সোমবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

সাতক্ষীরায় অর্থনৈতিক অঞ্চল

মুস্তফা লুৎফুল্লাহ

সাতক্ষীরায় অর্থনৈতিক অঞ্চল

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জেলা সাতক্ষীরা থেকে কলকাতা কাছে। কলকাতা একসময় ভারতের রাজধানী ছিল। এ জনপদের মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্য, জীবিকা, শিক্ষা ও চিকিৎসার কেন্দ্রবিন্দু ছিল কলকাতা। আর জীবিকা নির্বাহের প্রধান অবলম্বন ধান-পাট, তাঁত, মাদুর, মাছ, বিড়ি উৎপাদনের অন্যতম কেন্দ্র ছিল সাতক্ষীরা। দেশভাগের পর কলকাতার সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন হয়। তখন সাতক্ষীরার সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে পাশের যশোর, খুলনা, বাগেরহাট কিংবা নড়াইলের। সাতক্ষীরা থেকে ঢাকা বেশ দূরে। যাতায়াতব্যবস্থা দুরূহ। পণ্য আনা-নেওয়ার সময় ও ব্যয় বেশি। স্বল্প পুঁজির মানুষের পক্ষে ঢাকায় ব্যবসা করা কঠিন। ফলে আমাদের লোকজন ধীরে ধীরে কর্মহীন হয়ে পড়ে। বেকারত্বের ভয়াল থাবায় উন্নয়নের ছোঁয়া থেকে সাতক্ষীরা জেলা পিছিয়ে পড়ে। বর্তমান সরকার দেশের অর্থনীতির ভিত্তি সুদৃঢ় ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন জেলায় অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছে। সাতক্ষীরায়ও অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে ওঠার ব্যাপক প্রয়োজনীয়তা ও সম্ভাবনা রয়েছে।

দারিদ্র্যপীড়িত ও উপকূলীয় অঞ্চল সাতক্ষীরার সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের সংকট বহুমুখী। ব্রিটিশ-পূর্ব যুগে এ জেলার সর্বত্র গড়ে উঠেছিল অপরিকল্পিত গ্রামীণ সমাজ। তারা মাটির হাঁড়ি-পাতিল, টালি তৈরি করত। উৎপাদিত হতো সামান্য কৃষিপণ্য। তাতে অনেক সময়ই মানুষের চাহিদা পূরণ হতো না। বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ তছনছ করে দিত মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন। কোনো শিল্পকারখানা গড়ে ওঠেনি। কৃষি ও মাছ চাষ ছিল মানুষের প্রধান পেশা। শিক্ষার হার নিম্নগামী। নদী ভাঙনে বসত হারানো, পেশা বদল, বেকারত্ব রূপকথার মতো। এর পরিবর্তন আসে গত শতকের ষাটের দশকে সাতক্ষীরার উপকূলজুড়ে বিশেষ বাঁধ দেওয়ার পর। এ সময় কিছু ধানসহ কৃষিপণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের কর্মসংস্থান হয়।

স্বাধীনতার পর মানুষের জীবনযাপনে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসে। শুরু হয় বেঁচে থাকার লড়াই। ষাটের দশকে উপকূলীয় বাঁধে নদীতে পলি ভরাট হয়ে ব্যাপক এলাকা জলাবদ্ধ হয়। ফলে কৃষিজমিতে ব্যাপকভাবে তৈরি হয় মাছের ঘের। এতে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা জমি হারাতে থাকে। সবচেয়ে ক্ষতি করে লবণাক্ত পানি ও জলাবদ্ধতা। এতে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়। কৃষিপণ্য, জীবিকা বিপন্ন হওয়ায় খেতমজুর কৃষক কর্মসংস্থান হারানোর ফলে নতুন করে মানুষের অভিবাসন শুরু হয়। বর্তমানে জেলার ২২ লাখ মানুষের প্রধান পেশা কৃষি ও মাছ চাষ। এ ক্ষেত্রে দরিদ্র মানুষের জীবনে কোনো পরিবর্তন আসেনি। তাদের অনেকেই কৃষিজমি মহাজনের কাছে বর্গা দিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। এ সময় ব্যাপক হারে সাতক্ষীরার মানুষ অভিবাসিত হয়ে যশোর, নড়াইল, খুলনা, বাগেরহাটসহ বিভিন্ন এলাকায় আবাস গড়ে তোলে। ইউনেস্কোর বিশ্ব-ঐতিহ্যে জায়গা করে নেওয়া সুন্দরবনের অংশবিশেষ এ জেলায়। হারিকেন, সিডর, নার্গিস, আইলা, আম্ফানসহ একাধিক প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে এ সুন্দরবনই রক্ষা করেছে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এ সুন্দরবন হতে পারে বিশেষ পর্যটন কেন্দ্র। সাতক্ষীরায় একমাত্র ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান ছিল সুন্দরবন টেক্সটাইল মিল, যা বন্ধ হয়ে গেছে। সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এখানে শিল্পায়ন হয়নি। শিল্পের বিকাশ ঘটেনি। ২০১০ সালে দেশে অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের পরিকল্পনা গৃহীত হয়। তবে শুরুতে কাজ তেমন কিছুই হয়নি। গতি পায় মূলত ২০১৫ সালে। সরকারের লক্ষ্য ২০৩০ সাল নাগাদ দেশে ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা। এর মধ্যে ৯৩টি অর্থনৈতিক অঞ্চল অনুমোদন পেয়েছে। যদিও বাস্তবায়নাধীন রয়েছে সরকারি-বেসরকারি ২৮টি অর্থনৈতিক অঞ্চল। দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে এ উদ্যোগ প্রশংসনীয়। সাতক্ষীরায় একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার জন্য ২০১৮ সালে  উদ্যোগ নেওয়ার পরও অনিবার্য কারণে পরবর্তী কার্যক্রম গতিশীল হয়নি। করোনার আগে সারা দেশে দরিদ্রতা ছিল ২৩ শতাংশ আর সাতক্ষীরায় ছিল ৪২ শতাংশ। করোনাকালীন সংকটে সারা দেশের মতো এ জেলারও অনেক মানুষ কর্মবিমুখ হয়ে পড়ে। বেকারত্বের কারণে সাম্প্রদায়িক শক্তি লাভবান হচ্ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে অপরাধ। অন্যদিকে ঢাকায় কর্মরত অসংখ্য মানুষ কাজ হারিয়ে ফিরে এসেছে গ্রামে। অর্থাৎ বেকারত্ব ও দরিদ্রতা উভয়ই বাড়ছে। সাতক্ষীরা থেকে বহু মানুষ পরিবারসহ ঢাকায় যায় কাজের সন্ধানে। নারীরা যায় গার্মেন্টে। তাদের উদ্দেশ্য থাকে পরিবারকে সাহায্য করা। তারা জীবন-যাপনের ব্যয় সামলিয়ে পরিবারের জন্য তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। দেশের গার্মেন্টগুলো গড়ে উঠেছে ঢাকাকেন্দ্রিক। এর উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রপ্তানি হয় মূলত চট্টগ্রাম বন্দরকে কেন্দ্র করে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব প্রায় ২৫০ কিলোমিটার। রপ্তানি খরচ বেশি হয়। সাতক্ষীরায় অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠলে বাড়তি কিছু সুযোগ তৈরি হবে। প্রথমত উৎপাদন খরচ কমবে। ১০ হাজার টাকা বেতনের শ্রমিক কাজ শেষে বসবাস করবে নিজের বাড়িতে। এতে অর্থনৈতিকভাবে সে স্বাবলম্বী হবে। সবচেয়ে বড় সুবিধা জেলা সদর থেকে মোংলা সমুদ্রবন্দরের দূরত্ব মাত্র ৮০ কিলোমিটার। ভোমরা স্থলবন্দর ১৩ কিলোমিটার। প্রশস্ত সড়ক ও যানজটমুক্ত। অর্থাৎ পণ্য পরিবহন ও রপ্তানির ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পাওয়া যাবে। জেলায় বিদুৎ সরবরাহও যথেষ্ট ভালো। শ্রমও সহজলভ্য। কেবল গ্যাসের সংকট। এ সংকট দেশব্যাপী। প্রস্তাবিত ট্রেনলাইনও কাছে। অন্যদিকে পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে সাতক্ষীরার পণ্য সহজে দেশ-বিদেশে বাজার গড়ে তুলতে পারবে। কলকাতা কাছে হওয়ায় ভারতে এমনকি পাশের অন্যান্য দেশে সাতক্ষীরার উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি করা সহজ হবে। সামনে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। অথচ ৩০ শতাংশ মানুষ ভোট দিতে পারবে না। কারণ ইট উৎপাদনের মৌসুম হওয়ায় তারা দেশের বিভিন্ন জেলায় ইটভাটায় কাজে নিয়োজিত রয়েছে। দরিদ্র বাবা-মা ইটভাটায় কাজের উদ্দেশ্যে গেলে নিরাপত্তার কারণে স্কুলপড়ুয়া সন্তান সঙ্গে নিয়ে যায়। এর ফলে প্রচুর শিক্ষার্থী পড়াশোনা থেকে ঝরে পড়ছে। এ রকম তীব্র অর্থনৈতিক যন্ত্রণার মধ্য চলছে সাতক্ষীরার শ্রমজীবী মানুষ। সুতরাং সাতক্ষীরায় একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে ওঠা জরুরি। সাতক্ষীরায় উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে মাছ, আম, সবজি, নারকেল, চিনি, গুড় ইত্যাদি বিদেশে রপ্তানি হয়। বিশ্ববাজারে এসব পণ্যের বেশ চাহিদা আছে। অথচ উল্লিখিত পণ্যের বিকল্প উৎপাদন ও ব্যবহার বাড়ানো যাচ্ছে না। অর্থনৈতিক অঞ্চল হলে এখানে আরও অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প গড়ে উঠবে। সুদৃঢ় হবে দেশের অর্থনীতি। বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে সাতক্ষীরা জেলা।  লেখক : রাজনীতিবিদ।

সর্বশেষ খবর