রবিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

ফেলে আসা সেই দিনগুলো

মাকিদ হায়দার

ফেলে আসা সেই দিনগুলো

শরৎচন্দ্রের ‘বিলাসী’ নামের একটি গল্প আমাদের স্কুলজীবনের শেষ দিকে পাঠ্য করেছিলেন তৎকালের ইস্ট পাকিস্তান স্কুল টেক্সট বুক বোর্ড। সময় ষাট দশকের গোড়ার দিকে। অন্যদিকে ওই টেক্সট বুক বোর্ডের পাঠক্রমে ছিল পূর্ব পাকিস্তানের অনেক কবি, গল্পকার ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের অনেক কবি-সাহিত্যিকের গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল আগে ছিলেন, এখনো আছেন, ভবিষ্যতেও থাকবেন। তবে পূর্ব পাকিস্তানি কবি ফররুখ আহমদ ও গোলাম মোস্তফার কবিতাকেই বেশি প্রাধান্য দিত বোর্ড। সে সময়টা ছিল পঞ্চাশ দশকের শেষ দিকের।

কবি গোলাম মোস্তফার একটি কবিতার কথা এখনো মনে আছে। তার নাম ছিল ‘পাকিস্তানের অভাব কি’। কবি তাঁর কবিতার মাধ্যমে আমাদের মতো, পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রদের জানাতে পেরেছিলেন, পাকিস্তানের কোনো অভাব নেই, অনটন নেই, বিশেষত পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালের ১৭টি জেলায় কোথায় কী কী পাওয়া যায় এবং সেসব জেলার উৎপাদিত পণ্যের বিবরণ দিয়ে, আমাদের মতো কিশোরদের মনে একটি চিত্র এঁকে দিয়েছিলেন। তাঁর কবিতার মধ্য দিয়ে এবং পুরো কবিতার বক্তব্য ছিল পাকিস্তানের কোনো অভাব নেই। স্কুলজীবন শেষ করে শুনেছিলাম ওই একটি মাত্র কবিতার জন্য তাকে ‘তমঘায়ে খেদমত’ খেতাব দিয়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান সম্মানিত করেছিলেন। কবি গোলাম মোস্তফাকে নাকি কাজী নজরুল ‘গোলাম ইস্তেফা’ নামে আদর করেই ডাকতেন। পাবনা শহরের রাধানগর অধিবাসী কবি বন্দে আলী মিয়া তাঁর প্রিয় কাজীদার কাছে যেতেন। একই সঙ্গে যেতেন গোলাম মোস্তফা। যে কবি একদিন তাঁর জন্মভূমি যশোর ছেড়ে কলকাতায় লেখাপড়া শিখে স্কুল শিক্ষকতা দিয়ে শুরু করেছিলেন জীবনযাপন। কবিতা লেখার প্রেরণা পেয়েছিলেন কাজী নজরুল থেকে সমকালীন অন্য কবিদের সংস্পর্শে এসে।

১৯৪৬ হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের ভিতরে যে বিভেদের সৃষ্টি করেছিল ব্রিটিশ সরকার তার কিছুকাল পরই ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান নামের দুটি রাষ্ট্র বানিয়েছিল এবং লাখ লাখ মানুষকে তার জন্মভূমি থেকে পরিকল্পিতভাবে রক্তক্ষয়ের মাধ্যমে দেশান্তরী করে পাকিস্তান ও ভারত থেকে। তারই একটি করুণ চিত্র আমরা দেখতে পেলাম ভারতের প্রখ্যাত লেখক খুশবন্ত সিংয়ের বিখ্যাত উপন্যাস ‘ট্রেন টু পাকিস্তান’-এ। যেহেতু তাঁর পিতৃভূমি ছিল বর্তমানের পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে। অন্যদিকে পাবনার আরেক সন্তান, বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জলপাইগুড়ি নিবাসী দেবেশ রায়, তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘ছেঁড়া পাতার নৌকা’ লিখে তিনি পাঠককুলকে জানিয়েছিলেন মাতৃভূমি হারিয়ে পরদেশে গিয়ে আশ্রয় নেওয়ার এক মর্মান্তিক ব্যথা ও বেদনার কাহিনি। সেই একই কাহিনির নতুন রূপ আমরা দেখলাম সেই কবি গোলাম মোস্তফার সোনার পাকিস্তানের বর্বরদের অমানবিক কর্মকান্ড, পাকিস্তানের বর্তমান অভাব তাদের মনুষ্যত্ব হারানোর পরিণাম। যে মনুষ্যত্ব তারা হারিয়েছিল আমাদের মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের সেই গনগনে মার্চের উত্তাল দিনে। যে উত্তালের শুরু ১৯৫২, ’৬৬, ’৬৯, ’৭০ ও ’৭১ সালে। তখনই আমার মনে হয়েছিল কবি গোলাম মোস্তফার কবিতাটি মিথ্যা প্রমাণিত হলো। যে দেশের মানুষের ভিতরে মানুষ্যত্ব নেই তাদের সঙ্গে ১২০০-১৩০০ মাইল দূরের বাঙালিদের একত্রে থাকার প্রয়োজন নি®প্রভ হয়ে গেছে। যেটি ১৯৪৮ সাল থেকেই এ দেশের মানুষের মনে দ্বিধাদ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেছিল। এবং সেই ১৯৪৮ সালের আগেই অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর ভারতবর্ষের রাজনীতিতে বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষিত হয়েছিল পূর্ববঙ্গের মানুষের কাছে। যে আশা ও স্বপ্ন নিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে আন্দোলন করেছিলেন ওই দেশের মুসলিম সম্প্রদায় পাকিস্তান সৃষ্টির পর সে আশায় ধূলিসাৎ হতে বা স্বপ্নভঙ্গ হতে বেশি সময় লাগেনি। কেননা স্বপ্নের কোনোটাই পূরণ হলো না। সে স্বপ্ন পূরণ না হওয়ার নেপথ্যে ছিলেন দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আকরম খাঁ এবং সহযোগী শাহ আজিজুর রহমান। খাজা নাজিমউদ্দিন ছিলেন আরও দূরে কালো পর্দার আড়ালে। যার ফলে জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং পূর্ব পাকিস্তান হয়েও হলো না। অথচ ভাগকারী ব্রিটিশ সাহেব পূর্ব পাকিস্তানকে একটি বা দুটি শীতোষ্ণ অঞ্চল দেবেন বলে স্থির করেছিলেন। কিন্তু নাজিমউদ্দিন ও সহযোগীরা ওই দার্জিলিং এবং জলপাইগুড়ির কথা ভুলে গিয়ে তাড়াহুড়ো করে এসে বসেছিলেন লাট বাহাদুরের চেয়ারে। ১৯৪৮ সালের মার্চের ১১ তারিখে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা শেখ মুজিবের নেতৃত্বে অবস্থান ধর্মঘট করেছিলেন তৎকালের ইডেন বিল্ডিং আজকের সচিবালয়ের সামনে। সেই পিকেটিংয়ে অন্যদের মধ্যে ছিলেন প্রখ্যাত ছাত্রনেতারা। কাজী গোলাম মাহবুব, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, শেখ মুজিবসহ আরও অনেকে এবং ওই একই দিনে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে পুলিশ এবং পিকেটিংয়ের দায়ে পুলিশের লাঠির বেদম প্রহারে প্রচন্ডভাবে আহত হয়েছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক একদা যিনি ছিলেন উভয় বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী।

দৈনিক আজাদে ১৯৪৮ সালের ১৩ মার্চ হেডলাইন হয়েছিল ‘বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দাবি করিয়া ছাত্র বিক্ষোভ, ঢাকার ছাত্রদের উপর লাঠিচার্জ : হক সাহেবসহ ৫০ জন আহত, সরকারি অফিসসমূহে পিকেটিং ও কর্মচারীদের অফিস ত্যাগ’। এর কয়েক দিন পর ১৬ মার্চ, ১৯৪৮ আহতদের দেখতে গিয়েছিল নাগরিকসমাজ। আগে গ্রেফতার শেখ মুজিবকে পুলিশ ১৬ মার্চের আগেই ছেড়ে দিয়েছিল। সাম্প্রতিককালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বিগত ২০১৭-১৮ সালে বাংলাদেশ সম্পর্কে বেশ কিছু অশালীন মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, বাঙালিরা অমানুষ। মনুষ্যত্বহীন, বিবেকহীন। কিন্তু সম্প্রতি তাদের অংশের জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে ভারতীয়দের কিছু সৈনিককে দিবালোকে পুলওয়ামা নামক একটি এলাকায় বিনাদোষে তারই দেশে লালিত সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে হত্যা করিয়ে অবশেষে প্রায় যুদ্ধাবস্থায় ইমরান খান ভারতের কাছে নতিস্বীকারে বাধ্য হলেন। কেননা পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশি গুণ পারমাণবিক শক্তিধর দেশ ভারত। আবার একশ্রেণির মানুষ উল্টো কথাই বলে, পাকিস্তানিদের যথেষ্ট পরিমাণ পারমাণবিক বোমা মজুদ আছে। ইচ্ছে হলে ইমরান খান যে কোনো মুহূর্তে ভারতকে পদানত করতে পারবে।

ঠিক এমন কথা শুনেছিলেন সেই ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় সপ্তাহে, পাকিস্তান-ভারতের যুদ্ধের সময় যেটি পাক-ভারত যুদ্ধ হিসেবে এখনো সর্বজনবিদিত এবং আরও বিদিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের সৈনিকরা সগর্বে জানিয়েছিল যে কোনো সময় পাক বাহিনী (সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায় না-পাক বাহিনী) দিল্লি জামে মসজিদে নামাজ শেষ করেই সমগ্র ভারতের নাম পাল্টিয়ে পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে দেবে ভারতের ২২-২৩টি রাজ্যে। ’৬৫ সালের যুদ্ধে পাকিস্তান হেরে গেলেও এ দেশের তৎকালের পত্রপত্রিকায় বিশেষত মোনায়েম খানের পুত্রের ‘দৈনিক পয়গাম’ প্রায় প্রতিদিন পাকিস্তানের ভারত দখলের মিথ্যে প্রচারটি চালাত। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন মুজিবুর রহমান খাঁ। ১৯৪৭ সালের আগে পূর্ববঙ্গের মানুষকে সোনার পাকিস্তানের প্রলোভন দেখানো হয়েছিল। সে পাকিস্তানের বুকের ভিতর ছিল তামা ও লোহার আবরণ, যে আবরণে তারা বাঙালিদের যে স্বপ্ন দেখিয়েছিল সে স্বপ্ন ধূলিতে মিশে যেতে সময় লাগেনি। ১৯৪৭ সাল পেরিয়ে ’৪৮-এ এসে বাঙালি নেতা ছাত্রসমাজ কমবেশি সবাই বুঝতে পারলেন পাকিস্তানের জনকের ভূমিকা। অন্যদিকে জনাব জিন্নাহর বিশ্বস্ত ছিলেন লিয়াকত আলী খান, তাঁর হঠকারিতার জন্য তাঁকেও প্রাণ দিতে হয়েছিল পঞ্চাশ দশকের গোড়ার দিকে। অন্যদিকে ভারতের জনক মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী তাঁকেও প্রাণ দিতে হলো এক সভায়। লিয়াকত আলী, গান্ধীকে যে দুজন খুন করেছিল তার পেছনের ইতিহাস করুণ। ইংরেজদের চক্রান্তেই ঘরহারা দেশহারা হয়েছিল হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ। তারই প্রতিশোধ নিয়েছিলেন মি. রামসে গডসে ও একখান পাঠান। দেশভাগের আগে আমাদের পূর্ববঙ্গের মানুষ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় গিয়ে কেউ হয়েছিল পাটকলের-ডকইয়ার্ডের, ভারতের পূর্ব রেলওয়ের শ্রমিক। তারা কেউ কোনো দিন বুঝতে পারেনি হিন্দু-মুসলমানদের ভিতরে কোনোকালে দাঙ্গা হতে পারে। কিন্তু ১৯৪৬ সালে সবকিছু এলোমেলো করে দিল কতিপয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট মানুষ। কোথায় গেল সেই ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ। পুনরায় একত্রীকরণ ইতিহাস। সবকিছু মিলিয়ে গেল ’৪৬-এর দাঙ্গায় এবং একই সঙ্গে দুই সম্প্রদায়ের ভিতরে যে দূরত্বের সৃষ্টি হলো তা এখনো কমবেশি বিদ্যমান। কয়েক দিন আগে পাবনা প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. এম আবদুল আলীমের সুলিখিত একটি গ্রন্থ পাঠ করতে গিয়ে অনেক তথ্য পেলাম, একই সঙ্গে ১৯৪৮ সাল থেকে শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য নেতাদের কর্মকান্ডের ওপর ড. আলীমের ভাষা আন্দোলনে ছাত্রলীগ কতিপয় দলিল পাঠান্তে আমার মনে হয়েছে, এ দেশের ভাষা আন্দোলনে ছাত্রলীগের যে অবদান তার সাক্ষ্য-প্রমাণ কতিপয় দলিলে বর্ণিত হয়েছে। সেটি আমাদের অনেকেরই অজানা। সে অজানাকে জানতে গিয়ে আমাদের উত্তরা মডেল টাউনের গর্বিত, সুকণ্ঠের মশকদের অত্যাচারে অতীত ইতিহাস জানার আগেই, ঢাকা উত্তরের মেয়র পদে যিনি মনোনীত হয়েছেন তিনি আতিকুল ইসলাম তাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। তিনি উত্তরাবাসীকে নিশ্চিত করেছেন, সুকণ্ঠের মশক থাকবে না। কথাটি পাঠান্তে ভালো লাগল, যেমন ভালো লেগেছিল শরৎচন্দ্রের ‘বিলাসী’ গল্পের ন্যাড়া চরিত্রটি। ন্যাড়ার বয়ান আমরা স্কুলজীবনে জেনেছি। তিনি জানিয়েছেন, মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হইয়া সন্ন্যাসীগিরি ছাড়িয়া দিলাম’।

আমি কিছুদিন ধরে ভাবছি যাবতীয় বই-পুস্তক ফেলে দিয়ে একদিন পাবনায় চলে যাব। ওখানে গেলে নিশ্চয়ই জনাব আলীমের কষ্টসাধ্য, শ্রমসাধ্য বইটি ‘ভাষা আন্দোলনে ছাত্রলীগ’ কতিপয় দলিল আশা করি শেষ করতে পারব। সঙ্গে  জানাব শেখ মুজিবের যাবতীয় কর্মকান্ড। রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রনৈতিক মত কালান্তরে তিনি জানিয়েছেন, আমাদের দেশকে সম্পূর্ণভাবে কেউই কেড়ে নিতে পারে না এবং সেই দেশকে বাইরে থেকে দয়া করে কেউ আমাদের হাতে তুলে দেয় এমন শক্তি কারও নেই। প্রায় শত বছর আগে লেখা কালান্তর প্রবন্ধ থেকে জানলাম ওপরের কথাগুলো। হয়তোবা ১৯৪৮ সালেই শেখ মুজিব জেনেছিলেন আমাদের দেশকে সম্পূর্ণভাবে কেউ কেড়ে নিতে পারে না। যেমন পারেনি নাপাক দস্যুরা ১৯৭১ সালে।

            লেখক : কবি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর