শনিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

ভাষাবৈচিত্র্য আল্লাহর নিদর্শন

এম এ মান্নান

ভাষাবৈচিত্র্য আল্লাহর নিদর্শন

ভাষার স্রষ্টা আল্লাহ। সেহেতু দুনিয়ার কোনো ভাষাকে অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই। আল্লাহ সব ভাষাই জানেন এবং যে ভাষায়ই তাঁকে ডাকা হোক তিনি বোঝেন। দুনিয়ায় যে শত শত ভাষা রয়েছে তা আল্লাহর বিশেষ কুদরত। হজরত আদম (আ.) ছাড়া অন্য সব নবী-রসুলের প্রতি আল্লাহর প্রত্যাদেশ বা আসমানি কিতাব নাজিল হয়েছে তাদের মাতৃভাষায়। ভাষাবৈচিত্র্যের এ অপার মহিমার প্রতি ইঙ্গিত করেই আল্লাহ রব্বুল আলামিন সুরা রুমের ২২ নম্বর আয়াতে ইরশাদ করেন, ‘আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে অবশ্যই জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে।’ আমরা বাঙালি। আমদের ভাষা বাংলা দুুনিয়ার অন্যতম ভাষা এবং অন্য সব ভাষার মতো এ ভাষাও মহান আল্লাহর দান। বাংলা যেহেতু আমাদের মাতৃভাষা সেহেতু এ ভাষার প্রতি আমাদের মমত্ববোধ থাকতে হবে। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর মাতৃভাষার প্রতি মমত্ববোধ করতেন। বিশুদ্ধভাবে মাতৃভাষা আরবি চর্চায় তিনি ছিলেন সবার চেয়ে এগিয়ে। মানব জাতির পথপ্রদর্শক আল কোরআন মাতৃভাষার মর্যাদাকে মহিমান্বিত করেছে। সুরা ইবরাহিমের ১৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ সব নবীকে তাঁদের স্বজাতির ভাষায় পাঠানোর কথা বলেছেন। যাতে তাঁরা আল্লাহর কথা সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারেন। হাদিসগ্রন্থ মিশকাতে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরবিভাষী হিসেবে যে গর্ববোধ করতেন তা স্পষ্ট করা হয়েছে। আরবি ভাষা কোরআনের ভাষা। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে ছিলেন আরবিভাষী। তাঁর মাতৃভাষা আরবিতে আল্লাহ তাঁর কাছে ওহি প্রেরণ করেছিলেন। তাঁর আগে যেসব নবীর কাছে আল্লাহর ওহি প্রেরিত হয়েছে তাও পাঠানো হয়েছে নবীদের মাতৃভাষায়। হজরত মুসা (আ.)-এর ওপর নাজিল হয়েছিল আসমানি কিতাব তাওরাত হিব্রু ভাষায়। হজরত দাউদ (আ.)-এর ওপর নাজিলকৃত জবুর ছিল ইউনানি ভাষায়। হজরত ঈসা (আ.)-এর ওপর নাজিলকৃত ইনজিলের ভাষা সুরিয়ানি। আমরা আখেরি নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মত। তাঁর ওপর নাজিলকৃত কোরআনের ভাষা হিসেবে আরবি ভাষা দুনিয়ার সব মুসলমানের কাছে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। আল্লাহর ইবাদতের জন্য মুসলমান হিসেবে আমরা আরবি ভাষার মুখাপেক্ষী হতে বাধ্য। একইভাবে দৈনন্দিন জীবনে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনে মাতৃভাষা বাংলার বাইরেও যে কোনো ভাষা শিক্ষার প্রয়োজন হতে পারে। দুনিয়ার সব ভাষা যেহেতু আল্লাহর সৃষ্টি এবং তাঁর মহান নিয়ামত সেহেতু কোনো ভাষাকে অবজ্ঞা করার অবকাশ নেই। আদিমানব হজরত আদম (আ.)-কে আল্লাহ ভাষাজ্ঞানসহ সব জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন। আল কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘রহমান, তিনি কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন, তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনিই তাকে শিক্ষা দিয়েছেন ভাব প্রকাশ করতে। সূর্য ও চন্দ্র নির্ধারিত হিসাব অনুযায়ী রয়েছে।’ সুরা আর রাহমান আয়াত ১-৫।

দুনিয়ার প্রথম মানব-মানবী হজরত আদম (আ) ও বিবি হাওয়াকে সৃষ্টির পর মনের ভাব প্রকাশের পদ্ধতি ও তার মাধ্যম ভাষা আল্লাহই শিক্ষা দিয়েছেন। আল্লাহর অন্যান্য নিয়ামতের মতো ভাষাও একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামত। পৃথিবীতে আদমসন্তানের বংশ বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে আদিমানুষের আদিভাষাও নানা শাখা-প্রশাখায় বিস্তার লাভ করে। ফলে পৃথিবীতে আজ হাজার হাজার ভাষার অস্তিত্ব বিরাজমান। আল্লাহর কাছে প্রত্যেক মানুষের মাতৃভাষার মর্যাদা অপরিসীম। এ সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘তিনটি কারণে আমি আরবি ভাষাকে ভালোবাসি। কেননা আমি আরবি ভাষাভাষী, কোরআনের ভাষা আরবি এবং জান্নাতের ভাষাও হবে আরবি।’ এ হাদিসে স্পষ্ট বোঝা যায় রসুল (সা.) তাঁর মাতৃভাষা আরবি হওয়ার কারণে ওই ভাষার জন্য গর্ববোধ করতেন। পৃথিবীর প্রতিটি ভাষা কোনো না কোনো মানুষের মাতৃভাষা। ভাষা ছাড়া যেমন মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না তেমনি মানুষ ছাড়া কোনো ভাষার অস্তিত্বও অকল্পনীয়।

প্রত্যেক মানুষের কাছে তার নিজ মাতৃভাষা অতিশয় প্রিয়। মাতৃগর্ভে অস্তিত্ব লাভের পর মায়ের রক্তে সেই অস্তিত্বের ক্রমবিকাশ ঘটে। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মাতৃস্নেহে বেড়ে ওঠে এবং ধীরে ধীরে মায়ের ভাষা শিখে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করে। তাই মা, মাতৃভাষা প্রত্যেক মানুষের অস্তিত্বের অনুষঙ্গ। একে অস্বীকার করা নিজের অস্তিত্ব অস্বীকারেরই নামান্তর। আল্লাহ প্রত্যেক মানুষকেই স্ব স্ব মনের ভাব প্রকাশের ক্ষমতা দিয়েছেন। প্রথমে মুখের দ্বারা, দ্বিতীয়ত লেখনীর দ্বারা মানুষ তার মনোভাব অন্যের কাছে প্রকাশের সুযোগ পায়। মহান আল্লাহ যুগে যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ও বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে তাঁর রসুল পাঠিয়েছেন। যিনি যে এলাকার জন্য প্রেরিত হয়েছেন সে এলাকার ভাষাই ছিল তাঁর দীন প্রচারের ভাষা। নবী-রসুলরা তাঁদের মাতৃভাষায় কথা বলেছেন, প্রেরিত কিতাবসমূহও আল্লাহতায়ালা তাঁদের মাতৃভাষায় অবতীর্ণ করেছেন।

আল কোরআনে রসুল (সা.)-কে উদ্দেশ করে আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে। এমন কোনো সম্প্রদায় নেই যাদের কাছে সতর্ককারী প্রেরিত হয়নি।’ সুরা ফাতির আয়াত ২৪। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর মহা অনুগ্রহ হয়েছে মুমিনদের ওপর তাদের মধ্য থেকে তাদের জন্য একজন রসুল প্রেরণ করেছেন যিনি তাদের ওপর তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন এবং তাদের পবিত্র করেন। আর তাদের কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দান করেন এবং তারা নিশ্চয়ই আগে সুস্পষ্ট গোমরাহিতে ছিল।’ সুরা আলে ইমরান আয়াত ১৬৪। আল্লাহ ভাষাসংশ্লিষ্ট অন্য একটি আয়াতে বলেন, ‘এভাবে আমি আপনার প্রতি কোরআন অবতীর্ণ করেছি আরবি ভাষায়, যাতে আপনি সতর্ক করেন সব শহরের মূল মক্কা ও তার চারদিকের জনগণকে এবং আপনি সতর্ক করবেন কিয়ামত দিবস সম্পর্কে, যাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেদিন একদল জান্নাতে যাবে একদল জাহান্নামে।’ সুরা শুরা আয়াত ৭।

            লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক।

সর্বশেষ খবর