বৃহস্পতিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

ধন্যবাদ বাংলাদেশ

তসলিমা নাসরিন

ধন্যবাদ বাংলাদেশ

বাংলাদেশকে ধন্যবাদ কারণ ছয় বছর পরে হলেও একটি নৃশংস হত্যাকান্ডের বিচার করতে পেরেছে। দুঃখ এই, আজ অজয় রায় বেঁচে নেই। তিনি হয়তো এই দেশে অভিজিৎ হত্যার বিচার হবে না এই দুঃখ নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদেয় নিয়েছেন। অভিজিতের মা’কেও এই দুঃখ নিয়ে বিদেয় নিতে হয়েছে। বিচার না হওয়ার দুঃখের চেয়ে বড় দুঃখ অভিজিতের মতো একজন প্রতিভাবান পুত্রকে হারানো। এই হারানো তো স্বাভাবিক অসুখ-বিসুখে হারানো নয়। নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও অত্যন্ত বিরল প্রতিভার অধিকারী এই লেখক, এই ব্লগার, এই প্রকৌশলীকে রাস্তায় মুখ থুবড়ে নিজের রক্তের ওপর, নিজের ছিন্ন ভিন্ন মস্তিষ্কের ওপর পড়ে থাকতে হয়েছে। কারও বিরুদ্ধে কোনো অন্যায় না করেও, কাউকে অত্যাচার না করেও, কেবল বুদ্ধির মুক্তির জন্য, কেবল চেতনার উন্মেষের জন্য, কেবল সমাজের পরিবর্তনের জন্য, অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাওয়ার জন্য, দেশ ও দশের মঙ্গলের জন্য তিনি নিরলস পরিশ্রম করেছেন। যে দেশকে ভালোবেসে তিনি আলোকিত করতে চাইতেন, সেই দেশের মাটিতে তাঁকে খুন হতে হয়েছে। যারা দেশকে অন্ধকারে মুড়ে রাখতে চায়, তারাই অন্ধকার থেকে উঠে এসে খুন করেছে আপাদমস্তক এক আলোকিত মানুষকে। সেই ভয়াবহ দৃশ্য যারা দেখেছে, তারা মানুষ যদি হয়, নিশ্চয়ই শিউরে উঠেছে। কারা হাততালি দিয়েছে আমরা জানি। হত্যাকান্ডের বিচারে পাঁচজনের ফাঁসি হলো, একজনের যাবজ্জীবন- এতে কি হাততালি দেওয়ার সংখ্যা কিছু কমেছে? আমরা এও জানি যে, কমেনি। ওদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ওয়াজ ব্যবসায়ীরা যখন বলে মুক্তচিন্তকদের হত্যা করা ফরজ- তখন জোরে হাততালি দেয় ওরা। এই হাততালির আওয়াজ আজকাল বাংলাদেশের আকাশ-বাতাস কাঁপাচ্ছে।

হত্যাকারীদের উদ্দেশ্য ছিল দেশে মুক্তচিন্তা বন্ধ করবে, মতপ্রকাশের অধিকার বন্ধ করবে, গণতন্ত্র বাতিল করবে, ব্যক্তি-স্বাধীনতা নষ্ট করবে। তাই অভিজিৎ, অনন্ত, নিলয়, বাবু, দীপন, সামাদ, জুলহাস, তনয়- এদের কুপিয়ে মেরে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চেয়েছিল। মানুষ যেন ভয় পেয়ে নিজেদের কোনো রকম ভিন্নমত প্রকাশ না করে, মানুষ যেন তাদের প্রাপ্য গণতান্ত্রিক অধিকার কখনো দাবি না করে। তারা চায় না নারীর সমানাধিকারের কথা শুনতে। তারা চায় না মানবাধিকার শব্দটি কেউ উচ্চারণ করুক। মূলত ধর্ম নিয়ে কোনো ভিন্নমত তারা চায় না কেউ উচ্চারণ করুক। ধর্মের একটি মতই তারা প্রচার হোক চায়, সেটি তাদের মত। দীর্ঘকাল অন্ধকারে ডুবে থাকলে ধর্মান্ধতা, অজ্ঞানতা, অসহিষ্ণুতা, কূপমন্দুকতা থেকে জন্ম নেওয়া যে মতটি তাদের মগজে ঢুকে যায়, অথবা কেউ খুব সহজে ঢুকিয়ে দিতে পারে-সেই মত। দেশজুড়ে একটি মতই বিরাজ করবে, এই মতটিকে সবাইকে মেনে নিতে হবে। তা না হলে মৃত্যু। অন্ধকারের সৈন্যরা আজ থেকে এই হুমকি দিচ্ছে? তারা চায় না শিল্প সাহিত্য সংগীত, তারা চায় না কোনো নান্দনিক পরিবেশ। তাদের চাওয়াটিই দিন দিন বিকট আকার ধারণ করছে। তাদের চাওয়ার চাপাতির তলায় শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ থরথর করে কাঁপছে। চোখ মুখ বন্ধ করে জীবিত শবের মতো বেঁচে আছে।

তাদের হুমকি আজ সর্বত্র। রাজনৈতিক, সামাজিক, শিল্প-সাহিত্যিক- কোন অঙ্গন আজ শঙ্কামুক্ত? সব অঙ্গনই তারা দখল করে নিয়েছে। অতিকায় এক শকুন মাথার ওপর তীক্ষè চক্ষু নিয়ে ডানা মেলে আছে, আমাদের চোখ খুবলে নেবে, আমাদের মস্তিষ্ক ছিন্ন ভিন্ন করবে। আমাদের ভিন্নমতের কোনো অস্তিত্ব যেন না থাকে। ঠিক এরকমই আছে আমাদের দেশ, আমার দেশ। সেই প্রিয় দেশটি শকুনের ডানার তলার অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। মানুষ পালাচ্ছে দেশ থেকে। যাদের পালানোর সুযোগ নেই, তারা নিজেদের যুক্তিবুদ্ধি থেকে পালাচ্ছে।

অভিজিতের হত্যাকারীদের দেখেছি, গুলশান ক্যাফের হত্যাকারীদেরও দেখেছিলাম টেলিভিশনে। ওরা তো আর ১০টা সাধারণ মানুষের মতোই দেখতে। তাহলে মানুষের মাথায় কী করে কোপ বসাতে পারে, কী করে জবাই করতে পারে রক্তমাংসের জলজ্যান্ত মানুষকে! তারা পারত না যদি তাদের মগজে ঢুকিয়ে না দেওয়া হতো একটি বিশ্বাস যে হত্যাকান্ডগুলো ঘটালে তারা বিরাট পুরস্কার পাবে, বিনা বিচারে তারা অনন্ত সুখের বেহেশত পাবে। এই বিশ্বাস তাদের এত দৃঢ় যে বেহেশত-বাসের জন্য যে কোনো কিছু করতে তারা প্রস্তুত। নির্দ্বিধায় তারা একটি কেন, একশোটি খুন করতে পারে। তাদের জীবনের চেয়ে, হাজারো মানুষের জীবনের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে তাদের বেহেশত-প্রাপ্তি। আমাদের ভাবলে চলবে না যে এরা অশিক্ষিত বা মূর্খ। আমাদের ভুললে চলবে না গুলশান ক্যাফের হত্যাকারীরা কারা ছিল। এরা অশিক্ষিত নয়, এরা মূর্খও নয়, এরা রীতিমত বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা বুদ্ধিদীপ্ত ছাত্র। মাদ্রাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়-সব খানেই এই বিষ ছড়িয়ে গেছে, আমাদের দেখতে হবে এই বিষ কোত্থেকে আসছে, এই বিষ কারা ছড়াচ্ছে।

খুন করলে শর্টকাটে বেহেশত পাওয়া যাবে- এই শিক্ষা তারা কোথায় পেয়েছে? কে তাদের এই কুশিক্ষা দিচ্ছে? যতদিন না আসল কালপ্রিটকে হাতকড়া পরানো হচ্ছে, ততদিন আমরা কালপ্রিটদের ভিকটিমকেই ফাঁসি দিয়ে যাব। কালপ্রিটরা বা জিহাদি-গুরুরা দেশে দেশে জিহাদ করার জন্য ধর্মভীরু মুসলমান তরুণদের বেছে নিয়েছে। এ শুধু বাংলাদেশের চিত্র নয়, এ সারা বিশ্বের চিত্র। রাজনৈতিক ইসলাম আজ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে সারা বিশ্বে। যদি উদার ইসলাম দিয়ে, বিজ্ঞানমনস্কতা দিয়ে, জ্ঞান বুদ্ধি দিয়ে, যুক্তি দিয়ে, মানবতার শিক্ষা দিয়ে রাজনৈতিক ইসলামকে হঠানো না যায়, তবে ভবিষ্যৎ অত্যন্ত অন্ধকার। সেই ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে আলো হাতে যে মানুষই আসবে, তার মস্তিষ্ক টুকরো হয়ে তারই রক্তে ভাসতে থাকবে। এর কোনো শেষ দেখতে পাবে না কেউ।

ফাঁসি দিয়ে, যাবজ্জীবন দিয়ে তিন দশকের মগজধোলাই বন্ধ করা যায় না। দেশে জিহাদি কর্মকান্ড বন্ধ করতে চাইলে জিহাদের আঁতুড়ঘরগুলোয় তালা লাগিয়ে দিতে হবে। এ ছাড়া উপায় নেই। এ না হলে বাংলাদেশে কোনো গণতন্ত্র, ভিন্নমত, শিল্প সাহিত্য সংগীত, কোনো মুক্তচিন্তা, কোনো বাক স্বাধীনতা, কোনো মানবাধিকার, নারীর অধিকার এবং নারী-নেতৃত্বের অস্তিত্ব থাকবে না। একাত্তরে জন্ম হওয়া একটি সম্ভাবনাময় দেশটির অকালমৃত্যুই দেখতে হবে।

দীপন এবং অভিজিৎ হত্যার বিচারে মৃত্যুদন্ড এবং যাবজ্জীবনের রায় দেখে জিহাদিরা কিন্তু হত্যাকান্ড বন্ধ করবে না। কারণ তারা বিশ্বাস করে যে মুক্তচিন্তকদের, ধর্মে-অবিশ্বাসীদের বা সমালোচকদের খুন করলে তাদের বেহেশতবাস হবে। আর যদি ধরা পড়ার পর তাদের মৃত্যুদন্ড হয়, তাহলেও তাদের বেহেশতবাস হবে। মৃত্যুদন্ডের রায় বেরোনোর পর তাই খুনিরা মোটেও আতঙ্কগ্রস্ত ছিল না। চোখে মুখে তাদের হাসি চিকচিক করছিল, তারা হয়তো এই ভেবে সুখ পাচ্ছিল যে, এই তো বেহেশতের জীবন শুরু হবে, এই তো অনন্তকালের আনন্দ শুরু হবে। মনে আছে গুলশান ক্লাবের জিহাদিগুলো সারা রাত ধরে মানুষ খুন করার পর হাসছিল, কারণ পুলিশ এখন তাদের গুলি করবে, তারা মরবে, মরলেই অনন্তকাল আনন্দ করার জন্য পেয়ে যাবে বেহেশত। জিহাদ করতে গিয়ে শহীদ হলে বিনা বিচারে বেহেশত। তারা ওয়াজে বার বার এই তথ্য শুনেছে। তারা জিহাদি-গুরুদের কাছ থেকে এই তথ্য পেয়েছে। সুতরাং ব্লগার হত্যাকান্ডে যে শাস্তি পাচ্ছে জিহাদি জঙ্গিরা- সে শাস্তির নাম দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নয়। শাস্তির ভয়ে জিহাদিরা অপরাধ করা থেকে বিরত থাকবে না।

আজ লেখকরা যা লিখতে চান লিখতে পারছেন না, আজ যে গান বাউলেরা গাইতে চান গাইতে পারছেন না, আজ নারীরা যে পোশাক পরতে চান পরতে পারছেন না, আজ যাত্রার শিল্পীরা যে যাত্রা করতে চান তা করতে পারছেন না, আজ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিক যেভাবে দেশকে সভ্য করতে চান সেভাবে পারছেন না, আজ শিক্ষাবিদরা যে শিক্ষা দিতে চান শিক্ষার্থীদের তা দিতে পারছেন না, আজ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ যে কথা মুখ ফুটে বলতে চাইছেন, সে কথা বলতে পারছেন না। সবাই ভয়ে সিঁটিয়ে আছে। সবার চোখের সামনে সেইসব হত্যাকান্ডের দৃশ্য। মানুষকে ভয় পাইয়ে দেওয়ায় আজ ওরা সার্থক। কিন্তু ওদের মৃত্যুদন্ড দিয়ে ওদের ভয় পাইয়ে দেওয়া যায় না, ওদের শাস্তি দিয়ে দৃষ্টান্ত তৈরি করা যায় না। কারণ ভয় ওরা পায় না, ভয় আমরা পাই, যারা মানবতায় বিশ্বাস করি। ওরা মানবতায় বিশ্বাস করে না, ওরা ইহকালেও বিশ্বাস করে না, ওদের সব বিশ্বাস পরকালে।

সার কথা এই, উৎসে আঘাত না হানলে, উৎস নির্মূল না করলে, ভয়াবহ সব হত্যাকান্ড বন্ধ করা যাবে না। প্রগতিশীল মানুষ নিহত হতেই থাকবে, মৃত মানুষের মতো বাঁচতেই থাকবে, নির্বাসিত হতেই থাকবে। এ কোনো সমাধান নয়।

                লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর