ে গেছে এ মহান বীরের নাম। প্রবাসী বাঙালিরা সংঘবদ্ধ হয়ে আজ থেকে ৫০ বছর আগে যে ত্যাগ স্বীকার করেছিল বিশ্ব ইতিহাসে তা দুর্লভ ঘটনা। ৫৬ হাজার বর্গমাইল সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বাংলাদেশ তখন বিপুল বিস্তার ঘটিয়ে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল। এত বড় দেশ আগে দেখেনি বিশ্ব। এত কর্মচঞ্চল হয়নি কোনো দেশের মানুষ যা ১৯৭১ সালে প্রবাসী বাঙালিরা করে দেখিয়েছিল। ব্রিটিশ কিংবা পাকিস্তান আমলে যাদের বীরগাথা পাঠ্যবইতে পড়ানো হতো তাদের কেউই বাঙালি ছিল না। আলেকজান্ডার দি গ্রেট, মোগল বাদশাহ, সোহরাব রুস্তম, সুলতানা রাজিয়া এদের গল্প শুনতে শুনতে অনেকেই বড় হয়েছে। এখন তো আমাদের নিজস্ব অনেক বীর আছে, আছে নিজস্ব বীরগাথা। কথা হলো সেই বীরদের কজনকে আমরা চিনি? মুক্তিযুদ্ধে আমাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের ত্যাগ ও সাফল্যের কথা পড়তে শুরু করলে মানব ইতিহাসের উজ্জ্বল মুখগুলোর সঙ্গে তাঁরা বেশ মানানসই হয়ে ওঠেন। বাংলাভাষী সব গুণী ও মহান ব্যক্তিদের পাশাপাশি একাত্তরের বীরদের কথা জানতে পেরে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়া অনেকেই পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু আমাদের বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই হয়তো জানে না যে ছাত্রদের পাশাপাশি শিক্ষকদের মধ্যেও অনেকে জড়িত ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে। তাদেরই একজন শিক্ষক হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর শ্রদ্ধেয় আবু সাঈদ চৌধুরী। এ উপন্যাস সেই মহান ব্যক্তিকে নিয়ে লেখা। তিনিই ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট’। ব্রিটেনে ১৯৭১ সালে ১০০টির বেশি অ্যাকশন কমিটি ছিল। এ অ্যাকশন কমিটিগুলোর সমর্থক ও সদস্যরা নানাভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান রেখেছেন। প্রবাসে থেকেও স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা কাজ করেছেন এবং তাদের মধ্যে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন এমন ব্যক্তিদের নিয়ে এক বা একাধিক পুস্তক লেখা যায়। ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট’ উপন্যাসে আছে একজন আবু সাঈদ চৌধুরীর গল্প। অন্যরা হয়তো লিখেছেন কিংবা লিখবেন অন্য কারোর কথা। কাজেই যেহেতু ইতিহাস নয়, উপন্যাস তাই স্বভাবত ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট’ বইটিতে নায়ককে কেন্দ্র করে গল্প এগিয়েছে। যা পড়লে জানা যাবে প্রবাসী বাঙালিদের প্রশংসনীয় কাজের গুরুত্বপূর্ণ অনেক ঘটনা। ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট’ পড়ার পর কেউ যদি মনে করেন, দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে অবস্থান করে, বৈরী আবহাওয়া ও পরিবেশের মধ্যে থেকেও যে সব ব্যক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য লড়াই করেছেন তারাও স্বাধীনতার বীর সৈনিক তবেই ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট’ লেখা সার্থক হয়েছে বললেন বইটির লেখক আকতার হোসেন। প্রবাসে স্বাধীনতা আন্দোলন চালিয়ে যেতে আবু সাঈদ চৌধুরী যাদের সঙ্গে কথা বলতেন বা দেখা করেছিলেন তাঁদের অধিকাংশ মানুষই দায়িত্বশীল পদে অধিষ্ঠিত ছিল এবং এদের ছিল সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, অথবা সমপর্যায়ের অন্য প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের প্রভাবিত করার যোগ্যতা। তাই আবু সাঈদ চৌধুরীর মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা ছড়িয়ে যেতে শুরু করে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে। যুদ্ধকালীন নয় মাসে পাকিস্তানিদের দ্বারা দখলকৃত বাংলাদেশের কোথাও বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখা যেত না। বঙ্গবন্ধুর ছবি রাখা মানে নির্ঘাত বুলেটের আঘাতে মৃত্যু। অথচ সেই সময় বিশ্বের পথে-ঘাটে বঙ্গবন্ধুর ছবি হাতে নিয়ে মিছিল মিটিং করেছে প্রবাসীরা। এ কথা সবাই মানেন যে, জাতির পিতাকে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করতে না পারলে আমাদের বিজয়ের সাধ অসম্পূর্ণ থেকে যেত। তাই তাঁকে মুক্ত করতে প্রবাসীদের ভূমিকা জানা অপরিহার্য। প্রবাসীদের সঙ্গে নিয়ে আবু সাঈদ চৌধুরী দেশের জন্য যে অবদান রেখেছেন তা আমাদের গৌরবের অংশ। আশা করা যাচ্ছে ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট’ পড়লে বোঝা যাবে প্রবাসীদের কর্ম দক্ষতায় কীভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চুম্বক অংশ, মুক্তিযুদ্ধ।

সর্বশেষ খবর