মঙ্গলবার, ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

আমাদের কি কিছুই করার নেই?

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

আমাদের কি কিছুই করার নেই?

আমাদের আত্মার আত্মীয় আপনজন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহর স্ত্রী অধ্যাপক মাহমুদা বেগম সেদিন আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। স্বামী-স্ত্রী প্রায় একসঙ্গে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। যতবার ফোন করেছি এ বি এম আবদুল্লাহ স্ত্রীর জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, ‘আমার চাইতে আমার স্ত্রীর অবস্থা খারাপ।’ একসময় করোনামুক্ত হয়ে বেডে ফিরেছিলেন। কিন্তু সেদিন হঠাৎই শুনলাম চলে গেছেন। বড় খারাপ লেগেছে। পর আপন হয় এটা জীবনের শুরু থেকেই দেখেছি। কিন্তু এত আপন হয় তা জানতে বাকি ছিল। আমাদের কারও শরীর খারাপ শুনে উতলা হয়ে যান। কদিন আগে বড় মেয়ে কুঁড়ি অসুস্থ হয়েছিল। কি যে যত্ন নিয়েছেন বলে বোঝানো যাবে না। অধ্যাপক মাহমুদা বেগমের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।

পাশের দেশ মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা নিয়ে নিয়েছে। সেখানে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা নেওয়া নতুন নয়। ষাটের দশকে সামরিক সরকার ক্ষমতায় এসেছিল, আইয়ুব খানও আমাদের দেশের ক্ষমতা দখল করে ১০ বছর গোলাম করে রেখেছিল। তারপর কত জীবন, কত রক্ত, কত ত্যাগ-তিতিক্ষার পর ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতি গণতান্ত্রিক পথে তার আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। কিন্তু আইয়ুব-ইয়াহিয়ার বাহিনী বাঙালির সেই ইচ্ছাকে মর্যাদা দেয়নি। বাঙালির ভোটের অধিকার পদদলিত করে ট্যাংক-কামান-বন্দুক নিয়ে রাস্তায় নেমেও শেষ পর্যন্ত দুর্জয় বাঙালিকে পরাভূত করতে পারেনি। ভেতো বাঙালি নামে খ্যাত আমরা আমাদের রক্ত দিয়ে জীবন দিয়ে পাকিস্তানিদের পরাজিত করেছিলাম। আজ আমাদের যত কষ্টই হোক তবু আমরা স্বাধীন। আমাদের দেশ আছে, পতাকা আছে, বিশ্বদরবারে আমাদের পরিচয় আছে এটা একেবারে কম কথা নয়। বাংলাদেশ আরও অনেক এগিয়ে যেত, আমাদের মান-মর্যাদা, আমাদের সম্মান বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ত। কিন্তু পরাজিত স্বার্থান্বেষী চক্র স্বাধীনতার নেতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে দেশের চাকা উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিল। যে যাই বলুন, আমরা এখনো উল্টোরথেই আছি। দেশকে এখনো আমরা গতিময় সমৃদ্ধির দিকে, মানবতার দিকে, মানুষের মুক্তির দিকে এগিয়ে নিতে পারিনি। প্রায় সবাই যার যার মতো চেষ্টা করছে। কিন্তু এখনো জাতির উন্নতি অগ্রগতি ও প্রশান্তির চাকা সঠিক দিকে ঘোরাবার জন্য কেন যেন কোনোভাবেই আমরা সবাই এক হতে পারছি না। আমাদের ভিন্নমত ভিন্নপথ এত শক্তিশালী যা কখনো এক মোহনায় মিলিত হয়ে নদীর কূল ছাপিয়ে বয়ে যেতে দেয় না। কবে এ সর্বগ্রাসী দ্বিমতের হাত থেকে মুক্তি পাব জানি না। কিন্তু এটা জানি, একদিন মুক্তি আমরা পাবই পাব; সে আশায় পথ চেয়ে আছি। সে আশায় এত উথাল-পাথাল, উঁচু-নিচু অতিক্রম করে চলেছি।

মিয়ানমার নেতা অং সান সু চি শান্তিতে নোবেল পান ১৯৯১ সালে। আস্তে আস্তে তিনি মিয়ানমারের জাতীয় নেতা হয়ে ওঠেন। নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় বসেন। কিন্তু শান্তিতে নোবেল পাওয়া এই নেতাকে কখনো আমার বিশ্বশান্তি সম্পর্কে, মানবতা সম্পর্কে বড় কিছু মনে হয়নি। মনে হয়েছে মিয়ানমার সামরিক শক্তিই পরিচালনা করছে। শেষ পর্যন্ত গত সোমবার প্রেসিডেন্টকে, অং সান সু চিকে বন্দী করে সেনাবাহিনী ক্ষমতা নিয়ে নিয়েছে। বেশ কয়েক বছর আগে বিএনপি সরকারের তা-বে সংসদে বলেছিলাম, আমার কাছে বাড়ি, সংসদ আর জেলখানা একই রকম। তাই আমাকে ভয় দেখাবেন না। কিন্তু সেই কথা আজ আমার দেশের যারা শাসন ক্ষমতায় কেন যেন তাদেরও মনে করিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। সেদিন বোরহান কবীরের একটা চমৎকার লেখা পড়লাম। তার চিন্তা-চৈতন্য বেশ ক্ষুরধার। আলজাজিরার ১ ঘণ্টা ২১ মিনিট প্রচারিত প্রতিবেদন সম্পর্কে অসাধারণ লিখেছেন। তার পরও বলব, আলজাজিরার প্রতিবেদনে সরকারের কী ক্ষতি হলো বা হবে তা নিয়ে আমি খুব একটা ভাবী না। আলজাজিরার প্রতিবেদনে দেশের কতটা ক্ষতি হলো সেটাই আমার চিন্তা, তাতে আমার মর্ম যাতনা। দেশের ক্ষতি পোষাবে কী করে? করোনার ক্ষতি মোকাবিলা করতে পারলেও আলজাজিরার প্রতিবেদনে দেশের যে ভাবমূর্তি নষ্ট হলো তা পূরণ করা খুব সহজ নয়। যে যাই বলুন, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে নরওয়ের সাংবাদিকের এক অনির্ভরযোগ্য প্রতিবেদনেও অনেক কিছু হয়েছে। তাই কোনো কিছুই হবে না এমন ভেবে নাকে সরিষার তেল দিয়ে ঘুমিয়ে থাকার উপায় নেই।

গত বেশ কিছু দিন সৈয়দ আবুল হোসেনের একটা বইয়ের বিজ্ঞাপন দেখছিলাম। সপ্তাহখানেক বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রথম পৃষ্ঠায় প্রথম কলামে বিজ্ঞাপনটি ছাপা হয়েছে ‘আমার চিঠিপত্র- সৈয়দ আবুল হোসেন।’ এক অসাধারণ সুন্দর বই। ওজন দুই-আড়াই কেজির কম হবে না। কোনো পাঠক বিছানায় শুয়ে হাতে নিয়ে পড়তে পারবেন না। সব সময় বসে পড়তে হবে। ৬৮০ পৃষ্ঠার বই, সঙ্গে আরও ১০-১২ পৃষ্ঠায় শতাধিক ছবি। জনাব আবুল হোসেন সব সময় লেখালেখি করেন। তিনি বিয়ে করেছেন টাঙ্গাইলের পশ্চিমে এনায়েতপুর। এনায়েতপুরের পীর সাহেবদের টাঙ্গাইলে বহু মুরিদ। আমাদের গ্রামেও অনেক মুরিদ আছেন। ছেলেবেলায় বাবার হাত ধরে মনে হয় আমিও একবার গিয়েছিলাম। সেই পীর বাড়ির জামাই। সৈয়দ আবুল হোসেনের শ্বশুর তার বাড়িতে তার ঘরে নিজে হাতে পরিবেশন করে আমাকে বেশ কয়েকবার খাইয়েছেন। পীর পরিবারে মানুষকে খাওয়া-দাওয়া, সেবাযত্ন করার অসাধারণ গুণ থাকে। ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জে তাদের সিলসিলা আছে। সেখানেও গেছি। সেখানে সৈয়দ আবুল হোসেনকে দেখেছি। আমার মনে হয় ’৯১ সালের শেষের দিকে বনানী কবরস্থানে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের কবর জিয়ারত শেষে গাড়ি পাচ্ছিলাম না। একজন সুদর্শন ছোটখাটো মানুষ পেছন থেকে আমার পাখনা ধরে বলেছিলেন, ‘লিডার, চলেন। আপনার গাড়ি আসতে দেরি হবে। আমার গাড়িতে করে নামিয়ে দিই।’ তার ডাকে সাড়া না দিয়ে পারিনি। তিনি আমার ২০/৩০ বাবর রোড, মোহাম্মদপুরের বাড়িতে নামিয়ে দিয়েছিলেন। সেই থেকে পরিচয় একই রকম আছে। বেশ কয়েকবার আমার ভাঙা বাড়িতে এসেছেন। দু-একবার সোনারগাঁও থেকে খাবার নিয়ে এসেছেন। যোগাযোগমন্ত্রী থাকার সময় তার অফিসে বেশ কয়েকবার গেছি। সকাল ৮টায়ও তাকে অফিসে পাওয়া যেত। যতবার গেছি অসাধারণ সৌজন্য দেখিয়েছেন। মনে হয়েছে সৌজন্যই যেন তার মূল শক্তি। সেই মানুষটি যোগাযোগমন্ত্রী থাকার সময় পদ্মা সেতু নিয়ে কলঙ্কের মালা গলায় পরে মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে আসেন। বিশ্বব্যাংক তাকেসহ আরও বেশ কয়েকজনের নামে এক কাল্পনিক দুর্নীতির অভিযোগ এনে দেশকে ছোট করার যে চেষ্টা করে তা একদিন মিথ্যা প্রমাণিত হয়। সৈয়দ আবুল হাসেন এবং আমার ভাতিজা আবুল হাসান চৌধুরী কায়সারসহ আরও কয়েকজন আসামি ছিলেন। কানাডার আদালত তাদের বেকসুর খালাস দেয়। সঙ্গে এও বলে, বিশ্বব্যাংকের অর্থ নিয়ে দুর্নীতির কোনো ঘটনাই ঘটেনি। সেই আবুল হোসেনের ‘আমার চিঠিপত্র’ বইটির বারবার বিজ্ঞাপন দেখে সেদিন হঠাৎই ফোন করেছিলাম। মানুষ বড় হলে তাকে বিনয়ী হতে হয়, ভদ্র হতে হয়। যা আবুল হোসেনের জন্মগত স্বভাবজাত। বলেছিলাম,

- একবার আসতে চাই।

- বলেন কি লিডার! আপনি আসবেন সে আবার বলতে হবে? বলেছিলাম,

- বিকাল ৪টায় যদি আসি।

- আসবেন। সে আপনার ইচ্ছা।

ইদানীং ইউটিউবে দেখি বাংলাদেশের সেরা ধনীদের মধ্যে সৈয়দ আবুল হোসেনের নাম ৩-৪-৫ নম্বরেই পাওয়া যায়। ১০-১২ হাজার কোটি টাকা সম্পত্তির মালিক। কী সম্পত্তি আছে, কত টাকার মালিক এগুলো কোনো দিন ভাবিনি, এখনো ভাবী না। অত ব্যস্ত মানুষ, তার সময়ের কোনো বাহানা নেই। আমার ইচ্ছাই তার সময়। তাই সৈয়দ আবুল হোসেনের সঙ্গে কথা বলতে বেরোব এমন সময় মাঝবয়সী এক মহিলা হাজির। এর আগেও নাকি দুবার এসেছেন। আমি বাড়ি ছিলাম না, টাঙ্গাইলে ছিলাম। ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে তাই সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায় চলতে পারি না। কিছুটা ওদের মন জুগিয়েও চলতে হয়। প্রায় এক বছর বলতে গেলে আমরা আধা কোয়ারেন্টাইনে আছি। এ এক বছরে ছয়-সাতবার টাঙ্গাইলে গেছি। বাড়ি থেকে গাড়িতে উঠে টাঙ্গাইলে ঘরে বন্দী। কদিন সেখানে থাকার পর সেখান থেকে আবার গাড়িতে। গাড়ি থেকে বাবর রোডের বাড়ি। ঢাকা শহরে গেছি এক বা দুবার। এ এক বছরে টাঙ্গাইল শহরে একবারও যাইনি। ছেলেমেয়ের কড়া নির্দেশ। বাইরের লোক খুব একটা আসতে দেয় না। তবু সৈয়দ আবুল হোসেনকে দেখতে যাওয়ার সময় ভদ্রমহিলা আসায় তাকে বৈঠকখানায় ডেকেছিলাম। এখন বেশি লোক আসে মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্তির জন্য। অনেকেই ভাবে আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। তাই মুক্তিযোদ্ধা হতে আমি বললে আর কোনো অসুবিধা থাকবে না। ব্যাপারটা মোটেই তা না। মুক্তিযোদ্ধাদের তেমন সাহায্য করতে পারি না। বছর পাঁচেক আগে জামালপুরের একজন এসেছিলেন। এক স্কুলমাস্টার। আনসার ট্রেনিং আছে তার। মুক্তিযুদ্ধের সময় মাস্টারি করেছেন, পাকিস্তান সরকারের ৭০-৮০ টাকা প্রতি মাসে বেতন নিয়েছেন। তার মুক্তিযোদ্ধা হতে হবে। লোকটিকে কোনোমতেই বোঝাতে পারিনি যে এসব করতে গেলে তিনি মুক্তিযোদ্ধা নন, বরং স্বাধীনতাবিরোধীর তালিকায় পড়ে যাবেন। সৈয়দ আবুল হোসেনকে দেখতে যাওয়ার আগে ঠিক তেমনি ঘটনা ঘটেছে। তার দাবি, মনোয়ারা বেগম মণি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। এখনো তার তালিকাভুক্তি হয়নি। ১৯৭১ সালে তার বাবা ইপিআরে ছিলেন। ইপিআরের সদস্য হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি এও বলেছেন, তার বাবা পিলখানাতেই ছিলেন। পিলখানার বাঙালি ইপিআরদের প্রশংসনীয় ভূমিকা জগৎখ্যাত। সে জন্য তাকে সম্মান করতেই হয়। তিনি সাড়ে তিন পৃষ্ঠার অপূর্ব হাতের লেখার এক চিঠিসহ তার বাবার কাগজপত্র দেন আমার হাতে। তার বাবা হাবিলদার মো. মজিবুর রহমান, পিতা তহিলু উদ্দিন, গ্রাম ঘাটারচর, পোস্ট আটিবাজার, উপজেলা কেরানীগঞ্জ, ঢাকা। ভদ্রমহিলা বললেন, বিডিআরে তার বাবার নাম আছে। সেখান থেকে কাগজ পেলেই মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হতে পারেন। চিঠিটা হাতে পড়তেই আমি অবাক হয়ে গেলাম। তিনি লিখেছেন,

‘মাননীয়, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম। আসসালামু আলাইকুম। আমি একজন কাদেরিয়া বাহিনীর গুলিতে নিহত শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার মেয়ে। আমার বাবা পূর্ব পাকিস্তান থাকার সময় ইপিআরে ছিলেন। তিনি ঢাকার পিলখানায় কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি এই দেশটাকে শত্রুমুক্ত করার জন্য, স্বাধীন করার জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তাই তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। আমি একজন বীরের সন্তান হিসাবে গর্র্বিত। আমার বাবা জীবন বাজি রেখে মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করেছে অস্ত্র হাতে সম্মুখযুদ্ধের ময়দানে, যুদ্ধে জয়ী হয়ে দেশকে স্বাধীন করেছেন। ...

১৯৭৬ সালের অক্টোবরে আমার জন্ম। আমার বয়স যখন পাঁচ মাস, যখন আমি ‘বাবা’ ডাকা শিখি নাই। বাবা আমাকে কোলে নিয়েছে কিনা সেই অনুভূতি হয় নাই, যখন বাবার মুখচ্ছবি মনে করার বয়স হয় নাই তখন আমার বাবার মৃত্যু হয়। আমার বাবার মৃত্যু কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না। আমার বাবার মৃত্যু ছিল রাষ্ট্রীয় মৃত্যু। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৭ সালে নেত্রকোনা জেলার হালুয়াঘাট সীমান্তে কাদেরিয়া বাহিনীর গুলিতে আমার বাবার মৃত্যু হয়। আমার বাবার মরদেহ ঢাকার পিলখানায় এনে আমার মাকে দেখানো হয়েছে। আমার বয়স তখন পাঁচ মাস। পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে আমি সবার ছোট। বাবাকে হারানোর পর হতে খুবই অর্থকষ্টে আমার মা আমাদের বড় করেছেন। এক বেলা খেয়ে আর এক বেলা না খেয়ে আমাদের ছয়জনের দিন কেটেছে। অভাবের সংসারে ঠিকমতো খেতেই পারি নাই- তাই লেখাপড়াও বেশি করার ভাগ্য আমার হয় নাই।

শিশুকাল থেকে শুনেছি আমার বাবাকে কাদেরিয়া বাহিনী গুলি করে মেরেছে। সেই থেকে কাদেরিয়া বাহিনীর ওপর প্রচন্ড রাগ। যতই বড় হই ততই কাদেরিয়া বাহিনী সম্পর্কে জানতে পারি। কাদেরিয়া বাহিনীর যিনি প্রধান তিনি টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকী। তিনি ‘বঙ্গবীর’ উপাধি পেয়েছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে ‘বীরউত্তম’ খেতাব পেয়েছেন। এত বড় মুক্তিযোদ্ধার প্রতি শ্রদ্ধার কোনো কমতি নেই। যখন শুনি তিনি জাতির পিতার হত্যার প্রতিশোধ নিতেই কাদেরিয়া বাহিনীর যোদ্ধাদের নিয়ে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করেন। এ রকমই একটি প্রতিরোধযুদ্ধে ১৯৭৭ সালে ২৮ ফেব্রুয়ারিতে হালুয়াঘাট বর্ডারে আমার প্রাণের প্রিয় বাবা, আমার জন্মদাতা পিতা ১৯৭১ এর রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার মো. মজিবুর রহমান শহীদ হন।

আমি কম লেখাপড়া জানা ছোট মানুষ। কোনো কিছুর হিসাব মিলাতে পারি না। একদিকে আমার বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবার হত্যাকারী- অপরদিকে স্বাধীনতার যুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত বীর যোদ্ধা। বাংলার মানুষের দেওয়া উপাধি ‘বঙ্গবীর’ মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত কিংবদন্তি। সবকিছু হারিয়ে সবদিক ছাপিয়ে আমার কাছে বীর মুক্তিযোদ্ধারাই মহান। বীর মুক্তিযোদ্ধারাই আমার পিতা। তাই আমার পিতৃহত্যার প্রতিশোধ হিসাবে বাবার খুনি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে নিজের আত্মার সঙ্গে আপন করে নিয়েছি। বঙ্গবীর আপনি দীর্ঘজীবী হোন। আমি বাবাহারা হয়েছি- কিন্তু আপনাকে হারাই নাই। যত দিন আপনি বেঁচে থাকবেন তত দিন মুক্তিযোদ্ধাদের এতিম সন্তানরা আপনার স্নেহতলে থাকবে।’

পাঠক! আপনারাই বলুন এখন আমার কী করা উচিত? বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধযোদ্ধারাই এখন পর্যন্ত জাতীয় স্বীকৃতি আদায় করতে পারিনি। জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়া-শেখ হাসিনা সবার আমলেই প্রতিরোধযোদ্ধারা দুষ্কৃতকারী। তারা এখনো দেশের সুসন্তান হতে পারল না। আর এখন হাবিলদার মো. মজিবুর রহমানের মেয়ে মনোয়ারা বেগমের পত্রের কী করি? বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে কাদেরিয়া বাহিনী ছিল না, ছিল জাতীয় মুক্তিবাহিনী। ভদ্রমহিলা কাদেরিয়া বাহিনী বলেছে- এক অর্থে ঠিকই বলেছে, আমাকে তো ধরেছে। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান হানাদাররা যেমন আমাদের বিরুদ্ধে ছিল, তেমনি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে যারা ক্ষমতায় বসেছিল মো. মজিবুর রহমান তাদের পক্ষে ছিলেন। আমরা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ-প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। মনোয়ারার বাবাকে কিন্তু কোথাও থেকে তুলে নিয়ে গুলি করা হয়নি বা হত্যা করা হয়নি। সম্মুখযুদ্ধে তিনি নিহত হয়েছেন। ’৭৭-এর ২৮ ফেব্রুয়ারির যুদ্ধের কথা আমারও মনে আছে। আমাদেরও কয়েকজন শহীদ ও বেশ কয়েকজন আহত হয়েছিল। এত যত্ন করে মেয়েটা যখন মনের ভাব প্রকাশ করেছে কিছু একটা তো করতেই হবে। পাঠক! আপনারাই বলে দিন না আমি কী করতে পারি? সৈয়দ আবুল হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা পরেই না হয় বলব।

 

লেখক : রাজনীতিক।

www.ksjleague.coms

সর্বশেষ খবর