শুক্রবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

রাগ ও অনুরাগের কথা

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী


রাগ ও অনুরাগের কথা

নিয়াজি লোকটি যে আস্ত একটি বাঘ ছিল এ কথাটি অন্যে বলবার জন্য সে অপেক্ষা করেনি, নিজেই নিজেকে বাঘ বলেছে, নাম নিয়েছিল ‘টাইগার নিয়াজি’। শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়বে বলে হুঙ্কার দিয়েছিল, বোতলের দুধ খায়নি, মায়ের খাঁটি দুধই খেয়েছে বলে বুক ঠুকেছে। কিন্তু সেই যে শার্দূল সে শেষ পর্যন্ত যে-কান্ড করল তাতে তার একেবারে আপন লোকেরাই বিশেষ লজ্জিত হয়েছে। হামুদুর রহমান কমিশন নাকি বলেছে আস্ত কাপুরুষ ছিল এই সেনাপতি। বিমানবন্দরে গিয়ে ভারতীয় জেনারেলকে অভ্যর্থনা জানাল, ওই জেনারেলকে গার্ড অব অনার দেওয়াল এবং ভারতীয়দের হাতে অস্ত্রশস্ত্র সব তুলে দিল। ধিক তাকে! শত ধিক!

কিন্তু এ রকম তো প্রায়ই হয়। বাইরে যত হুঙ্কার দেয় ভিতরে তত শক্ত নয়। গরম হলেও নরম থাকে-ভিতরে ভিতরে। আমাদের প্রবাদ বলে, যত গর্জে তত বর্ষে না। তবু গর্জাতে হয়। নইলে লোকে ভয় পায় না। ভয় না পেলে কাজ সিদ্ধ হয় না। কেউ কেউ অবশ্য গরম হয় নরম হওয়ার প্রয়োজনেই। গরজ বড় বালাই-জানেন তারা। এবং এ দেশের আমলাতন্ত্রের অসামান্য সাফল্য সাক্ষী, নরম ও গরম হওয়ার ব্যাপারে বিশেষ দক্ষতাই সাফল্যের একাধারে চাবি ও নিরিখ। আমলারা জানেন কোথায় নরম হতে হবে, কোথায় গরম। ওপরওয়ালার সঙ্গে কখনই গরম হন না, নিচুওয়ালার সঙ্গে কখনই গরম না হয়ে মুখ খোলেন না। ফলে ওপর ও নিচ উভয় পক্ষ নরম থাকে-তাঁদের প্রতি। এ দেবতা দ্বিমুখী, এবং দুই মুখো। যতই যোদ্ধা হোক, বোঝা গেছে নিয়াজিরাও আমলাই।

এটি ঠিক যে গরম মাত্রেই নরম হতে জানে, যদিও উল্টোটা ঠিক নয়, নরম মাত্রেই গরম হয় না, বহু নরম আছে সারা জীবন নরম থেকে শেষে ওই নরমভাবে যায় চলে। কোনোমতে মারা যায়। যেমন বাংলাদেশের কৃষক, নিয়াজি যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল-সেই একাত্তরে।

কিন্তু ওই যে যারা অত্যন্ত সাহসী তারা অমন ভীরু হয় কেন? গরম কেন নরম হয়ে যায়? কেন নেতিয়ে পড়ে? কারণ আছে। কারণ অন্য কিছু নয়; নৈতিক বলের অভাব। বাঘের সাহসটা শারীরিক, কিন্তু মানুষ তো আর বাঘ নয়, মানুষের সাহস শারীরিক সাহস নয়, সে-সাহস নৈতিক। নিয়াজি যখন দেশপ্রেমিক দেশপ্রেমিক বলে লম্ফ দিচ্ছিল তখন ভিতরে ভিতরে ছিল সে ভীষণভাবে আত্মপ্রেমিকই। প্রমাণ? প্রমাণ হামুদুর রহমান কমিশনই। কমিশন বলছে লোকটা নাকি জড়িত ছিল পানের চোরাকারবারের সঙ্গে। পানীয়ের নয়, একেবারে পানের। চোরাকারবারির সাহস আর কতটা উঁচু হবে? ভারতীয়দের হাতে বন্দী অবস্থায় এই বাঘ অন্যের কথা ভাবেনি, কেবল নিজের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর দিকেই নজর ছিল তার। আর ঢাকায় যখন আত্মসমর্পণের কথা তখন খোলা মাঠে কাজটি করতে ভীষণ আপত্তি ছিল এই বীরের, ঘরের ভিতর কর্তব্যটি সারতে চেয়েছিল। লোকলজ্জা? না, তা নয়। লজ্জা নয়, লোকভয় ছিল তার, লোকেরা বাঘ হয়ে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে-এই রকমের একটি আশঙ্কা করেছিল। হামুদুর রহমান কমিশন জানতে পেয়েছে। কমিশন সব জেনেছে, কিন্তু সবাইকে জানাতে পারেনি। রিপোর্ট চাপা দিয়ে দেওয়া হয়েছে।

হুঙ্কারওয়ালা বাঘেরা দুর্বল থাকে এইখানেই, এই নৈতিক দিকটায়। ভিতরে হিসাব ন’পাই-ছ’পাইয়ের, ভীষণ ভয় জনসাধারণকে, বাইরে কেবলি আস্ফালন, কেবলি গর্জন, কেবলি ব্যাঘ্রসজ্জা। জানে অন্যায় করছে, জানে ধরা পড়লে বিপদ আছে। তাই সাহস আসে না। প্রকৃত সাহস তো মুখে থাকে না, বাহুতেও নয়, থাকবার কথা মনে। অনেক তপ্তই ওইখানে শীতল।

কিন্তু বাংলাদেশের কৃষক? তার কেন সাহস নেই? এই মেহনতকারী মানুষের তো পাপ-বোধ থাকবার কথা নয়। তার তো কোনো সুযোগ নেই চুরির কিংবা চোরাকারবারের। নৈতিক দিক দিয়ে খুব সাফ-সুতরো সে। তবু তার কেন সাহস নেই? সে কেন গরম নয়? কেন সে শীতলতার প্রতিমূর্তি? না, আছে। তারও আছে পাপের বোধ। জন্মকেই পাপ মনে করে সে। মনে করে আজন্ম অপরাধী। অপরাধ করেছে অপদার্থ হয়ে জন্মগ্রহণ করে। এ-বোধ চিরকালই ছিল তার, একালে এসে আরও প্রবল হয়েছে পরিবার-পরিকল্পনার মহতী প্রচারণার ফলে। নিজেকে সেও বিচ্ছিন্ন মনে করে। বিচ্ছিন্ন বলে জানে। জন্মে একাকী, মরেও সেইভাবে। লাথি খায় যখন-তখন। বন্যায় ডোবে সে, খরায় পোড়ে। মাটির চেয়েও অসহায়। মাটির দাম আছে, তার কোনো দাম নেই। তা ছাড়া দারিদ্র্য হিমালয়কেও নুইয়ে দেয় মানুষকে নোয়াবে না কেন?

তবে কৃষকেরও রাগ আছে বইকি। রাগ করতে পারে স্ত্রীর ওপর, হয়তো বা হালের গরুর ওপর (যদি থেকে থাকে); তবে সে-রাগের তেমন কোনো সামাজিক তাৎপর্য নেই। সামাজিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে কৃষকের বিদ্রোহ। সে রাগই আসল রাগ। তা কৃষক বিদ্রোহ হয়েছে বইকি আমাদের দেশে। নানা সময়ে হয়েছে। একাত্তরেও দেখেছি আমরা, কৃষক অস্ত্র তুলে নিয়েছে হাতে। যার জন্য পতন ঘটল নিয়াজিদের। কিন্তু কৃষকের এ বিদ্রোহকে উৎসাহিত করা হয়নি কখনো। করবার কথাও নয়। শাসকরা ও তাদের ফেউরা বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার ওপর। একজন তোরাপ বা একজন হানিফকে মর্যাদাদান করতে হলে বিশেষ চোখ দরকার হয়। হানিফ তোরাপের ‘সমুন্দি’ বলে গাল দেওয়া শুনতে হলে বিশেষ কান চাই। আবশ্যক হয় একজন দীনবন্ধুর, একজন মাইকেল মধুসূদনের। তাদের আমরা পাব কোথায়?

সবচেয়ে বড় কথা, বিদ্রোহগুলো বিচ্ছিন্ন থেকেছে, তাদের ধরে রাখা যায়নি, তারা ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় এগোয়নি সামনের দিকে। কৃষকের বাংলা-রাগকে ধরে রাখার মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি কৃষকের এই দেশে; তার সংস্কৃত-রাগকে, অর্থাৎ অনুরাগকে, কখনো কখনো প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে নানা ধরনের গানে, কিংবা যাত্রাপালায়, অথবা লোককাহিনিতে। প্রেমিক কৃষক অনেক পেলাম, বিদ্রোহী কৃষক পেলাম না।

এমনিতেই প্রতিষ্ঠানের বড় অভাব এই রকম ভূমিতে। গড়া কঠিন, রক্ষা করা কঠিনতর। শিগগিরই স্তিমিত হয়ে আসে উৎসাহ। দখল নিয়ে মাথা কাটাকাটি ফাটাফাটি হয়। গড়া প্রতিষ্ঠানের ভগ্ন কিংবা জরাজীর্ণ-দশা গড়বার আগ্রহকে ব্যঙ্গ করতে থাকে।

এমনকি সাহিত্যের ব্যাপারেও এ-ব্যাপারটা দেখা যায়। সাহিত্যে যে সত্যি-সত্যি জীবনের দর্পণ বোঝা যায় সেটি আমাদের সাহিত্যের সংগঠন-বিরূপতা থেকে। নাটকের অভাব আছে সাহিত্যে। তার একটি কারণ সাহিত্যের এ রূপকল্পটি ভীষণভাবে গঠননির্ভর। উপন্যাস আছে আমাদের, কিন্তু উপন্যাসের ব্যাপারে একটি তাৎপর্যপূর্ণ অনীহা রয়ে গেছে ভিতরে-ভিতরে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন, ইউরোপীয় উপন্যাসে মানুষের ভিড়টা ভালো লাগেনি তাঁর। নবীন সেন, নিজে যিনি ইংরেজি সাহিত্যে অনুরাগী ছিলেন, তিনি বঙ্কিমচন্দ্রকে নিষেধ করেছিলেন উপন্যাস লিখতে। বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, বাংলা উপন্যাস শুরুতেই একটি ভুল করে বসেছে, বাইরের জগৎটিকে দেখতে চেয়েছে, তার উচিত ছিল মানুষের মনের ভিতর ঢুকে পড়া। অতিসাম্প্রতিক লেখক বলেছেন, উপন্যাস ঘটনার ক্রীতদাস, যে জন্য তিনি উপন্যাস পছন্দ করেন না, মুক্ত কবিতা চান। এ অনীহার, কিংবা বলা যায় বিরূপতার আরও কারণ থাকতে পারে, তবে একটি কারণ মনে হয় সংগঠন-বিমুখতাই। একেকটি উপন্যাস একেকটি প্রতিষ্ঠান, তাকে গড়তে হয় ইহজাগতিক জনপদে, তার দরজা-জানালা খুলে রাখতে হয়, অনেকে যাতে আসতে পারে, অন্তত জানিয়ে দিতে পারে যে তারা আছে। আমাদের প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ গ্রামীণ স্বয়ংসম্পূর্ণতা কেবল সে সামাজিকভাবে সত্য তা তো নয়, মনস্তাত্ত্বিকভাবেও সত্য। গ্রামের-বিচ্ছিন্নতা নানাভাবে ঘুচছে ঠিকই, কিন্তু সে জায়গায় যদি শহরের বিচ্ছিন্নতা এসে যায় তবে কী করা?

রাজনীতিতেও-যার প্রধান শর্তই সংগঠন-সেখানেও সংগঠনে আস্থা দেখা যায়নি। এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান-এঁরা প্রত্যেকেই নেতা হিসেবে অসামান্য; কিন্তু প্রতিষ্ঠান তাঁদের বড় করেনি, তাঁরাই প্রতিষ্ঠানকে বড় করেছেন। আমাদের দেশে চিরকাল আমরা নেতা খুঁজেছি, কিন্তু নেতাকে সংগঠন গড়তে, কিংবা গড়া সংগঠন টিকিয়ে রাখতে উৎসাহিত করিনি। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘সভ্যতার সঙ্কট’ নামে তাঁর অসাধারণ রচনায়, ‘আজ আশা করে আছি, পরিত্রাণ কর্তার জন্মদিন আসছে।’ ওই আশা তো আমাদের সবারই। অসহায় মানুষ তাকিয়ে থাকে কবে আসেন পরিত্রাণ কর্তা। অনেকে আসেন, আসে বহু জন্মদিন, কিন্তু ত্রাণকর্তা আর আসেন না। আসল কথা তো এটাও যে, কোনো কর্তারই সাধ্য নেই ত্রাণ করেন একাকী, তা তিনি ব্যক্তি হিসেবে যতই বড় হোন, তার জন্য সংগঠন চাই, প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা আছে, এবং থাকবেই; কিন্তু কোনো ব্যক্তিই ইতিহাসের স্রষ্টা নন, বরং নিজেই তিনি ইতিহাসের সৃষ্টি-একটি। এই সাধারণ মানুষকে অসাধারণরূপে দুর্বল করে রাখা হয়েছে আমাদের সংস্কৃতিতে। লু সুন তাঁর একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘বানর বানর হয়েই রইল তার অভ্যাস ছাড়ল না বলে।’ এতে কোনো মিথ্যা নেই। আমাদের অনেক মানসিক অভ্যাসই অবশ্য পরিত্যাজ্য।

রাগ জিনিসটা না থাকলেই নয়। অনুরাগের চেয়েও বেশি দরকার রাগের। খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী দেখলাম লিখেছেন, ‘সৃষ্টিশীল শিল্পীদের জগতে নারী ঈশ্বরীর তুল্য, যে-আগুনে পুড়ে ভাজা-ভাজা না হলে মানুষের গভীর সন্ধান পাওয়া যায় না সেই আগুনই নারী।’ এ মন্তব্য পড়ে বিদুষিণী মহিলা একজন জিজ্ঞাসা করেছেন, শিল্পী যদি নিজেই নারী হন তবে এই পুড়ে ভাজা-ভাজা হবার জন্য প্রয়োজনীয় আগুনটি তিনি পাবেন কোথায়? অন্য একজন নারীতে? না-কি পুরুষে? সংগত প্রশ্ন বটে। সঙ্গে সঙ্গে এও বলা যায় যে, শিল্পের জন্য কেবল অনুরাগের নয়, রাগের আগুনও অত্যাবশ্যকীয়। জীবনের জন্যও তাই। প্রেম নয় কেবল, ঘৃণাও প্রয়োজন। সত্য এই যে, ঘৃণাহীন প্রেম কাম হতে পারে, মোহ হতে পারে, কিন্তু কিছুতেই প্রেম নয়। রাগ অনুরাগকে পোড়ায়, পুড়িয়ে তার তুচ্ছতাকে ছাই করে, তার মহত্ত্বকে খাঁটি করে তোলে। কমেডি তাঁরাই ভালো লেখেন যাঁরা ট্র্যাজেডি লিখতে জানেন। এই যে আমরা আমাদের দেশে প্রেমকেই একমাত্র সত্য করে তুলতে চাইছি, প্রেমিক সেজে প্রতিনিয়ত বুক চাপড়াচ্ছি এ-ই আমাদের অনগ্রসরতার প্রাথমিক কারণ। মানুষের সভ্যতার   ইতিহাস দমকেরই ইতিহাস। আমাদের দেশে ধনী ধমক দেয় গরিবকে, গরিব সে ধমক ফেরত দেয় না; তার ফলে সভ্যতা এগোয় না। ধমক-খাওয়া মানুষ তার চাষ-করা ধান গাছগুলোর মতোই ম্রিয়মাণ হয়ে থাকে। ফসলে সোনা ফলে, সে সোনা সে খুঁজে পায় না।

রাগ আছে মানুষের; কিন্তু সে-রাগ ধরে রাখার ব্যবস্থা নেই। থইথই পানি আসে বর্ষায়, তবু পানি পাওয়া যায় না তখন যখন খরা নামে মরুভূমির। সে জন্যই মরণদশা আমাদের।

ব্যবস্থা আছে এই রাগকে প্রশমিত, বিভ্রান্ত, পারলে অবলুপ্ত করবার। ভয় আছে শাসনের। তপ্ত রক্তচক্ষুগুলো জ্বলে-জ্বলে ওঠে। ধমক দেয়। বলা হয় মিলন, সামঞ্জস্য, ঐক্য, সমন্বয়-এ-সব চাই। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য চাইতে থাকি, কিন্তু ধনী ও দরিদ্র ঐক্য বলে যে কিছু নেই তা বোঝা হয় না। আগের কবি বলেছেন তপোবনের কথা, একালের কবি বলেন বাগান দরকার। কিন্তু আসলে যা চাই তা তপোবনও নয়, বাগানও নয়, চাই আলোকিত ঘর। যে-ঘরে ডাকাতদের হামলা হবে না। জানবে ডাকাতরা যে গৃহকর্তা যতই অনুরাগী হোক, ঠিক বৈষ্ণব নয়, তার ঘৃণা জেগে আছে প্রকৃত বাঘ হয়ে। অতএব সাবধান। এই রাগের অভাবে যথার্থ অনুরাগের অভাব ঘটছে। রাগী ছোকরারা হয় রকবাজি করছে নয় তো প্রেম করব বলে চিঠি ছুড়ে মারছে স্কুল-ছাত্রীর উদ্দেশে। রাগের অভাবে নানা ধরনের ও মাপের ডিগবাজি দেওয়াটা ঘৃণার্হ না হয়ে বীরত্ব প্রকাশের নামান্তর হয়ে দাঁড়াচ্ছে-বারে-বারে।

বাংলাদেশে আজ তাই সুসংগঠিত ঘৃণার প্রয়োজন। ব্যক্তিগত বীরত্বে অনেকেই আস্থা রাখেন, সে বীরত্বে ব্যক্তিকে মহিমা দিতে পারে হয়তো, কিন্তু সমষ্টির ভাগ্যে পরিবর্তন আনতে পারে না। সেই ঘৃণা চাই আমাদের যা গোঁয়ার্তুমি নয়, ঈর্ষা নয়, ঔদ্ধত্য নয়, অহংকারও নয়। প্রয়োজন সেই রাগ যা অনুরাগেরই পূর্বশর্ত। এ পাতানো লড়াইতে বিশ্বাস করে না, এবং আসল লড়াইকে ভয় করে না। সে বিচ্ছিন্ন নয়, হঠাৎ ঝলক নয়। একমুখো সে, নিরবচ্ছিন্ন।

সংগঠনে আমলাতান্ত্রিকতা থাকে; কিন্তু রাগ যদি স্থায়ী হয় তবে আমলাতান্ত্রিকতার সাহস কি স্থায়ী হবে। আগুনের মতো শক্তিশালী স্থায়ী সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আগুন রাগ ছাড়া অন্য কারও সাধ্য নেই জ্বালিয়ে রাখে। অনেক শোনা ভালোবাসার কথা না বলে এখন তাই বরং ঘৃণার কথা কিছু বলুন-যদি পারেন। ঘৃণার কথা বলা অবশ্য কঠিনই। সেদিন এক গবেষণা বিবরণ পড়লাম, স্বদেশি গবেষক গবেষণা করে প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন বিদেশি পত্রিকায়, একাত্তরের নভেম্বরে। গবেষণা করেছিলেন আটষট্টির শেষে, সেই সময়ে যখন উত্তাল গণ-আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। গবেষণার স্বার্থে তিনি তখনকার পশ্চিম পাকিস্তানে গেছেন, পূর্ব পাকিস্তানে তো ছিলেনই। ছাত্রদের ধাওয়া করেছেন, কোয়েশ্চেনেয়ার হাতে, এবং পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্ররাই নাকি দেখা গেছে, দেখতে পেয়েছেন বাঙালি গবেষক-পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে নিয়ে গর্ব করছে বেশি, কেননা সেই সেনাবাহিনী ভারতের সঙ্গে সাহসের সঙ্গে লড়েছিল পঁয়ষট্টিতে। অনুরাগের খোঁজ করেছিলেন গবেষক সেটি পেয়ে গেছেন, পেয়ে মস্ত প্রবন্ধ ফেঁদেছেন, এবং ইতিমধ্যে বাংলাদেশ না হয়ে গেলে সোনার মেডেল পেতে পারতেন; কিন্তু বাঙালির রাগের খবরটা পাননি, বা পেতে চাননি। পেতে অনেকেই চাইবেন না। তবু রাগটা ছিল। ছিল বলেই বাংলাদেশ হলো। রাগ এখনো আছে। যেমন হৃৎপি- আছে দেহের ভিতর। এবং সত্যিকারের ভরসা তো সেটাই। অনুরাগ নয়, রাগই সম্বল আমাদের জন্য। অনেক তো ভিজলাম কাকের মতো, এবার তপ্ত হওয়া চাই মানুষের মতো।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর