শুক্রবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

মানুষ কখনো হারে না

অধ্যাপক ডা. রওশন আরা বেগম

মানুষ কখনো হারে না

বৈশ্বিক মহামারী নাকি অতিমারী যা-ই বলি না কেন সারা পৃথিবীকে পাসপোর্টবিহীন করে সে একাকার করে দিয়েছে সব মানব জাতিকে এক কাতারে। অবাক বিস্ময়ে হতবাক হয়ে অসহায় হয়ে পড়েছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব মানবকুল। ডলফিন তার ভাষায় গান গাইছে, পাহাড় সবুজের ঘ্রাণ নিয়ে হাসছে, পাখিরা আনন্দে পাখা মেলে আকাশে উড়ছে, ঘননীল আকাশ সমুদ্রের সঙ্গে মিলে আনন্দ করছে। প্রকৃতির এ আনন্দে পৃথিবীর মানবকুল স্তম্ভিত।

পরিবারের সবাই আবার এক ছাতার নিচে একে অন্যকে চেনার চেষ্টা করছে। এর মধ্যেই বেড়েছে অশান্তি। একে অন্যকে সাহায্য করার মধ্যে বিতৃষ্ণা, অবিশ্বাস, নির্যাতন বেড়েছে। এত বড় একটা অতিমারীও মানুষকে মানুষ হতে দেয়নি।

মার্চ থেকে জীবনের এ যুদ্ধ দেখতে দেখতে প্রতিদিনই মনে হয়েছে কালকের ভোর কেমন হবে? ফেসবুক খুলতেই বুক কেঁপে উঠেছে, মধ্যরাতের সংলাপে বাবার মৃত্যু কাহিনির বর্ণনা শুনে আমি মাঝপথে উপস্থাপককে ফোন করেছি এ দৃশ্য না দেখাতে, মানসিক ভারসাম্য রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। তবু দেখেছি, মন শক্ত করে আবার দাঁড়াবার চেষ্টা করছি। রুমমেট, বন্ধু, সহপাঠী পরিচিত মুখ প্রতিদিন হারিয়ে যাচ্ছে। পরিবারের অনেকেই পড়েছিল ভয়ঙ্কর আক্রমণে, মধ্যরাতে ওষুধের জন্য ড্রাইভারসহ পরিজন অনেককে দৌড়াতে হয়েছে। নানা জনে ফোনে অনুরোধ করেছেন একটা সিট যেন হয়। এর জন্য সব সময় করতে না পারার ব্যর্থতায় দুমড়ে মরেছি। তার পরও জীবন থেমে থাকেনি ভোরের একটু আলোয় জীবন যেন থেমে না যায় যেখানে যাকে যেটুকু বলবার বলতে চেষ্টা করছি। তৃণমূলের অনেকের সঙ্গে কথা হয়েছে। কত কষ্ট করে তারা চিকিৎসা দিচ্ছে। অনলাইনে চিকিৎসাপত্র দেখে চেষ্টা করছেন। রোগী ভালো হচ্ছে, কেউ কেউ শহরে চলে আসছে। তবু তারা হতাশ হয়নি। ওদের কথা কেউ শোনেনি। কোনো প্রণোদনার কথাও চিন্তা না করে ওরা কাজ করে চলেছে। আমি সামান্য বলার সাহস রেখে মাঝেমধ্যে লিখেছি ফেসবুকে, সামাজিক মাধ্যমে। নিজের মধ্যে কখনো কখনো সাহস হারিয়ে ফেলেছি। দিন চলছে রাত পার হচ্ছে, সাহস বাড়ছে। পৃথিবীর সঙ্গে তুলনা করে পরিসংখ্যান করে চলছি, আমাদের এত সীমিত সম্পদের মাঝে আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার চেষ্টা করছি।

পাশাপাশি দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাতে পশ্চিমা দেশগুলোর অবস্থা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিল। টেলিফোন পাচ্ছি অনেক জায়গায়ই বিছানা খালি নেই, অ্যাম্বুলেন্সের লাইন রাস্তার মধ্যেই দাঁড়িয়ে আছে। অবাক পৃথিবী। এত বড় সাম্রাজ্য তাদের, এত বৈভব-মাথা উঁচু করে পৃথিবীর ছোট দেশকে তারা সাহায্যও করছে আবার বিভিন্ন দেশের মাঝে অশান্তি সৃষ্টির কাজে তারাও বেশ অগ্রগণ্য। নিজেদের বাঁচাবার তাগিদে তারাই আবার ভ্যাকসিন নির্মাণে এগিয়ে আছে তাদের অনেক দেশই তৈরি করছে। তারাও নিজেকে রক্ষা করেছে ভ্যাকসিন নিয়ে এবং সবচেয়ে অবাক কান্ড, ভ্যাকসিন নিলেও প্রায় প্রতিদিন একটা লম্বা মৃত্যুর মিছিল চলছে। কোনোভাবেই বিশ্বের ওইসব দেশ সামাল দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। আমাদের অনেকের সন্তান ওইসব দেশে আছে। কেউ পড়াশোনা করছে, কেউ চাকরি করছে। নাগরিকত্ব পেয়ে ওখানে স্থায়ী হয়ে আছে, আমাদের জন্য ওদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। আমাদেরও ঘুম নেই ওদের কথা ভেবে।

আমাদের সীমিত সম্পদ, নানা কুসংস্কার, তার মধ্যেও অনেক দুর্নীতির পাহাড়ে আমরা প্রথমেই ধাক্কা খেয়েছি, তার পরও আমরা উঠে দাঁড়িয়েছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে হাল ধরে ছিলেন এবং এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন।

আমাদের নতুন প্রজন্মের চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী সবাই পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বাইরে থেকে অনেকে মন্তব্য করেন আমাদের পরিসংখ্যান ঠিক হচ্ছে না। তাদের দুশ্চিন্তা এখানে চিকিৎসা পদ্ধতিও ঠিকমতো হচ্ছে কিনা সন্দেহ। বিশ্বের এ ডিজিটাল যুগে কোনো দেশই তার সামান্যতম ত্রুটি-বিচ্যুতি লুকিয়ে রাখতে পারবে না। এমনকি ডিজিটাল যুগে গণমাধ্যম-সামাজিক মাধ্যম ইত্যাদিতে পৃথিবীর ছোটখাটো সব সংবাদ সবাই পেয়ে যায়, কাজেই কোনো জায়গায়ই লুকোবার কিছু নেই।

আমরা অনেককে হারিয়েছি, অনেকে ভুগছে, করোনা-পরবর্তী জটিলতায় অনেকে কষ্ট পাচ্ছে। আমাদের স্বাস্থ্যকর্মী-চিকিৎসক সমাজ সবার জন্য অবারিত রয়েছেন, পরামর্শ দিচ্ছেন। তরুণ চিকিৎসকরা দিনরাত চেষ্টা করছেন। নতুন কোনো চিকিৎসা আসছে কিনা, কীভাবে আরও ভালোভাবে করোনা সমস্যা সমাধান করা যায় তার চেষ্টায় নিজেদের জীবন বাজি রেখে কাজ করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের আপামর জনতা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ, মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আজ তারা ভ্যাকসিন নেওয়ার সম্মান অর্জন করেছেন।

পৃথিবীর অনেক দেশই এখনো ভ্যাকসিন নেওয়ার সুযোগ পায়নি, অথচ বাংলাদেশে তৃণমূল পর্যন্ত ভ্যাকসিন নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। ঘাত-প্রতিঘাত নানা কিছুর মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা পৃথিবীর মানচিত্রে একটা স্থান করে নিয়েছে। আমরা তা ধরে রাখতে চাই। জীবন-জীবিকার তাগিদে মানুষ চলছে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া। কেউ দিনের আহার জোগাতে ব্যস্ত, কেউ রিসোর্টের বুকিং দিতে ব্যস্ত, কেউ বাড়ির ফটকে হেলিপ্যাডে নেমে কফির কাপে চুমুকে ব্যস্ত। তবু বাংলাদেশ তার মাথা উঁচু করে করোনাকে জয় করেছে। সামনের ভোরের সূর্য আরও আলোকিত হোক। করোনার অভিশাপ থেকে এ মাটি এ পৃথিবী মুক্ত হোক। মুক্ত আমরা করবই। কারণ মানুষ হারতে পারে না।

লেখক : সাবেক বিভাগীয় প্রধান (প্রসূতি ও স্ত্রী রোগ বিভাগ)

হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। সাবেক সভাপতি, ওজিএসবি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর