শুক্রবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

গণতন্ত্র শক্তপোক্ত না থাকলে সুশাসন থাকে না

খায়রুল কবীর খোকন

গণতন্ত্র শক্তপোক্ত না থাকলে সুশাসন থাকে না

প্রকৃত নির্বাচনের অনুপস্থিতিতে গণতন্ত্র যখন পর্যুদস্ত তখন রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে সুশাসনের সংকট দেখা দেবে তা তো নিশ্চিতই বলা চলে; এবং এটা উপলব্ধি করা সবার জন্য খুবই সহজ ব্যাপার। সুশাসন যে নেই প্রতিদিনের খবরের কাগজ পড়লেই তার প্রমাণ মেলে পাতায় পাতায়। কেবলই দুঃসংবাদ। পত্রিকাগুলোর পাতাজুড়ে নেতিবাচক খবর ও মত-মন্তব্য দিয়ে ঠাসা থাকে। সুসংবাদ আসবে কোত্থেকে? যখন কটিয়াদির সরকারদলীয় এমপি সাহেবের লোকজন করোনা আঘাতে সদ্য পত্নীহারা একজন সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তার ওপর বিনা প্ররোচনায় হামলা চালাতে পারে অকাতরে, একটা ঠুনকো অজুহাতে! স্বাস্থ্যসচিব মান্নান সাহেব কয়েক মাস আগেই করোনা সংক্রমণে নিজের স্ত্রীকে হারিয়েছেন, তিনি ভয়ানক শোকগ্রস্ত তাতে কোনো সন্দেহই থাকতে পারে না। অকালপ্রয়াত সেই ভদ্রমহিলার স্মরণে তিনি একটা কমিউনিটি ক্লিনিক করার উদ্যোগ নিলেন নিজের বাড়ির সন্নিকটে, নিজেদের পারিবারিক জমি দান করে। হয়তো তিনি এসব বিষয় নিয়ে স্থানীয় এমপির সঙ্গে আলোচনা করার সময়-সুযোগ পাননি, তাতে মানে লেগেছে ঈর্ষাকাতর ওই এমপি সাহেবের। কটিয়াদি উপজেলার একই গ্রামের বাসিন্দা তারা দুজনই। কেন এমপি সাহেবকে ‘মাতব্বরি ফলানোর’ সুযোগ দিলেন না সচিব সাহেব সেটাই রাজনীতির এক স্থানীয় অধীশ্বরের আক্ষেপ, তাতেই তার গোস্সা। তার লোকজন কয়েক দিন আগে (ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে) সচিব সাহেবকে ধাওয়া করল, সেখানে উপস্থিত উপজেলা ভূমি সহকারী কমিশনারকে আক্রমণ ও মারধর  করে, তাকে পুকুরে নিক্ষেপ করা হলো, স্বাস্থ্য সচিবের অন্যসব সহযোগীকেও মারধর করল এবং কমিউনিটি ক্লিনিক ঘরটি ভাঙচুর করল। প্রচ- ত্রাস সৃষ্টি করল  দিনে-দুপুরে, কিন্তু পুলিশ এলো না, এমনকি এ সন্ত্রাসী তৎপরতার খবর দেওয়ার পরও তাদের রক্ষা করতে পুলিশ সময়মতো দায়িত্ব পালন করল না। ক্ষমতাদর্পীদের নৈরাজ্য কোন পর্যায়ে গেলে এমনটা ঘটতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। এ রকম দুঃসংবাদের ঘটনা প্রতিদিন কত যে ঘটছে এ দেশে তার হিসাব কে রাখে!

আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্তা পি কে হালদার দুর্নীতির এক টাইটানিক। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তহবিল থেকে লুট করে পাচার করলেন বিদেশে এবং নিজেও পালিয়ে গেলেন দেশ ছেড়ে। চারদিকে হইচই- এত ক্ষমতা কীভাবে পেলেন এই পি কে হালদার সাহেব, দশককালের বেশি সময় ধরে এ অনাচার চালানোর সময় কারা তার মদদদাতা? এখন খবর বেরিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘প্রবল-শক্তিধর’ সদ্য সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরীর মদদেই পি কে হালদার এসব করার অবাধ সুযোগ লাভ করেছেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা কি এসব অবগত ছিলেন না? তাহলে তারা সবাই ১২ বছর ধরে রাষ্ট্রের প্রশাসনের কী উন্নতিটা করলেন? পত্রিকায় ৮ ফেব্রুয়ারি খবর বেরিয়েছে বন বিভাগের ২ লাখ ৫৭ হাজার ১৫৯ একর জমি বেদখল করে ভোগ করছে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার ৫৬৬ ব্যক্তি। হরিলুটের বাতাসা আর কি! তা না হলে কীভাবে এ জমি দখল চলে! এ হিসাবের বাইরে অনেক রাষ্ট্রীয় জমি (যার আয়তন লাখ লাখ একর), রেলের জমি, জেলা প্রশাসনের জমি এভাবে ক্ষমতাধর দস্যুরা অবৈধ ভোগদখলে নিয়েছে। এবং এই যে দখলবাজি অব্যাহতভাবে বেড়েই চলেছে কিন্তু কোনো প্রতিকার নেই। মাঝেমধ্যে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে যেসব জমি উদ্ধার করা হচ্ছে দখলের তুলনায় তার পরিমাণ খুবই অনুল্লেখ্য। এবং যত দূর জানা যায়, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভূমির (জনসম্পত্তি) কমপক্ষে ৪০ শতাংশ বেদখল হয়ে রয়েছে। অনেক জমি তারা জাল দলিলের, জালিয়াতির-রেকর্ডপত্রের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে মালিকানাস্বত্ব পেয়ে গেছেন। এ দস্যুদের সিংহভাগ বিশেষ রাজনৈতিক দলের সমর্থনপুষ্ট বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।

ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফির প্রসার বাংলাদেশে এখন অকল্পনীয় পর্যায়ে আর টিভি চ্যানেলের অপসংস্কৃতির কারণেও এ ধরনের বিকারগ্রস্ততা ছড়ানো হচ্ছে অবাধে, ফলে কিশোর, তরুণ ও যুবাদের (এমনকি বয়স্ক একশ্রেণির মানুষের মধ্যেও) জৈবিক-বিকারগ্রস্ততার আগ্রাসন ভয়াবহ পর্যায়ে চলে গেছে। তার ফলে নারীর ওপরে যৌন-নিপীড়ন ও সার্বিক-সহিংসতা বাড়ছে ব্যাপক হারে। আমাদের দেশে নারীর ক্ষমতায়নের পথে যথেষ্ট অগ্রগতি হলেও এখনো ইভ-টিজিং আর পুরুষের জৈবিক বিকারগ্রস্ততার শিকার তারা। ফলে সেই ক্ষমতায়ন প্রতিকারমূলক সফলতা দিচ্ছে না। পুলিশের একটি বিশেষ ইউনিট পর্নোগ্রাফির ক্ষেত্রে কিছু কাজের কাজ করার চেষ্টা চালাচ্ছে; তবে তা নিতান্তই অপর্যাপ্ত, এ ব্যাপারে বিশাল বিনিয়োগে সাইবার বিশেষজ্ঞ গ্রুপ নিয়োগ করে বিকল্প পাল্টা ব্যবস্থা নিতে হবে। যাতে দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের কাছে পর্নোগ্রাফির আগ্রাসন পৌঁছতে না পারে, যাতে তা শতভাগ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়। তবে এটা সত্য, বর্তমান সরকার সে ব্যাপারে মোটেই গভীরভাবে ভেবে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার মতো প্রস্তুতির ধারেকাছেও নেই। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন পেশ করেছে। সে রিপোর্টে আছে মারাত্মক দুর্নীতির সব তথ্য। এ রিপোর্টে দেশে দুর্নীতির ১৩টি খাতে ৭৫টি উৎসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। একটি জাতীয় পর্যায়ের বাংলা দৈনিকে দেশের দুর্নীতি চিত্রের সারসংক্ষেপ ছাপা হয়েছে (১০ ফেব্রুয়ারি/২০২১)। এ রিপোর্টে স্বাস্থ্য খাতে শত প্রকার দুর্নীতির প্রামাণ্য তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। একইভাবে এ খাতেরই ওষুধ শিল্পে চলছে ভয়ানক নৈরাজ্য- আড়াই লাখ ফার্মেসির (ওষুধের দোকান) ৫০ শতাংশের বেশি প্রতি বছরই ঔষধ প্রশাসন পরিদফতরের (ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) সরাসরি পরিদর্শনের আওতাবহির্ভূত থেকে যাচ্ছে। ফলে নিষিদ্ধ ওষুধ বিদেশ থেকে চোরাপথে এসে বাজারজাত হচ্ছে। এ ছাড়া ওষুধ বাজারের নানা অনাচার চলছে পর্যাপ্ত পরিদর্শন ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়নের সংকটে।

ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশের বাজারে নকল, ভেজাল ও নিষিদ্ধ পণ্যের বেচাকেনা অবাধে চলছে, মানহীন পণ্যও ব্যাপকভাবে বাজারে আছে। এ সবকিছুই ভোক্তাদের স্বাস্থ্যহানি ঘটাচ্ছে মারাত্মকভাবে, গণমানুষের অর্থের লোপাট ঘটাচ্ছে। পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী নিষিদ্ধ পলিথিন অবাধে উৎপাদন ও বেচাকেনা এবং ক্রেতাসাধারণ কর্তৃক ব্যবহার চলছে বলে ওই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। ইটিপি (অ্যাফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট) চালু না করায় শিল্পকারখানাগুলোর ৭০-৮০ ভাগই নদী ও জলাশয় এবং সাধারণ ভূমির ওপরে ভয়ানক পরিবেশ দূষণ ঘটাচ্ছে। পরিবেশ দফতর হম্বিতম্বি করে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না।

নদীরক্ষা কমিশনের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ৬৪ জেলার ১৩৯টি নদী ব্যাপকভাবে দখল-দস্যুতার কবলে পড়ে সেগুলো মরে যাওয়ার পর্যায়ে চলে গেছে। ঢাকার বাইরের এ নদী-দখল দস্যুর সংখ্যা ৪৯ হাজার ১৬২। সড়কে নৈরাজ্যের বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। ১০ লক্ষাধিক নসিমন, করিমন, ভটভটি, ইজিবাইকসহ বিভিন্ন ধরনের ছোট ছোট অবৈধ যানবাহনে দেশ ভরে গেছে। এ অবৈধ যানগুলো এবং ২৬ লাখের মতো মোটরসাইকেল চালকরা বেআইনি-চালনার জন্য ব্যাপকভাবে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে চলেছে, প্রাণহানি ও আহত-হয়ে পঙ্গুত্ববরণের সংখ্যাও বেড়ে চলেছে সেটাও দুদক রিপোর্টে বলা দরকার ছিল, কিন্তু তা বলা হয়নি। বলা হয়নি, বিআরটিএ ও অন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবাধ ঘুষ-কালচারে মোটরগাড়ি চালকরা বেআইনি গাড়ি চালনায় উৎসাহিত হচ্ছে। চালকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ গ্রহণ ছাড়াই ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে। দুদকের রিপোর্টে বলা উচিত ছিল, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য ব্যাপকভাবে দায়ী সাধারণ মানুষের অসচেতনতা, দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কালচার, সেটা থেকে বেরিয়ে আসতে বিশেষ উদ্যোগ দরকার। তা দুদক বলারই প্রয়োজন বোধ করেনি। ১২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মুগদায় কিশোর গ্যাংয়ের এক কিশোর খুন হয়েছে, ছুরিকাঘাতে, প্রতিপক্ষ কিশোর গ্যাংয়ের হাতে। সারা দেশে এ রকম কত যে খুন হচ্ছে কিশোর গ্যাং কালচারে! আহত হচ্ছে প্রতিদিন কত তার হিসাব কে রাখে! ১০-১২ বছর ধরে এ কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য চরমে। অন্তত ৫০ জন কিশোর কিশোর গ্যাং কালচারের বলি হয়েছে প্রায় এক যুগে। বয়স্ক ব্যক্তিরাও তাদের হাতে মারা পড়েছে। মাদকাসক্ত কিশোররা মারামারি, খুনোখুনিতে সদাব্যস্ত। পাড়ায় পাড়ায় এসব কিশোরের হাতে লাঞ্ছিত হচ্ছেন বয়স্ক ব্যক্তিরা, নারীরা, বিশেষভাবে ইভ টিজিংয়ের শিকার কিশোরী ও তরুণীরা। সারা দেশে এ কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা কমপক্ষে ৫০০। রাজধানী ঢাকায় এ গ্যাংয়ের সংখ্যা শতাধিক। দেশের প্রতিটি নগরে, শহরে, গঞ্জে, হাটে বাজারে কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে। আর তারা বাড়াচ্ছে শত ধরনের অপরাধ আর অনাচার। তাদের সমর্থন করে যাচ্ছে বিশেষ রাজনৈতিক দলের নেতাদের একটা বড় অংশ, যার ফলে কিশোর গ্যাং কালচার উচ্ছেদ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। একটি দল ক্ষমতায় টানা ১২ বছর জেঁকে থাকায় গণতন্ত্রহীনতা এবং সুশাসনের অভাব একসঙ্গে হাতে হাত ধরে চলেছে, গণমানুষের নাভিশ্বাস উঠলেও প্রতিকার কিছুই হচ্ছে না। বিএনপি ও অন্য যেসব বিরোধী রাজনৈতিক দল এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে যাচ্ছে তাদের ওপরে তো জেল-জুলুম, হামলা-মামলা, নিপীড়ন চালিয়ে, ‘ডান্ডা মেরে ঠান্ডা’ করার ব্যবস্থা করছে কর্তৃত্ববাদী এ সরকার। এসবের একটা সুরাহা চাই আমরা। তা হতে হলে সবার আগে যথার্থ নির্বাচনের মাধ্যমে একটা প্রকৃত গণতান্ত্রিক সরকার ও সমাজ কায়েম করতে হবে। গণতন্ত্র শক্তপোক্ত না থাকলে সুশাসন আসতেই পারে না।

লেখক : বিএনপির যুগ্মমহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসু সাধারণ সম্পাদক।

সর্বশেষ খবর