রবিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

আনিসুজ্জামানের সাহিত্য-সাধনা

এম আবদুল আলীম

আনিসুজ্জামানের সাহিত্য-সাধনা

গবেষক ও সাহিত্য-সাধক হিসেবে আনিসুজ্জামানের খ্যাতি ও সিদ্ধি শীর্ষবিন্দুস্পর্শী। বাংলা সাহিত্য ও বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ওপর মৌলিক গবেষণা করে তিনি তরুণ বয়সেই খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। পারিবারিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার থেকে লেখক হওয়ার অনেক প্রেরণা পেয়েছিলেন। পিতামহ শেখ আবদুর রহিম লেখক ও সাময়িকপত্রের সম্পাদক ছিলেন। ‘সাপ্তাহিক সুধাকর’ ও ‘মিহির’ পত্রিকা সম্পাদনা ছাড়াও ‘হজরত মহম্মদের জীবনচরিত ও ধর্ম্মনীতি’সহ বেশ কয়েকখানি গ্রন্থ রচনা করে বাংলার বিদ্বৎসমাজে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর মা সৈয়দা খাতুনের দু-একটি লেখা ‘আজাদ’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, এর মধ্যে উল্লেখ করা যায় ‘নারীর অধিকার’ প্রবন্ধটির কথা; বড় বোনও নিয়মিত কবিতা লিখতেন ‘সওগাত’-এ। শৈশবেই সেকালের খ্যাতনামা লেখক-সাংবাদিক-শিল্পীদের কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। কবি বেনজীর আহমদ ও ‘সওগাত’ সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের সঙ্গে ছিল তাঁদের পরিবারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। এর ফলে অল্প বয়সেই আনিসুজ্জামান সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার মতো এক উদার ও অনুকূল পরিবেশ পান। যুক্ত হয়েছিলেন ‘মুকুল ফৌজ’-এর সঙ্গে, যার নেতা ছিলেন কামরুল হাসান। তাঁর পিতারও ছিল একটি লাইব্রেরি, যেখানে বিচিত্র বই-পুস্তক ও পত্রপত্রিকা ছিল। অনেক কবি-সাহিত্যিক এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয়ের কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে; সর্বোপরি তাঁরসহ সেকালের সাহিত্যিকদের মাথার ওপর ছিলেন কবি-সার্বভৌম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নজরুলও তখন সৃষ্টিসুখের উল্লাসে মত্ত। বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্যের পাশাপাশি ফরাসি বিপ্লব এবং রুশ বিপ্লবের চেতনাধারা আনিসুজ্জামানের চিত্ত-মননের ভূমিতে আছড়ে পড়ে। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুহম্মদ এনামুল হক, কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, মুহম্মদ আবদুল হাই, আবুল ফজল, সৈয়দ আলী আহসানসহ অনেক বাঙালি মুসলমান চিন্তাবিদ তাঁর চিন্তা-চেতনা ও মননশীলতার জগতে প্রভাব ফেলেন। কলকাতা, খুলনা, ঢাকা এ তিন শহরে বসবাসকালে সে শৈশবেই হাতে-লেখা পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়। প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় রোকনুজ্জামান খান, ফজলে লোহানী ও সৈয়দ আনোয়ারুল হাফিজ সম্পাদিত ‘নোতুন দিন’ পত্রিকায়। লেখাটির নাম ছিল ‘হাতেম তাই’।

কলকাতার পার্ক সার্কাস স্কুল ও খুলনা জেলা স্কুলে অধ্যয়নকালে লেখা শুরু করলেও প্রিয়নাথ স্কুলে পড়ার সময়ই লেখালেখিতে নিয়মিত হন। এ সময়ে জর্জ বার্নার্ড শর স্মরণে স্কুলে শোকসভায় স্বলিখিত প্রবন্ধ পাঠ করেন, যা প্রকাশিত হয় কাজী নূরুল ইসলাম ও আবদার রশীদ সম্পাদিত ‘মুকুর’ পত্রিকায়। এ সময়ে রচনা করেন ‘টেলিফোন’, ‘মশা’, ‘শিক্ষার মূল্য’সহ বেশ কয়েকটি গল্প; যেগুলো প্রকাশিত হয় ‘মুকুর’, ‘নওবাহার’, ‘মাহে-নও’, ‘আজাদ’ প্রভৃতি পত্রিকায়। একটি গল্পগ্রন্থের পা-ুলিপি প্রস্তুত করেও তা শেষ পর্যন্ত গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেননি। এ সময় ইংরেজ শাসনামলের ইতিহাস ধারণ করে রচনা করেন ‘দুশো বছর’ নামক একটি নাটক। ভাষা আন্দোলনের সময় রচনা করেছিলেন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কী ও কেন নামক পুস্তিকা। ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ এবং প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ যোগাযোগ থাকায় তাঁর চেতনায় ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবোধ প্রবলভাবে জাগ্রত হয়। তাঁর লেখায় এর প্রভাব পড়ে।

১৯৫৩ সালের হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারি সংকলনে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘দৃষ্টি’ নামক গল্পটি। শৈশব-কৈশোরে প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা প্রভৃতি রচনার মাধ্যমে সাহিত্যজগতে প্রবেশ করলেও পরবর্তীকালে থিতু হন সাহিত্য-সংস্কৃতির গবেষণা ও মননশীল প্রবন্ধ রচনায়। এ ক্ষেত্রে তিনি যে মান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা অতিক্রম করা সমকালীন কারও পক্ষে সম্ভব হয়নি। বস্তুত তরুণ বয়সেই তিনি ঝানু গদ্যশিল্পী হয়ে ওঠেন, যা তাঁকে পরিণত করে সমকালের অন্যতম সেরা চিন্তাবিদে। নির্মেদ ও সাবলীল এক গদ্যরীতি প্রবর্তন করে তিনি হয়ে ওঠেন অনন্য। তাঁর নির্মেদ-সাবলীল গদ্য সময় সময় অলঙ্কার খচিত হয়ে কাব্যিক ব্যঞ্জনা লাভ করেছে। প্রাঞ্জলতা, সরসতা ও প্রসন্ন কৌতুকবোধে সে গদ্য হয়ে উঠেছে নান্দনিক সৌকর্যমন্ডিত। তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘কাল নিরবধি’ এবং ‘বিপুলা পৃথিবী’র পাতায় পাতায় সূক্ষ্ম রসবোধ ও স্মিত পরিহাসপ্রিয়তা হিলহিলিয়ে উঠেছে। ঘটনার বিবরণ ও বিশ্লেষণের চমৎকারিত্বে, নাটকীয়তায় ও সংলাপ সৃষ্টিতে এবং ভাষার লাবণ্য ও সুষমায় শৈল্পিক পরিমিতি লাভ করেছে। তাঁর গদ্যের আরেকটি বৈশিষ্ট্য তা পড়তে গিয়ে কখনো ক্লান্তি আসে না। বিচিত্রমুখী ছিল তাঁর চিন্তা ও গবেষণার ক্ষেত্র। তাঁর গবেষণার প্রধান দিক হলো বাংলা সাহিত্য ও সমাজচিন্তায় বাঙালি মুসলমানদের অবদানের স্বরূপ অন্বেষণ। এ ক্ষেত্রে তিনি সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে উঠে বৃহত্তর ঐতিহাসিক পটভূমির আলোকে পর্যালোচনা করেছেন। তাঁর গবেষণার শুরু ১৯৫৮ সালে এবং সেটা ‘ইংরেজ আমলের বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের চিন্তাধারা (১৭৫৭-১৯১৮)’ বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রির জন্য অভিসন্দর্ভ রচনার মাধ্যমে। বাংলা ভাষায় আত্মজীবনীর ধারায় আনিসুজ্জামানের গ্রন্থত্রয় (কাল নিরবধি, আমার একাত্তর ও বিপুলা পৃথিবী) এক বিশেষ সংযোজন। কালনিরবধিতে স্থান পেয়েছে তাঁর প্রথম তিন দশকের স্মৃতি আলেখ্য। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান স্থান পেয়েছে ‘আমার একাত্তর’-এ। ‘বিপুলা পৃথিবী’তে তুলে ধরেছেন নিজের আত্মজীবনীর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক গতি-প্রকৃতির নানা চালচিত্র তথা স্বাধীনতা-পরবর্তী তিন দশকের ইতিহাসের বিশ্বস্ত বয়ান। সাহিত্য-সাধনা এবং গবেষণায় তাঁর অমূল্য অবদান স্মরণীয় করে রাখবে। অসাম্প্রদায়িক চেতনা, প্রগতিশীলতা এবং মানবতাবাদী চিন্তার ধারক-বাহক হিসেবে তাঁর সৃষ্টিকর্ম দেশ, জাতি ও সমাজকে দেখাবে আলোর পথ। ১৮ ফেব্রুয়ারি তাঁর জন্মদিন। তাঁকে শ্রদ্ধা।

লেখক : শিক্ষক, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর