সোমবার, ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

পুতুলের পরিবর্তে পুতুল মাস্টার এখন মঞ্চে

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

পুতুলের পরিবর্তে পুতুল মাস্টার এখন মঞ্চে

সামরিক শাসকরা বেশি স্মার্ট, নাকি রাজনীতিকরা বেশি স্মার্ট। কথাটি নিয়ে বিতর্ক করা যায়। তবে কোনো কিছুই একতরফা হয় না, ব্যতিক্রম থাকে। মিয়ানমারের সামরিক কর্তৃপক্ষ, যারা রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, তারা ঝানু পোড় খাওয়া নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত রাজনীতিক অং সান সু চিকে দিয়ে গত পাঁচ বছর ইচ্ছামতো সবকিছু করিয়ে তারপর গত ১ ফেব্রুয়ারিতে যেভাবে ছুড়ে ফেলে দিল তাতে তিনি আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে সমহিমায় ফিরে আসবেন সেই সম্ভাবনা আর নেই বললেই চলে। অনেকেই বলছেন সু চি অধ্যায়ের এখানেই শেষ। পাঁচ বছর সামরিক কর্তৃপক্ষের অনুগত হয়ে যা যা করেছেন তাতে পিতা অং সান এবং নিজের সারা জীবনের অর্জিত ক্রেডেনশিয়াল সবকিছু ধুলার সঙ্গে মিশে গেছে। তিনি কি রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণে ভুল করেছেন, নাকি ক্ষমতার মোহে সব বিসর্জন দিলেন তার বিচার বিশ্লেষণ হয়তো একদিন হবে। বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের ন্যায় আরেকবার প্রমাণ হলো গণতন্ত্রের আদর্শে বিশ্বাসী রাজনীতিকরা সামরিক শাসকদের সঙ্গে আপস করলে চূড়ান্ত বিচারে তার ফল কখনো ভালো হয় না। বাংলাদেশের মানুষ আমরা এটা ভালো করেই দেখেছি। বাংলাদেশের প্রথম সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান যেমন অনেক অভিজ্ঞ রাজনীতিককে এক হাতে তুলেছেন আবার অন্য হাতে ফেলে দিয়েছেন, তেমনি দ্বিতীয় সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ অত্যন্ত অভিজ্ঞ ঝানু দুজন রাজনীতিক আতাউর রহমান খান ও মিজানুর রহমান চৌধুরীকে কিছু দিন ব্যবহার করার পর এমনভাবে ছুড়ে ফেলে দিলেন, যেখান থেকে তারা আর কখনো রাজনীতির মাঠে উঠে দাঁড়াতে পারলেন না। তবে বিশ্বের কোথাও সামরিক শাসকদের শেষ পরিণতি ভালো হয়নি। যদিও এ কথাটি বোধ হয় মিয়ানমারের জন্য প্রযোজ্য নয়। ১৯৬২ থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৬০ বছর মিয়ানমারের সামরিক শাসক, যে বা যারাই এসেছেন তারা কেউ-ই অন্যান্য দেশের সামরিক শাসকদের ন্যায় করুণ পরিণতির মধ্যে পড়েননি। সে কারণেই হয়তো এবার সু চিকেও ফেলে দিতে তারা একটু ভয় পায়নি। ২০১৫ সালে যত নন্দিত হয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন ততখানিই নিন্দিত হয়ে অং সান সু চিকে বিদায় নিতে হলো। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেস সামরিক অভ্যুত্থানের কড়া সমালোচনা করেছেন। বলেছেন এটা গ্রহণযোগ্য নয়। তবে গুতেরেস এ কথাটিও বলেছেন, গত পাঁচ বছর সামরিক কর্তৃপক্ষের সব কর্মের প্রোটেকশন দিয়েছেন অং সান সু চি। জাতিসংঘ এবং পশ্চিমা বিশ্ব যত কিছু বলুক বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে চীনের অবস্থানের কারণে অং সান সু চি আবার উঠে দাঁড়াবেন তা আর মনে হয় না। গত ৫৮ বছরে প্রমাণ হয়েছে পশ্চিমা বিশ্বের অবরোধ আর হুঙ্কারকে সামরিক কর্তৃপক্ষ তোয়াক্কা করে না। দেড় দশক গৃহবন্দী থাকার সময়ই জাতীয় নেতা থেকে আন্তর্জাতিক তারকা হয়ে যান অং সান সু চি। পেয়ে যান অনেক খ্যাতি। শান্তি প্রতিষ্ঠায় কিছু করার আগেই ১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়ে যান। পশ্চিমা বিশ্বের কাছ থেকে আরও নামিদামি পুরস্কার জুটে যায়। তখনই অনেকে ধারণা করেন চীনের খপ্পর থেকে মিয়ানমারকে বের করার জন্য পশ্চিমা বিশ্বের থিঙ্কট্যাংকগুলোর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সু চিকে আগাম নোবেল শান্তি পুরস্কারসহ বহু রকম খেতাবে ভূষিত করা হয়। দেশে-বিদেশে সর্বত্র সু চিকে জনপ্রিয় আইকনে পরিণত করা হয়। বলা হয়ে থাকে পশ্চিমা বিশ্বের মিডিয়া পুরুষকে নারী, আর নারীকে পুরুষ করা ব্যতীত বাকি সবই করতে পারে। সু চির জন্য একটা বাড়তি সুবিধা ছিল। তিনি মিয়ানমারের স্বাধীনতা সংগ্রামের শীর্ষ জনপ্রিয় নেতা অং সানের মেয়ে। সংগত কারণেই বন্দী থাকা অবস্থায়ই অল্প কয়েক বছরের মধ্যে বিশাল জনপ্রিয় নেতা হয়ে ওঠেন সু চি। ১৯৬২ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ৫৮ বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করছে সেনাবাহিনী। তাই বলা যায় দেশের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও ঝানু রাজনৈতিক দল হচ্ছে সেনাবাহিনী। দেশের অভ্যন্তরে সেনাবাহিনী যা কিছু করতে পারে। কিন্তু পথিমধ্যে এসে সু চি বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং সু চির গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তাকে শেষ করে দেওয়ার সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক ফাঁদ তৈরি করে সেনাবাহিনী। ২০০৮ সালে সেনাবাহিনী নিজেরা একটা সংবিধান তৈরি করে। তাতে নিম্ন ও উচ্চকক্ষ মিলে ৬৬৪ সদস্যের আইন সভায় এক-চতুর্থাংশ, অর্থাৎ ১৬৬টি আসন সেনাবাহিনীর জন্য সংরক্ষিতসহ প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র ও সীমান্ত বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী সেনাবাহিনীর জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা হয়। সু চি যাতে প্রেসিডেন্ট না হতে পারেন তার জন্য সংবিধানে বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়। বিধান করা হয় সংবিধান সংশোধন করতে হলে উভয় পক্ষ মিলে তিন-চতুর্থাংশ ভোটে তা পাস হতে হবে। সব আঁটঘাট বেঁধেই সু চিকে রাজনৈতিক মাঠে খেলার সুযোগ দেয় সেনাবাহিনী। ২০১৫ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে পাঁচ বছর সেনাবাহিনীর পুতুল হিসেবে কাজ করেছেন সু চি নিজে ও তার সরকার, যে কথা জাতিসংঘের মহাসচিবও বলেছেন। বিশাল জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও সেনাবাহিনীর বেঁধে দেওয়া রুলসের বাইরে শট করার সাহস দেখানোর চেষ্টাও করেননি। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী গণহত্যাসহ সব ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে, যেটি জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সর্বত্রই এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য। অথচ শান্তিতে নোবেল বিজয়ী নেত্রীর সরকার তা ঠেকানোর জন্য কিছুই করলেন না, বরং আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে স্বয়ং নিজে সশরীরে উপস্থিত হয়ে সু চি সেনাবাহিনীর পক্ষে উকালতি ও সাফাই গাইলেন, বললেন এরকম কিছুই হয়নি। ব্যস, এতেই সেনাবাহিনীর লক্ষ্য অর্জিত হয়ে যায়। বিশ্বব্যাপী সু চির বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় ওঠে। অনেক আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। এমনকি নোবেল শান্তি পুরস্কার ফিরিয়ে নেওয়ার প্রবল দাবি ওঠে। আইকন থেকে ভিলেনে পরিণত হন সু চি। কিন্তু সেনাবাহিনী দেশকে যেভাবে চীনের রক্ষিতায় পরিণত করছে তার বিরুদ্ধে জনমতের প্রতিফলন ঘটে ২০২০ সালের নির্বাচনে, পূর্বের থেকে বেশি আসন পায় সু চির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি, এনএলডি। সেনা সমর্থিত দলের আসন উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাওয়ায় সু চির দলের সঙ্গে অন্যান্য দল সংঘবদ্ধ হলে সেনা ক্ষমতার রক্ষাকবচ ২০০৮ সালের সংবিধানের জন্য সেটা হুমকি হয়ে ওঠতে পারে। সুতরাং সময় থাকতে বিদ্রোহ করার আগেই পুতুল সরিয়ে সেনাবাহিনী নিজেরাই মূল মঞ্চে হাজির হয়েছে। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। বিশ্বের রাজনৈতিক মঞ্চে মেকিয়েভেলি এখন খুবই জনপ্রিয়। নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরেই নিশ্চিত হয়ে যায় এরকম একটা কিছু ঘটবে। কয়েকটি সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করি। প্রথমত, ২০১৭ সালে রাখাইনে গণহত্যার প্রধান অভিযুক্ত, বর্তমান সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইংকে আগামী জুলাই মাসে অবসরে যেতে হবে। নিজের রক্ষাকবচ হিসেবে তিনি রাষ্ট্রের ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকতে চাইছেন এবং তার জন্য পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হওয়া ব্যতীত অন্য কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু অং সান সু চির দলের আইন সভায় বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতার সঙ্গে অন্যান্য বিরোধী দল ঐক্যবদ্ধ হলে সেটা হয়তো সম্ভব না হতে পারে। সংগত কারণেই সামান্য ঝুঁকিও তিনি নিতে চাইবেন না সেটাই স্বাভাবিক। দ্বিতীয়ত, এবারের নির্বাচনে আইন সভার মোট ৬৬৪ আসনের মধ্যে সু চির দল ৩৯৬ এবং অন্যান্য বিরোধী দলের ৪৭টি আসন প্রাপ্তিতে সেনাবাহিনীর সর্বময় ক্ষমতার মূল চাবিকাঠি ২০০৮ সালের সংবিধান হুমকির মুখে পড়েছে। সেনাবাহিনীর ভিতরে বড় রকম গ্রুপিং রয়েছে, বিশেষ করে সাবেক প্রেসিডেন্ট থিন সেইলের অনুগতরা অনেক শক্তিশালী, যারা বর্তমান সেনাপ্রধানের বিরোধী। তাই আইন সভার অধিবেশন বসলে সেনাবাহিনীর সংরক্ষিত ১৬৬ সদস্যের মধ্য থেকে যদি ৫৫-৬০ জন সংবিধান সংশোধনীর পক্ষে অবস্থান নেয় তাহলে বর্তমান সেনাপ্রধানের সব হিসাব উল্টে যাবে। তৃতীয়ত, সু চির দলের র‌্যাংক ও ফাইলের মধ্যে চীনবিরোধী মনোভাব প্রবল, যা চীনের জন্য অতিরিক্ত শঙ্কার কারণ। ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের আগে চীন ও রাশিয়ার একটা সম্মিলিত সরকারি ডেলিগেশন মিয়ানমার সফর করে যায়। অনেকেরই ধারণা চীনের সম্মতিক্রমেই অভ্যুত্থান ঘটেছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত নিন্দা প্রস্তাবে চীন-রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে এবং চীনের প্রতিনিধি বলেছেন, মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান নয়, মন্ত্রিসভার রদবদল ঘটেছে। চতুর্থত, আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনকে চীন এই মর্মে একটা বার্তা দিলেন যে, অত্র অঞ্চলে কর্তৃত্ব ও প্রভাব বজায় রাখার ব্যাপারে চীন বদ্ধপরিকর। জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে গণহত্যা চলছে মর্মে আমেরিকার নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্তনি ব্লিংকেনের বক্তব্যে চীন অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। এতকিছু ঘটার পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কী হবে সেটাই বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে আমাদের প্রধান ভাবনা। গণতন্ত্রের আদর্শে বিশ্বাসী মানুষ সামরিক শাসন সমর্থন করতে পারে না, এটা নীতিগতভাবে সঠিক হলেও বাস্তবতার নিরিখে মিয়ানমারে কারা সরকারে থাকবে না থাকবে তা নিয়ে মন্তব্য করার আগে আমাদের অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের একমাত্র লক্ষ্য রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো। মিয়ানমারে যে সরকারই থাকুক তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে আগের মতো সব ফ্রন্টে শক্তিশালী আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে। চীন কখনই মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করবে না এবং সে কারণেই মিয়ানমার সেনাবাহিনী সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী থাকবে। এতদিন সামনে অং সান সু চির সরকার থাকলেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে যা কিছু হয়েছে তার সবকিছুই সেনাবাহিনীর সম্মতিক্রমেই হয়েছে। সুতরাং পুতুল সরে গিয়ে মাস্টার সামনে আসাতে বরং ভালোই হলো। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে অং সান সু চির সরকারের চেয়ে সেনাবাহিনীর সরকার অধিকতর ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আমার মনে হয়। কারণ, পুতুলের চেয়ে পুতুল মাস্টারই বেশি কার্যকর হয়।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]

 

সর্বশেষ খবর