শুক্রবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

নেতাজি যদি ভারতে ফিরতেন রাজনীতির অবস্থা কেমন হতো

এম জে আকবর

নেতাজি যদি ভারতে ফিরতেন রাজনীতির অবস্থা কেমন হতো

ব্যক্তিত্ব আর দল। এ দুয়ের মাঝখানে রাজনীতি এতটাই শক্তভাবে আটকা পড়ে যে, একটা জাতির নির্বাচনী নিয়তি গড়ার ক্ষেত্রে ভূগোলের ভূমিকাটা আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে চায়। রাজনৈতিক ভাষ্য কোনো কোনো সময় ইতিহাসের চেয়ে সাহিত্যে বেশি বাঙময় হয়ে ওঠে এবং ওই দুই জিনিসের উত্তেজনা ভোগ করে।  তাই দেখা যায়, স্বাধীন ভারতের সম্ভাব্য নেতা হিসেবে যে দুজনকে ১৯৩০ সালে চিহ্নিত করা হয়েছিল- জওহরলাল নেহেরু ও সুভাষচন্দ্র বসু- তাঁদের নিয়ে উদ্ভূত বিতর্কে অত্যধিক মনোযোগ দেওয়ায় আমরা ভারতীয় দিগন্তে ক্ষিপ্রগতিতে ঘটে যাওয়া সুভাষ বসুর উত্থানে আমূল পরিণতিটা খেয়ালই করিনি। দুজনই মেধাবী। তবে চমৎকৃত একটা পার্থক্য। নেহেরু উজ্জ্বল হয়েছেন গান্ধীর আলোকচ্ছটায়; বসু চকচক করেছেন নিজস্ব বিভায়।

আরও একটা বিষয় বিবেচ্য। ক্যারিশমা (ভক্তি ও উৎসাহ সঞ্চারের ক্ষমতা) গলদসমেত তৈরি হয়। এটা অস্থায়ী। মৃত্তিকায় কম্পনে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ভূগোলও। তবে ভূগোল সাধারণত বেশি স্থিতিশীল।

১৯৪৭-এর ১৭ আগস্ট নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু রাশিয়া যাওয়ার নিয়তে তাইপেগামী একটি জাপানি উড়োজাহাজে উঠেছিলেন। তিনি মনে করতেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মোকাবিলা করতে সক্ষম, যুদ্ধোত্তর ইউরোপে এ রকম শক্তি রাশিয়া। ১৯৪৫ সালের ২৫ মে এক বক্তৃতায় বসু তাঁর এ ধারণা ব্যক্ত করেন। তাইপে রওনা না দিয়ে নেতাজি যদি বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলে পৌঁছানোর জন্য থাইল্যান্ড থেকে একটা জাহাজে উঠতেন, তাহলে কী ঘটতে পারত?

গ্রেফতার করতে পারলে নেতাজিকে ব্রিটিশরা যে বিচারের কাঠগড়ায় ওঠাত, এটা সত্য। ভারতের ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেলের একান্ত সচিব স্যার ইভান জেনফিন্স ১৯৪৫ সালের ২৮ জুলাই ভাইসরয়স কাউন্সিলের সদস্য স্যার ফ্রান্সিস মুডি’র কাছে যে চিঠি লিখেছেন তাতে এ সংকল্পের কথা ছিল। ব্রিটিশ খুব ক্রুদ্ধ ছিল। কারণ সুভাষ বসু ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (আইএনএ) গড়ে তোলেন এবং তাতে করে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির ঐক্য ও শৃঙ্খলা ভেঙে যায়।

বিচারের সাধ! তবে ব্রিটিশের সাধ আর সাধ্যের মধ্যে বিস্তর ফারাক। সুভাষ বসুর প্রভাব আইএনএ ছাড়িয়ে গিয়ে নিয়মিত বাহিনীতে পৌঁছে গিয়েছিল। কেউই জানত না, স্বাধীনতার তীব্র বাসনার ছোঁয়া সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীকে কতটুকু আন্দোলিত করছে। ওয়াভেল ১৯৪৫-এর ১৫ জুন মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের নোট পাঠালেন লন্ডনে। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে গেরিলা রেজিমেন্টের নেতৃত্বদানকারী এক অফিসারকে জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে ওই নোট তৈরি হয়েছে। তিনি বলেছেন, আইএনএর অফিসার ও সৈনিকরা ভারতের স্বাধীনতার জন্য অন্তর থেকেই যুদ্ধ করেন, তারা কোনো বাধ্যবাধকতায় ছিলেন না। মণিপুর অভিযানের সময় তারা যে রকম অপরিসীম কষ্ট সয়েছেন, সে ধরনের কষ্ট সইতে তারা প্রস্তুত ছিলেন। তারা নিশ্চিত জানেন যে, তারা শুধু যুদ্ধসরঞ্জামের অভাবেই পরাস্ত হয়েছেন এবং তারা ভারতে ফিরে এলে ভারতীয় বাহিনীর মধ্যে দ্রুতগতিতেই জাতীয়তাবাদের বিচ্ছুরণ ঘটে যাবে।

সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ জেনারেল স্যার ক্লড অচিনলেক ১৯৪৫ সালের ২৪ নভেম্বর পাঠানো ‘অতি গোপনীয় ও ব্যক্তিগত’ এক নোটে জানান, কোর্ট মার্শালে আইএনএর কোনো অফিসার বা সৈনিককে মৃত্যুদন্ড দিলে ১৯২১ ও ১৯৪২ সালের গোলযোগের চাইতেও বড় গোলযোগ সৃষ্টি হবে। তিনি রাজা সম্রাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করেন। জেনারেল অচিনলেক বলেন, ‘উল্লেখযোগ্য’সংখ্যক ভারতীয় সৈন্য আইএনএকে দেশদ্রোহী মনে করে না; তারা আইএনএকে দেশপ্রেমিক বলে। ১৯৪৬-এর ৩ জানুয়ারি ক্যাপ্টেন পি কে সাহগাল, ক্যাপ্টেন শাহ নওয়াজ ও লেফটেন্যান্ট জি এস ধিলনকে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেওয়া হলে ভাইসরয় ওয়াভেলের সম্মতি নিয়ে জেনারেল অচিনলেক ওই দন্ড কমিয়ে ‘বরখাস্ত’ ও ‘বেতন-ভাতা জব্দ’-তে রূপান্তরিত করলেন।

আইএনএর কজন অফিসারের বিচারের ঘটনায় যে আবেগ-উত্তেজনা তৈরি হয় তাতে আমাদের পক্ষে কল্পনা করাও কষ্টকর যে, নেতাজি সুভাষ বসুকে বিচারের কাঠগড়ায় তোলা হলে ভারতজুড়ে কী আগুনই না জ্বলে উঠত। আরও একটা কথা। তাঁকে কীসের জন্য অভিযুক্ত করা হতো? তিনি তো ইন্ডিয়ান আর্মির সদস্য নন। তাহলে তাঁর কোর্ট মার্শাল কী করে হবে! জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে ১৯৪৫ সালে কোন পুলিশ চার্জশিট লিখতে পারত?

ভুলাভাই দেশাই ছিলেন তাঁর সময়কার সেরা অ্যাডভোকেট। মামলার বিচারকালে তিনি আইএনএ অফিসারদের কৌঁসুলি ছিলেন। আইনি যুক্তির সুতীক্ষè বাণ ছুড়তে ছুড়তে তিনি বলেছিলন, আধুনিক আন্তর্জাতিক আইন মুক্তির জন্য লড়াই করার ব্যাপারে প্রজার অধিকার স্বীকার করে। জার্মানি যখন ফ্রান্স দখল করে নেয় তখন তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে চার্লস দ্য গলের ‘ফ্রি ফ্রান্স ফোর্স’। ওই ফোর্স কি বৈধ ছিল? দেশাই বলেন, ‘ফ্রি ফ্রান্স যদি বৈধ হয়ে থাকে, ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মিও বৈধ।’

সুভাষ বসুর বিচার শুরু হওয়ামাত্রই তিনি উপমহাদেশের প্রতিটি গ্রামের প্রতিটি ঘরের প্রিয় মানুষ হয়ে উঠতেন। তাঁর দল অল ইন্ডিয়া ফরোয়ার্ড ব্লক রাতারাতি দেশব্যাপী পেয়ে যেত প্ল্যাটফরম। ইল্টেলিজেন্স ব্যুরোর পরিচালক ১৯৪৫-এর ২০ নভেম্বর ব্রিটিশ সরকারকে বলেছেন, ‘আইএনএর প্রতি ভারতীয় জনসাধারণের যে আকর্ষণ তা অন্য বিষয়ে দেখা যায় না। আইএনএর কাউকে শাস্তি দিলে তার পরিণামে যে তিক্ততা সৃষ্টি হবে তা চলবে যুগের পর যুগ। সাধারণভাবে যারা সরকারবিরোধী তারাই যে কেবল আইএনএর প্রতি সহানুভূতিশীল, ব্যাপার তা নয়। ... এ সহানুভূতি সাম্প্রদায়িক বাধার পরোয়া করে না। এ অবস্থা ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য একটা হুমকি, একে উপেক্ষা করা বোকামি হবে।’

সুভাষ বসুর এই গভীর ও প্রভাবসঞ্চারক জনপ্রিয়তা কংগ্রেস নেতাদের শঙ্কিত করে। আমি বলব না যে, ১৯৫২-এর প্রথম সাধারণ নির্বাচনে সুভাষ বসু জয়ী হতেন। গান্ধীর প্রভাব, তাঁর শহীদ হওয়াজনিত তৎপর্যবাহী আবেগ আর কংগ্রেসের জন্য গান্ধীসৃষ্ট শক্তি, বিশেষত হিন্দিভাষী বলয়ে, ভোটারদের আঁকড়ে ধরার সব রকম সম্ভাবনাই ছিল। তবে প্রথম স্বাধীন সংসদে ফরোয়ার্ড ব্লকের সম্মানজনক উপস্থিতি ঘটত, এবং ১৯৫৭-এর নির্বাচনপ্রসূত অবস্থান সুভাষ বসুকে ভারতের নেতৃত্বে বসার মতো দরকষাকষির সামর্থ্য এনে দিত।

তাঁর ঘাঁটি হতো বাংলা, ভারতের পূর্বাঞ্চল হয়ে নানা দিকে প্রসারিত হতো তাঁর প্রতিপত্তি। ফলত নেতাজি জাতীয় পর্যায়ে গরিষ্ঠতা অর্জনের ভিত হিসেবে একটা উপকূলীয় কোয়ালিশন গড়ে তুলতে পারতেন। বিহারে তাঁর প্রভাব হতো দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর। আদর্শের মুগ্ধতা আর জনপ্রিয়তা উত্তর-পূর্বাঞ্চল, রাজস্থান, সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাগুলো আর শহরাঞ্চলগুলোকে এনে ফেলত তাঁর প্রভাব বলয়ে।

ক্যারিশমা ছাড়াও সুভাষ বসুর ছিল সাহস ও প্রজ্ঞা। তাঁকে কখনই কাবু করা যয়নি, এমনকি গান্ধীও এটা পারেননি। প্রথম পদক্ষেপটি নেওয়ার আগে কৌশল ঠিক করে নেওয়ার চিন্তাশক্তি ছিল তাঁর দারুণ। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ ১৯৪১ সালের মধ্য জানুয়ারিতে কলকাতার বাড়ি থেকে তাঁর উধাও হয়ে যাওয়া। গায়ে পাঠানের পোশাক, মাথায় পাগড়ি সুভাষ বসু সেদিন রওনা দিয়েছেন কাবুলে। পথে তিনি মোটর কারে আর ট্রেনে চড়েছেন, খচ্চরে সওয়ার হয়েছেন আর হেঁটেছেন। কাবুল থেকে ইতালীয় নাগরিক অরলান্ডো মাজোত্তা সেজে চলে গিয়েছিলেন মস্কো আর বার্লিনে। প্রখর বাস্তব বুদ্ধি আর দূরদৃষ্টিসমৃদ্ধ মন নিশ্চিতভাবেই নির্বাচনী রাজনীতির অঙ্গনে ব্যতিক্রমী কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারত।

ভারতের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের ভাষা বাংলা, উড়িয়া, তেলেগু, তামিল, মালয়ালাম, কানাড়া, কংকনি, মারাঠি ও গুজরাটি। বাঙালিদের ওপর তার প্রভাবের মাত্রা না বললেও চলে। ১৯৫২-এর নির্বাচনে তিনি বাংলায় সব আসনে জিততেন। কটকে সুভাষ বসুর জন্ম; ওড়িশায় তাঁর পারিবারিক সম্বন্ধ।

আরেকটি ফ্যাক্টরও তাঁর সহায়ক হতো। ওড়িশায় ছিল অনেক দেশীয় রাজ্য। রাজাশাসিত ছোট ছোট এসব ভূখন্ডে গান্ধী কখনই তাঁর গণআন্দোলন নিয়ে যাননি। যুক্তিটা হলো, ‘ভারতীয়রাই তো এগুলোর রাজা। মাথার ওপর থেকে ব্রিটিশের ছত্রচ্ছায়া সরে গেলে এসব রাজ্য ভারতীয় ইউনিয়নে যোগ দিতে বাধ্য হবে। নইলে জনগণই রাজাদের উৎখাত করবে।’ অতএব কংগ্রেস এসব রাজ্যে খুব শক্তিশালী সংগঠন দাঁড় করায়নি। তবু তারা রাজ্যগুলোয় নির্বাচনী ভালো ফল পেয়েছে। সেটা পায় দলটির বিকল্প সংগঠনের আবির্ভাব না ঘটা পর্যন্ত। বিষয়টি লক্ষণীয় হয়ে ওঠে ১৯৬২-এর পর কংগ্রেসের ওপর জনআস্থা কমতে শুরু করায়। ১৯৬৭-এর মধ্যে বিরোধী দলগুলো রাজাশাসিত এলাকাগুলোয় শক্ত অবস্থানে পৌঁছে। সুভাষ বসু তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা দিয়ে কংগ্রেসের দুর্বলতাকে অভীষ্টে যাওয়ার পুঁজি বানাতে পারতেন।

অহিন্দিভাষী একটি রাজ্যের ডাকে তামিলনাড়ু সরাসরি, কিংবা তার আঞ্চলিক দল ডিএমকে’র মাধ্যমে চটজলদি সাড়া দিত। কংগ্রেস থেকে ডিএমকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি ১৯৫৭-এর মধ্যে স্পষ্ট হয়ে যায়। সে বছর বিধানসভা নির্বাচনে ডিএমকে ১৫টি আসন পায়। ১৯৬২-তে তারা জিতে নেয় ৫০টি আসন। ‘হিন্দি জবরদস্তি’র ভয় তামিলনাড়ুর ভোটারদের এখনো ভাবায়। ভয়ের মাত্রাটা অবশ্য অনেক কমে এসেছে।

তেলেঙ্গানায় কমিউনিস্ট আন্দোলন ম্রিয়মাণ হওয়ায় এবং নিজামশাসিত পুরনো এলাকায় কংগ্রেসের ঘাঁটি নড়বড়ে হওয়ায় যে শূন্যতা তৈরি হয় তা পূরণ করে ফেলতে পারত সুভাষ বসুর সুদৃঢ় দারিদ্র্যমোচন নীতি। কেরালার সমাজবাদীরা তাদের শক্ত অবস্থান ধরে রাখবে বোঝা যাচ্ছিল। তাদেরকে নেতাজি কংগ্রেসবিরোধী জোটে টেনে আনার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। ১৯৬৭ সালে বাংলায় গঠিত কংগ্রেসবিরোধী জোটের শরিক হয়েছিল ফরোয়ার্ড ব্লক। ১৯৫৭-তে ও রকম জোটের নেতা সুভাষ বসুই হতেন।

এতক্ষণ যেসব কারণ উল্লেখ করলাম, সেসব কারণেই কর্ণাটকের মহীশুর অঞ্চলে কংগ্রেস ক্ষতিগ্রস্ত হতো। মহারাষ্ট্রে সুভাষ বসু হোঁচট হয়তো খেতেন কিন্তু ১৯৭৭ পর্যন্ত সেখানে কংগ্রেস যে নির্বাচনী দাপট দেখিয়েছে তা করতে পারত না। ... স্বাধীন ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচন থেকেই মুসলমানদের উদ্দেশে কংগ্রেসের ছিল অঘোষিত এক বার্তা- ‘আমরা ছাড়া কোথাও যাওয়ার জায়গা তোমাদের নেই।’ গণতান্ত্রিক দেশে এ রকম বাক্য শুনতে চায় না কেউ। বেছে নেওয়ার সুযোগ না থাকাটা তো গণতন্ত্র নয়। এ অবস্থায় সুভাষ বসু হতেন ন্যায্য ও আকর্ষণীয় এক বিকল্প এবং কংগ্রেসের প্রতি মুসলিম সমর্থন ১৯৬৭-তে নয়, ১৯৫৭-তেই উবে যেত।

বাংলার মুসলমানরা ১৯৫২-তে সুভাষ বসুকেই ভোট দিত, আর সব বাঙালিও দিত। পরবর্তী পাঁচ বছরে বিহারেও জিততেন নেতাজি। গাঙ্গেয় অববাহিকা আর উপকূলীয় অঞ্চলেও জয়ী হতেন তিনি। সে অবস্থায় লোকসভায় কংগ্রেস একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল থাকত বটে কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে গড়ে ওঠা প্রথম যুক্তফ্রন্টের প্রধানমন্ত্রী হতেন সুভাষচন্দ্র বসু। ১৯৫৭ সালে নেহেরু ছিলেন ৬৮ বছর বয়সী পরিশ্রান্ত রাজনীতিক; ওই বছরটায় নেতাজির বয়স হতো ৬০। বলা যায় যৌবনদীপ্ত ষাট।

জওহরলাল নেহেরু ১৯৫৭-এর নির্বাচনের পর পদত্যাগের চিন্তা করছিলেন। অনেক ভেবেছেন ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার কথা। মনের কথায় তখন যদি সায় দিতেন তাহলে চীনের বিরুদ্ধে ১৯৬২-এর যুদ্ধে পরাজয়ের দুঃসহ স্মৃতির পীড়ন তাঁকে সইতে হতো না। বইতে হতো না যুদ্ধোত্তর খাদ্যাভাব আর অর্থনীতির শ্লথগতির গ্লানি। কিন্তু ক্ষমতার বাঁধন কঠিন বাঁধন।

সুভাষ বসু প্রধানমন্ত্রী হলে আমরা নিশ্চিত হতাম যে ভারতের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা জোট নিরপেক্ষতার মায়ায় চোবানো বহুত্ববাদের ধারণায় তন্ময় হয়ে যেত না। যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে যিনি একটি সেনাবাহিনী গড়েছেন এবং ভয়ঙ্কর যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাদলের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তেমন ব্যক্তির বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের নির্দেশদানের আগে মাও জে দংকে দুবার ভাবতে হতো। সুভাষ বসুর অর্থনৈতিক নীতি কেমন হতো তা আমরা নিশ্চিত বলতে পারি না। তবে লক্ষ্য অর্জনের পথে সক্রিয় থাকার জন্য তিনি কৌশলগত যুক্তিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি তত্ত্ব ব্যবহার করতেন; তত্ত্বের হাতে বন্দী হতেন না।

ইউরোপীয় কোনো গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া মনস্থ না করে, সুভাষ বসু ১৯৪৫ সালে যদি দেশে ফিরে আসতেন, তাহলে তিনি দেখতেন যে, ১৯৫৭-এর মধ্যে বিপুল সংখ্যায় সচেতন যুব ভোটার আবির্ভূত হয়েছে। নেতাজি তো ১৯৪৫ সালেই যুবসমাজের কাছে অবিসংবাদিত হিরো হয়ে গিয়েছিলেন। এ যুবকরাই নেতাজির উচ্চারিত সংগ্রামের ধ্বনি ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’কে নগর-শহর-বন্দরে রণধ্বনি করে তুলেছিল।

মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী তাঁর শিষ্যদের অনেক আগে সুভাষ বসুর বিশালত্ব অনুভব করেছেন। গান্ধীর দর্শনের বিরুদ্ধবাদী সুভাষ বার্লিনে থাকতে সেই বিশালত্বের স্বীকৃতিও দিয়েছিলেন গান্ধী।

১৯৪২ সালের জুনে মার্কিন সাংবাদিক লুই ফিশারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে গান্ধী বলেন, ‘সুভাষকে আমি দেশপ্রেমিকদের মধ্যে সেরা মনে করি। তিনি বিপথগামী হয়ে থাকতে পারেন। আমি মনে করি তিনি বিপথগামী। প্রায়শ আমি তার বিরোধিতা করেছি। দুই দুইবার আমি সুভাষকে কংগ্রেসের সভাপতি হতে দিইনি। প্রায় সময়ই তার মতের সঙ্গে আমার মতের মিল হয়নি; তবু শেষতক সুভাষ সভাপতি হয়েছেন।’

১৯৪৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি গান্ধী বলেন, ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (আইএনএ) তাঁর মোহন ছোঁয়ায় আমাদের বশীভূত করেছে। নেতাজির নাম একটা জাদুমন্ত্র হয়ে উঠেছে। তাঁর দেশপ্রেমের তুলনা হয় না। ... তাঁর প্রতিটি কাজেই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তাঁর সাহসিকতা। তাঁর লক্ষ্যস্থল উঁচু ছিল (যুদ্ধের সময়) বলেই তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। ব্যর্থ কে না হয়?... তাঁর জন্য আমার প্রশংসা আর মুগ্ধতার শেষ নেই। নেতাজি আর তাঁর সেনাবাহিনীর কাছে শিক্ষণীয় হলো : ‘আত্মোৎসর্গ, শ্রেণি-সম্প্রদায় নির্বিশেষে ঐক্য ও শৃঙ্খলা। আমাদের মুগ্ধতায় যদি বিচক্ষণতা থাকে তাহলে আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে এ তিনটি গুণে গুণান্বিত হব। তবে সেই সঙ্গে আমরা সহিংসতাও দৃঢ়তার সঙ্গে পরিহার করব।’

সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রবক্তা এবং ভারতীয়দের মধ্যে শান্তির পথিকৃৎ। মহাত্মা গান্ধী এটা অনুধাবন করেছিলেন। গান্ধী বেঁচে থাকলে ১৯৫২-এর নির্বাচনে কংগ্রেসকে ভোট দিতেন আর ১৯৫৭-এর নির্বাচনে  ভোট দিতেন সুভাষচন্দ্র বসুকে।

লেখক : প্রখ্যাত সাংবাদিক

ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।

সর্বশেষ খবর