শিরোনাম
শনিবার, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

ভাষার রাজনীতি-অর্থনীতি

ড. মঞ্জুরে খোদা

’৫২-এর ভাষা আন্দোলন মাতৃভাষার জন্য হয়নি, ভাষা আন্দোলন হয়েছিল রাষ্ট্রভাষার জন্য। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরোধ মাতৃভাষা নিয়ে ছিল না, ছিল রাষ্ট্রভাষার অধিকার নিয়ে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্যই সালাম-বরকত-রফিক-শফিকরা জীবন দিয়েছিলেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা ও এ দাবি আদায়ের সঙ্গে এ অঞ্চলের মানুষের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মুক্তি ও ঐতিহাসিক বঞ্চনার বিষয়টি যুক্ত ছিল।

ভাষা আন্দোলন শুধু নিছক বাংলা ভাষায় বাঙালি জনগোষ্ঠীর কথা বলার দাবি ছিল না। এর অন্তর্গত রাজনীতি ও অর্থনীতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। পূর্ববঙ্গে তখন শিল্পের বিকাশ ও নগরায়ণের অভিযাত্রা হয়েছে। দেশের আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তনের মাধ্যমে নাগরিকসমাজ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটছে। গ্রামীণ কৃষিকাজ, কৃষক পরিবার থেকে শিক্ষিত তরুণরা উন্নত জীবনের আশায় শহরমুখী হচ্ছে। সনাতন সামন্তবাদী সমাজকাঠামো ভেঙে তখন নতুন শ্রেণির বিন্যাস ঘটছে। সে সময়ের ইতিহাস এ ভাষা আন্দোলন।

পূর্ববঙ্গ ও উপমহাদেশ দীর্ঘকাল মুঘল শাসক ও ফারসি ভাষার অধীন ছিল। সেখানে রাজকাজ হতো ফারসিতে। এরপর ব্রিটিশ শাসনামলে সাম্রাজ্যের কাজকর্ম হতো ইংরেজিতে। শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা পশ্চাৎপদ সমাজ ও রাজনীতির কারণে বাংলা ভাষাভাষীর মানুষ ঐতিহাসিকভাবেই ছিল বঞ্চিত ও শোষিত। সেই জনগোষ্ঠীর সদ্যস্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। তারা তাদের মাতৃভাষার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম করতে পারবে, লেখাপড়া করতে পারবে, চাকরি-ব্যবস্যা করতে পারবে। কিন্তু সেখানেও আবার সেই একই বাধা। শাসক গোষ্ঠীর নতুন ষড়যন্ত্র। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করে উর্দুকে করার নকশা পাকা করে ফেলে শাসক। তখন বাঙালি শিক্ষিত তরুণ, বুদ্ধিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষ রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবিতে মরণপণ সংগ্রাম করে।

মাতৃভাষা মানে মায়ের ভাষায় কথা, সেটাতে আমাদের কোনো বাধা ছিল না। শাসক সেখানে বাধাগ্রস্ত করেনি। কিন্তু এ মায়ের ভাষাতেই যখন আমরা রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম করব, যোগাযোগ করব তখন শাসক বাধাগ্রস্ত করল। তার মানে বাঙালির কাজকর্ম করতে হলে নতুন করে আরেকটি বাড়তি ভাষা উর্দু শিখতে হবে।

ঘটনা কী দাঁড়াল? মুঘল আমলের আড়াই শ বছর এ জনগোষ্ঠী ফারসি ভাষা না জানার কারণে রাজকাজ ও সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ব্রিটিশ আমলের অনেক বছর বাঙালি ইংরেজি শিক্ষার অভাবে সরকার ও প্রশাসনে কাজ করতে পারেনি। শোষিত ও বঞ্চিত হয়েছে। নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের শাসকের এ নীতির কারণে ফের বাঙালি শোষিত, বঞ্চিত ও অধিকারহীন হবে। বাঙালিকে উন্নয়ন অংশীদারি থেকে দূরে রাখার আয়োজন হলো। মাতৃভাষার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কাজে ভূমিকা রাখতে না পারলে তারা এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে গৌণ হয়ে পড়বে। ভাষার কৌশলে ফের বাঙালিকে পেছনে ফেলে রাখার পরিকল্পনা করা হলো।

সুতরাং ভাষা আন্দোলন নিছক বাংলায় কথা বলার বিষয় ছিল না। ছিল রাষ্ট্রযন্ত্রে বাঙালি জনগোষ্ঠীর মালিকানা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। দীর্ঘ সংগ্রাম ও আত্মদানের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কাজের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।

একুশে ফেব্রুয়ারিকে অনেকে উৎসব-উদ্যাপনের বিষয় মনে করেন। একুশকে যারা শুধু উদ্যাপনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চান তারা আসলে এ সংগ্রামের তাৎপর্য ও গুরুত্বের বিষয়টিকে এড়িয়ে যেতে চান, অস্বীকার করতে চান অথবা বিষয়টি বুঝতে অক্ষম। এমনটা হলে তা হবে ভাষার জন্য আন্দোলনকারী আত্মদানকারী বীরদের প্রতি চরম অসম্মান ও অবজ্ঞা।

আমাদের সংবিধানে লেখা আছে বাংলা হবে আমাদের রাষ্ট্রভাষা, এটুকুই। কিন্তু এ চার শব্দই কি যথেষ্ট ভাষার রাজনীতি, অর্থনীতি ও অধিকার বুঝতে যথেষ্ট? না, মোটেই তা নয়। আমাদের দেশে আজ পর্যন্ত একটা ভাষানীতি নেই। ভাষানীতির কথা না হয় বাদই দিলাম, আজ পর্যন্ত ভাষা ব্যবহারের একটা পরিকল্পনাও তৈরি করা যায়নি। কেন? এখন তো মুঘল, ব্রিটিশ, পাকিস্তানিরা নেই! এখানেই শাসকের সামাজিক অবস্থার শ্রেণিদৃষ্টিভঙ্গি ও চরিত্র প্রকাশ পায়। ভাষার অধিকার, ভাষার স্বাধীনতার সঙ্গে ভাষার অর্থনীতি, রাজনীতি ও শোষণের প্রক্রিয়া বুঝতে হবে। তাহলেই একুশের চেতনার রাজনীতি ও অর্থনীতির সমীকরণ বোধগম্য হবে।

বাংলাকে আমরা সম্মান দিতে পারলেও এর মর্যাদা দিতে পারিনি। বাংলাকে আমরা আবেগের বিষয় মনে করলেও প্রয়োজনের বিষয় মনে করি না। ইংরেজিকে প্রয়োজন ও বেঁচে থাকার বিষয় মনে করি। কিন্তু এমন ভাবনার পরিবর্তন দরকার। কোন রাষ্ট্রে ভাষা কতটা গুরুত্ব ও প্রভাব নিয়ে আছে তা বুঝতে এর তিনটি ব্যবহারিক ও প্রায়োগিক ক্ষেত্রকে মানদন্ড হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া যায়; ১. উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ভাষার ব্যবহার ২. উচ্চ আদালত এবং ৩. গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি দাফতরিক কার্যক্রমে।

যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন তারাই ঠিক করেন রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে সে দেশের নাগরিকদের, কোন শ্রেণির নাগরিকদের কতটুকু সম্পৃক্ত করবেন। কাদের কাঠামোর বাইরে এবং কাদের কাঠামোর ভিতর অন্তর্ভুক্ত করবেন। দেশকে যদি লাখ-কোটি মানুষ দিয়ে চালাতে চান তাহলে বলা যায় প্রচলিত ইংরেজি যথেষ্ট। কিন্তু ১৬ কোটি মানুষের রাষ্ট্র এখানে অকার্যকর। ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া ব্যয়বহুল হওয়ায় সাধারণ ও দরিদ্র বাঙালি বাংলাতেই পড়ছে, ফলে শ্রেণিগতভাবে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা শুধু পিছিয়েই পড়ছে না, রাষ্ট্রকাঠামো থেকে বাদই পড়ে যাচ্ছে। ভাষার রাজনীতিই এ অবস্থা তৈরি করছে।

সর্বস্তরে বাংলা চালু করা গেলে, ক্ষমতাকাঠামোয় সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গেলে ৯০ ভাগ মানুষের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হবে। তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সর্বস্তরে বাংলা চালু হবে। একটি সম্ভাবনাময় ও বিকাশমান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ভাষার রাজনীতি ও অর্থনীতির আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ।

            লেখক : লেখক-গবেষক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর