বৃহস্পতিবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

শান্তি নিবাস

ওয়াহিদা আক্তার

শান্তি নিবাস

করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় নেওয়া হলো একটানা লকডাউন। একটানা কয়েক মাসের লকডাউনে শ্রমজীবী মানুষ, দিনমজুর মানুষের যেন কষ্ট না হয় তার জন্য শুরু হয় ত্রাণ কার্যক্রম। জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ওপর নির্দেশনা থাকে একটি মানুষও যেন ক্ষুধায় কষ্ট না পায়। তাদের ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ত্রাণ কার্যক্রমে জেলা প্রশাসকগণ ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার, অনলাইনভিত্তিক ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটস অ্যাপ, ই-মেইল এবং স্থানীয়ভাবে ডিজিটাল অ্যাপ তৈরি করে মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছে যায়।

উন্নত দেশের করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা আমাদের অনেকের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। বলা হয় বাংলাদেশের রাস্তায় রাস্তায় লাশ পড়ে থাকবে। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিরা দেশে ফিরতে শুরু করে। এয়ারপোর্টে নেওয়া হয় বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা। সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে ডাক্তার-নার্সরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোগী সেবায় ব্রতী হয়। প্রতিদিন দুপুর ২টায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের আইইডিসিআর-এর ব্রিফিংয়ের ওপর মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এ ভাইরাসের গতিবিধি বুঝে আমাদের দেশের ডাক্তার যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে ভাইরাস প্রতিরোধযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এ ভাইরাস শ্বাসযন্ত্রে আক্রমণ করে বিধায় সিনিয়র সিটিজেন যারা তারা অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। আমরা একের পর এক হারাতে থাকি দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে পরিবার-পরিজনের শোকগাথায় ভরতে থাকে সোশ্যাল মিডিয়ার পেজগুলো। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ মহামারী মোকাবিলায় সক্ষমতা বাড়াতে কঠোর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি দিনের জন্যও তাঁর কার্যক্রম বিলম্বিত করেননি। মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের তালিকা করে ৫০ লাখ মানুষের হাতে ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রত্যেককে ২ হাজার ৫০০ টাকা করে ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা পৌঁছে দেন। ৬৪ জেলার লক্ষাধিক নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীর অনুকূলে প্রায় ৫০ কোটি টাকা বিতরণ করা হলো। সব মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিনের অনুকূলে আর্থিক অনুদান দেওয়া হয়। বিপদের দিনে যাতে মানুষ হতাশায় মরে না যায়, তার কেউ নেই এই বোধ যেন না আসে।

শেখ হাসিনা একজন বিরল মানবিক গুণের অধিকারী রাষ্ট্রপ্রধান যাঁর অন্তরে ১৬ কোটি মানুষের স্থান দেওয়ার পরেও যারা প্রতিনিয়ত তাঁর বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করে কথা বলেন বা যারা প্রকৃত অর্থে তাঁর সর্বনাশের আশায় বসে থাকেন তাদের জন্যও তিনি জায়গা রাখেন। তিনি টাকা-পয়সা, সোনা-দানা হীরে-জহরত-গহনাকে সম্পদ মনে করেন না, সম্পদ মনে করেন মানুষের জীবনকে। আপনজন হারানোর বেদনা তাঁর মতো কে বোঝে আর। আমি ব্যক্তিগত অনুবিভাগের কর্মচারী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে সবচেয়ে কষ্ট হতো প্রতিনিয়ত আমাকে টেলিফোন করে বলা হতো- অমুককে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খুব ভালো চিনতেন বা ভালো জানতেন, তিনি আজ মারা গেছেন একটু দয়া করে তাঁকে জানিয়ে দেবেন। আমি চেষ্টা করতাম জানিয়ে দিতে তবে কষ্ট হতো যে এই মানুষটাকে আর কত দুঃসংবাদ দিতে হবে আমাদের। তবে এ কথা হলফ করে বলতে পারি তিনি বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের শোকের সান্ত্বনা। লক্ষ্য করেছি শোকার্ত স্বজনকে আমি যখন বলেছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে খবরটা জানানো হয়েছে তখনই তারা কান্না থামিয়ে আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছে।

ময়মনসিংহের একজন ইজিবাইকচালক তার আয়ের একমাত্র উপায়টি হারিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে মেসেজ দিয়েছিলেন তার ইজিবাইকটি উদ্ধার করে দিতে। আমি মোবাইল নম্বরটি দিয়ে এসপিকে অনুরোধ করলে এসপি জানান যার গ্যারেজ থেকে হারানো গেছে তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জেনে গেছেন শুনে তাকে একটি নতুন ইজিবাইক কিনে দিতে চান। যাই হোক সুন্দর সমাধানটি আমি জানালে স্যার খুব গম্ভীরভাবে বললেন, ‘পুরানোটি কে নিল?’ এক হাত বা এক পা নেই একজন রিকশাচালকের খবর প্রকাশিত হলে রেহানা আপার উদ্যোগে তাকে ঘরবাড়ি এবং ক্ষুদ্র ব্যবসার ব্যবস্থা করা হলো। প্রতিনিয়ত আমাকে টেলিফোন করে বলা হয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রতিবন্ধী শিশুরা কথা বলতে চায়। তাদের মায়েরা ফোন করে বলে ফোনটি প্রধানমন্ত্রীকে দেন। প্রতিবন্ধী বাচ্চারা মাকে আবদার করে তার সঙ্গে কথা বলবে, জিদ ধরে আমাকে ফোন করে তাদের অসহায়ত্বের কথা বলে।

২০১৯ সালে চোখ অপারেশনের জন্য লন্ডনে গেলে একান্ত সচিব হিসেবে আমি সফরসঙ্গী হই। হোটেল তাজ-এ আমরা অবস্থান করি। স্বাভাবিক সংক্রমণের আশঙ্কায় আমরা কেউ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্যুটে যাই না পারতপক্ষে। যা কিছু যোগাযোগ শেখ রেহানা আপার সঙ্গে। সপ্তাহখানেক পর আমি নিরাপদ দূরত্বে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সালাম দিই। উনি কালো চশমা পরে খাটের ওপর আধশোয়া ছিলেন। আমাদের সবার কুশল জিজ্ঞাসা করে বললেন, শোনো এবার দেশে গিয়ে একটি কাজে হাত দিতে চাই। বৃদ্ধাশ্রমে পরিবার-পরিজন ছাড়া বয়স্ক নারী-পুরুষ যারা থাকে তারা পরিবার-পরিজনকে খুব মিস করে। কোনো কিছুই তাদের মনকে ভালো রাখতে পারে না। তাদের জীবনে কোনো আনন্দ থাকে না। আবার এতিমখানায় যে শিশুরা থাকে তাদেরও মা-বাবা না থাকায় তারাও দাদা-দাদি-নানা-নানির স্নেহ থেকে বঞ্চিত থাকে। ওদের চোখে-মুখে একটা অসহায় ভাব ফুটে থাকে। আমি ভাবছি জেলার প্রতিটি এতিমখানার সঙ্গে বৃদ্ধাশ্রম থাকলে এদের মধ্যে সহজেই একটা সখ্য হবে। কেউ না কেউ তাদের আপনজন হিসেবে কাছে টেনে নেবে। তুমি এবার গিয়ে সমাজকল্যাণ সচিবকে বলে উদ্যোগ নিও। আমি দেশে ফিরে সমাজকল্যাণ সচিবকে উনার ইচ্ছার কথা জানিয়ে দিই। শুনেছি প্রতিটি বিভাগীয় শহরে পরীক্ষামূলকভাবে প্রধানমন্ত্রীর এই চিন্তার বাস্তবায়ন হচ্ছে ‘শান্তি নিবাস’ নামে।

যে মানুষটি জীবনে চিন্তা-চেতনায় বাবার মতো বাংলার দুঃখী মানুষকে বেছে নিয়েছেন তাঁকে নিয়ে শত বছর ধরে মহাকাব্য লেখা হবে এই বাংলায়। আফসোস! শুধু তাদের জন্য যারা এখনো জাতির পিতার ভাস্কর্যে আঘাত করে তাঁর বুকে কষ্ট দিতে চায়। তবে এ কথা ঠিক যে এ ধরনের হীন কাজ তাঁকে বিচলিত করতে পারে না। নিষ্ঠার আদর্শে কর্মে অবিচল একজন শেখ হাসিনার উদ্যোগে তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে বাংলাদেশ ফুলে ফলে ফসলে সমৃদ্ধিপূর্ণ  ঝুড়িতে পরিণত হয়।

‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে

সার্থক জনম, মাগো, তোমায় ভালোবেসে।’

লেখক : অতিরিক্ত সচিব।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর