মঙ্গলবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

কতটা সাবালক হলো বাংলা ভাষা

শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন

কতটা সাবালক হলো বাংলা ভাষা

ভাষার জন্য প্রাণ দিয়ে আমাদের কি বস্তুগত কোনো লাভ হয়েছে? যদিও এটি ঠিক যে, মানুষের বিদ্রোহ ও প্রতিবাদী চেতনাকে বস্তুগত লাভালাভের নিক্তিতে ওজন করা যায় না। তবু ভাষার জন্য যারা বুকের রক্ত দিয়ে রাজপথ রাঙিয়েছিলেন এবং যে জনগোষ্ঠী ছিল যুগপৎ তাদের সমর্থক ও সহযোদ্ধা, বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে তাদের কিছু আকাক্সক্ষা ছিল এবং এখনো আছে। চাওয়া-পাওয়ার সে নিক্তি দিয়ে ওজন করে বলতে হয়, নগদ লাভ যা হয়েছে তা হলো এ দেশের শাসক, এলিট, মধ্যবিত্ত ও হতদরিদ্র সবাই এখন বাংলায় কথা বলেন। ইতিহাস সাক্ষী, বাংলাদেশ নামক ভূখন্ডের শাসক ও উচ্চকোটির লোকেরা কখনো বাংলায় কথা বলতেন না।

সারা বিশ্বে বাংলাদেশি বাঙালির মাথার মুকুট হয়ে আছে এই ভাষা। বাংলাদেশি বাঙালির সামষ্টিক দ্রোহ ও অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক চেতনাটি প্রকাশিত হয়েছিল ভাষার আপসহীন দাবির মধ্য দিয়ে। ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়ে এ জাতি সারা বিশ্বে ভিন্নমাত্রিক অনন্যতা অর্জন করেছে। বাংলাদেশি বাঙালির ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়ার অভূতপূর্ব ঘটনার জন্য সারা বিশ্বের মানুষ এখন ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করেন। ১৯৫২ সালের পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু ও বাংলার দ্বন্দ্বে প্রবল প্রতাপশালী সংখ্যালঘুর উর্দুর চাপে হারিয়ে যেতে বসেছিল দুর্বল সংখ্যাগুরুর বাংলা। কিন্তু ক্ষমতায় দুর্বল হলেও বাংলাদেশি বাঙালিরা চেতনায় দুর্বল ছিল না। ফলে ভাষার জন্য প্রাণ দিয়ে তারা সংখ্যালঘুর দুর্বৃত্তপনা যেমন রুখে দিয়েছিল, তেমনি চিরতরে ফয়সালা করেছিল রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে বাংলার অবস্থানের প্রশ্নটিকে। তবে ১৯৫২ সালের আগেই মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও জীবনানন্দ দাশেরা বাংলা ভাষাকে ভারতীয় উপমহাদেশ ও বিশে^র দরবারে সম্মানজনক একটি আসনে বসিয়ে দিয়েছিলেন।

সংখ্যার বিচারে জনমানুষ কর্তৃক ব্যবহৃত ভাষার তালিকায় বাংলা হচ্ছে পৃথিবীর পঞ্চম ভাষা। এথনোলগের বিংশ সংস্করণ অনুযায়ী চীনা ভাষায় কথা বলেন ১২৮ কোটি ৪০ লাখ মানুষ; স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলেন ৪৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ; ইংরেজি ভাষায় কথা বলেন ৩৭ কোটি ২০ লাখ মানুষ, আরবি ভাষায় কথা বলেন ২৯ কোটি ৫০ লাখ মানুষ এবং বাংলা ভাষায় কথা বলেন ২৬ কোটি ৫০ লাখ মানুষ। সংখ্যার বিচারে বাংলা হিন্দি, পর্তুগিজ, রুশ ও জাপানি ভাষারও ওপরে। কিন্তু প্রায় ২৭ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বললেও বৈশিক ক্ষমতা, চাকরির বাজার ও তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা শুধু দুর্বল নয়, দুর্বলতর। বাংলা ভাষায় কথা বলা যায়, কবিতা ও সাহিত্য রচনা করা যায়, প্রেমিকপ্রবর তার প্রণয়-আকাক্সক্ষাও বাংলা ভাষায় পেশ করতে পারে তার প্রেয়সীর কাছে; কিন্তু ভালো চাকরি পেতে হলে, সামাজিক স্তরবিন্যাসে ‘জাতে উঠতে হলে’ বাংলা ভাষায় আর কুলায় না। এ কারণে হাজার বছরের পথ পরিক্রমা শেষে ২০২১ সালেও বাংলা মূলত ব্রাত্যজনের ভাষা হয়ে আছে।

একটি ভাষা, যতসংখ্যক মানুষই সে ভাষায় কথা বলুক না কেন মানুষের আকাক্সক্ষা ও চাহিদা মেটাতে পারে না যদি সে ভাষা প্রযুক্তির ভাষা হয়ে উঠতে না পারে; যদি ওই ভাষায় দক্ষ হয়ে ভালো চাকরি-বাকরি পাওয়া না যায়; যদি আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের চুক্তি ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে ওই ভাষা ব্যবহৃত না হয়। একটি ভাষার শক্তি ও সামর্থ্য কতটা তা ওজন করা যায় ওই ভাষায় রচিত সাহিত্য, দর্শন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা তত্ত্ব কতটা মৌলিক ও ধ্রুপদি এবং বিশে^র নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে তার অবদান কতটা তা দিয়ে। আবার একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বায়ন ও তথ্য-প্রযুক্তির যুগে কোনো ভাষা আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরির বাজার ও সাইবার স্পেসে কতটা শক্তিশালী তাও ভাষার সক্ষমতা বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মানদন্ড। একে ভাষার বস্তুগত ও ব্যবহারিক দিকের সক্ষমতা বলে অভিহিত করা যেতে পারে।

কবিগুরু তাঁর গীতাঞ্জলি ও বহুমুখী সাহিত্যিক রচনা দিয়ে নোবেল পুরস্কার যেমন জিতেছেন, তেমনি তাঁর একক প্রচেষ্টায় বাংলা ভাষাকে বিশে^র দরবারে একটি মর্যাদাপূর্ণ আসনে উন্নীত করেছেন। এর পরে বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আশাপূর্ণা দেবী, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, মুজতবা আলী, শামসুর রাহমান, শীর্ষেন্দু, সৈয়দ শামসুল হক, আহমদ ছফা, জয় গোস্বামীরা বাংলা ভাষাকে বিশে^র দরবারে কতটা এগিয়ে দিতে পেরেছেন সে প্রশ্নটি করা যেতে পারে। এদের প্রত্যেকেই শক্তিমান সাহিত্যিক এবং কেউ কেউ বহুমাত্রিক লেখক হলেও রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষাকে যেখানে পৌঁছে দিয়েছিলেন সেখান থেকে আমরা পিছিয়ে গেছি। দুঃখের বিষয়, ঔপনিবেশিক আমলে বাংলার কবিতা, সাহিত্য ও সৃজনশীল লেখনী যতটা শক্তিশালী ছিল স¦াধীন বাংলাদেশ ও স্বাধীন ভারতের পশ্চিম বাংলা, আসাম ও ত্রিপুরায় বাংলা ভাষার সৃজনশীলতার শক্তি ক্রমহ্রাসমান। বিশেষ করে বাংলাদেশে উন্নয়নের গতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কবিতা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির আকাশে ক্রমবর্ধমান খরা দৃশ্যমান।

পশ্চিম বাংলায় ইংরেজি ও হিন্দির চাপে বাংলা ভাষা কোণঠাসা হলেও ওখানকার কবি-সাহিত্যিক, নাট্যকার ও চলচ্চিত্রকাররা বাংলা ভাষাকে টিকিয়ে রেখেছেন। বাংলাদেশে হিন্দির চাপ নেই, আছে হিন্দি ফিল্ম ও ড্রামা সিরিয়ালের দৌরাত্ম্য ও আগ্রাসন। তবে বাংলাদেশের উচ্চকোটি, মধ্যবিত্ত ও নিম্নকোটির মানুষের সবাই বাংলা ভাষায় কথা বলেন। বাংলাদেশ নামক ভূখন্ডের হিন্দু শাসকদের দুর্বলতা ছিল সংস্কৃতির প্রতি, মুসলিম শাসকরা কথা বলতেন ফারসি, আরবি অথবা উর্দু ভাষায়, ব্রিটিশ শাসকরা কথা বলতেন ইংরেজিতে। ফলে বাংলা কখনো বাংলাদেশ নামক ভূখন্ডের শাসকদের ভাষা ছিল না। চাষা-ভূষা ও ব্রাত্যজনেরাই এ ভাষা বাঁচিয়ে রেখেছেন।

নিম্নকোটির চাষা-ভূষাদের ভাষার প্রতি সহজাত ভালোবাসা এবং ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়ার সুবাদে বাংলাদেশের শাসকরা এখন বাংলায় কথা বলেন। যদিও শাসকদের গুণী পরামর্শক ও বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞরা ইংরেজিতে পারদর্শী এবং বাংলার চেয়ে ইংরেজিতেই তারা স্বচ্ছন্দ, তবু বাংলা যে মন্ত্রী, আমলা ও আইনপ্রণেতাদের মুখের ভাষা হতে পেরেছে তাও বাংলার জন্য কম অর্জন নয়। কিন্তু চাকরি-বাকরির বাজার, আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও প্রযুক্তির ভাষা হিসেবে এখনো বাংলার অবস্থা নাজুক।

উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও বাংলাকে আমরা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রকৌশল, চিকিৎসা, আইন, অর্থনীতি, পদার্থবিদ্যা, ফার্মেসি, কম্পিউটার ইত্যাদি শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা এখনো শিক্ষার মাধ্যম হয়ে উঠতে পারেনি। এ ব্যাপারে উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের আইন শিক্ষা ও বিচার ব্যবস্থার উল্লেখ করতে পারি।

বাংলাদেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থা ব্রিটেনে বিকশিত ‘কমন ল’ সিস্টেমের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এ দেশের আইন শিক্ষা ও বিচার ব্যবস্থায় মূলত ইংলিশ আইনের নীতিমালা, ম্যাক্সিম ও মামলা পড়ানো ও অনুসরণ করা হয়। অনেক গুরুত্বপূর্ণ আইনের মূল বয়ান ইংরেজিতে, ল রিপোর্টগুলো ইংরেজিতে, রয়েছে পরিভাষার সমস্যা। আমার প্রায়শই মনে হয় বাংলাদেশে আইনের ভাষা দিয়ে সাধারণ মানুষ ও বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে এক দুর্ভেদ্য ও দুর্বোধ্য দেয়াল রচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশের আইন হয়ে গেছে ‘রক্তকরবীর রাজা’র মতো অভিজাত ও নিঃসঙ্গ।

কখনো কখনো প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি ও আইনমন্ত্রী পর্যায়ে কোনো কোনো আলোচনা সভায় বাংলা ভাষা নিয়ে বাকবিস্তার করা হয়েছে, কিন্তু আইনের ভাষাকে সহজ ও জনগণের বোধগম্য করার কার্যকর  উদ্যোগ এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়নি। সাবেক দুই প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান ও বিচারপতি খায়রুল হক বাংলায় রায় লিখে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। উচ্চ আদালতের বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন আট বছরে ৮ হাজার রায় ও আদেশ দিয়েছেন বাংলায়। কিন্তু বাংলাকে আইন শিক্ষার ভাষা করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে যে উদ্যোগ নেওয়ার কথা তা নেওয়া হয়নি, আইনের রায় বাংলায় লেখার জন্য উচ্চ আদালত ও সরকারের পক্ষ থেকে যে পদক্ষেপগুলো নেওয়ার কথা ছিল তাও নেওয়া হয়নি। ফলে প্রকৌশল, চিকিৎসা, আইন, অর্থনীতি ইত্যাদির উচ্চশিক্ষা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাকরি-বাকরির বাজার ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার অবস্থা আগে যেমন শোচনীয় ছিল, এখনো তেমনি শোচনীয়। শুধু ভাষার মাসে কিছু হাঁকডাক দিয়ে এ দৈন্য ঘুচবে না। শেষে কি এ প্রশ্ন তোলা যেতে পারে যে হাজার বছরের পথ পরিক্রমা শেষে বাংলা ভাষা কতটা সাবালকত্ব ও সক্ষমতা অর্জন করল?

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক।

সর্বশেষ খবর