শনিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

টিউলিপ ফোটাবে নতুন সম্ভাবনা

শাইখ সিরাজ

টিউলিপ ফোটাবে নতুন সম্ভাবনা

মনে পড়ে প্রথম টিউলিপ দেখেছি ক্যালেন্ডারের পাতায়। আদিগন্ত বিস্তৃত টিউলিপের সারি। দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এমন সুন্দর জায়গায় যদি যেতে পারতাম! এরপর টিউলিপ দেখেছি হিন্দি সিনেমায়। সেই অমিতাভ বচ্চন ও রেখা অভিনীত সিলসিলা চলচ্চিত্রের মনকাড়া গানের দৃশ্যে! (দেখা এক খোয়াব তো এ সিলসিলা হোয়ে) যে দৃশ্য দেখে মনে মনে ভেবেছি, আহা! এমন নিঃসর্গ যদি আমার দেশের মাটিতেও রচিত হতো! কিন্তু টিউলিপ ঠান্ডা দেশের ফুল। ১০-১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা লাগে এ ফুল চাষে। নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম বা কাশ্মীর বেড়াতে যেতেন যারা তারা ফিরে এসে গল্প করতেন টিউলিপের। কিংবা টিউলিপ বাগানে তাদের ছবি দেখে মন ভরে যেত। দেশ-বিদেশের ফুল চাষ নিয়ে প্রতিবেদন করতে ঘুরে বেড়িয়েছি জাপান, চীন, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। দেখেছি নেদারল্যান্ডসের কুকেনহফের ফুল দিয়ে রচিত স্বর্গীয় নিঃসর্গ। ফুল ঘিরে এমন রঙিন ও বিশাল আয়োজন আর আছে বলে আমার জানা নেই। সে আয়োজনের পুরোটাই টিউলিপ ঘিরে।

বাংলাদেশের মাটিতেও যে টিউলিপ চাষ হতে পারে সে অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কেওয়া পূর্বখন্ড গ্রামের দেলোয়ার-শেলী দম্পতি। এর আগে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো টিউলিপ ফোটানোর চেষ্টা করেছিলেন এক ইউরোপিয়ান বেলজিয়ামের জন পল পেরিন। ইউরোপিয়ান কাট ফ্লাওয়ার যেমন ক্রিসেনথিমাম, জারবেরা, কার্নিশা এ ফুলগুলো তার হাত ধরে চাষ এবং পরে সম্প্রসারিত হয়। বেলজিয়ান উন্নয়নকর্মী জন পল পেরিনের ফুল নিয়ে কাজের সূত্রে তাঁর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব। পেরিনের গভীর চেষ্টা ছিল এ দেশের মাটিতে বাণিজ্যিকভাবে টিউলিপ চাষ। কিন্তু আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় সে সময় টিউলিপ চাষে সফলতা পাননি পেরিন। তবে প্রায় ৪০ বছর পর বিস্ময়কর ঘটনাটি ঘটে গাজীপুরের শ্রীপুরে। পাঠক! হয়তো আপনাদের মনে আছে নেদারল্যান্ডসের রয়েল ভানজান্টা থেকে এ দম্পতি টিউলিপ চাষের প্রশিক্ষণ নিয়ে সেখান থেকে আনা টিউলিপের ১ হাজার বাল্ব রোপণ করেন গত বছর। বাল্ব হচ্ছে কন্দ। টিউলিপের কন্দ দেখতে ঠিক পিঁয়াজের মতো। একেকটি কন্দ থেকেই জন্ম নেয় একেকটি গাছ। ২ শতাংশ জমিতে ১ হাজার কন্দ থেকে মাত্র ২৫ দিনে কুঁড়ি থেকে ফুল হয়ে অদ্ভুত রঙের শোভা ছড়িয়েছিল টিউলিপ। ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’-এ তুলে ধরার পর তাঁদের এ প্রচেষ্টার খবর ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে এমনকি পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও। প্রথম বছরের সাফল্যের পর দ্বিতীয় বছর টিউলিপ নিয়ে কী ভাবছেন দেলোয়ার? কতটুকু এগোনো সম্ভব টিউলিপ নিয়ে? এ প্রশ্নগুলো তাঁর কাছে রেখে এসেছিলাম গত বছরই। এরপর দেলোয়ার ও শেলীর সঙ্গে আমার যোগাযোগ নিয়মিত। এর মাঝে জি-নাইন কলা নিয়ে তাঁদের প্রচেষ্টাও তুলে ধরেছি। গত এক বছরের মধ্যে দেলোয়ারের খামারে আমি তিনবার গিয়েছি। এর পেছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। দেলোয়ার আধুনিক ফল-ফসল উৎপাদনের উৎকর্ষ দেখিয়ে মানুষকে বেশ মুগ্ধ করছেন। গত বছর দেলোয়ারের কৃষি প্রকল্পে এসে অনেক উদ্যোগ দেখেছিলাম। টিউলিপ ও ফুল ছাড়াও স্ট্রবেরি, ক্যাপসিকাম, জি-নাইন কলা প্রভৃতি বৈচিত্র্যময় আধুনিক কৃষি নিয়ে মেতে আছেন দেলোয়ার। অনেক বাণিজ্যিক উদ্যোগ তাঁর। কোনোটি শুরু হচ্ছে, কোনোটি হয়ে গেছে। কোনোটি এরই মধ্যে সারা দেশে সাড়া ফেলেছে।

১৪ ফেব্রুয়ারি পয়লা ফাল্গুন- ভ্যালেন্টাইনস ডে। এ দিনটি ঘিরে সারা দেশেই ফুলবাণিজ্যের অন্যরকম চাঞ্চল্য। করোনা বিপর্যয়ের এই সময়ে ফুল চাষিদের জন্য এ দিনটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সারা দেশের প্রায় ৩০ লাখ মানুষ ফুল চাষ ও বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। আমাদের ফুলের বাজার প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার। করোনার অভিঘাতে সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয়েছে ফুল চাষিদের। প্রথম চার মাসেই বিক্রি করতে না পারায় ৪৫০ কোটি টাকার ফুল নষ্ট হয়েছে। ফুল বিক্রি করতে না পেরে ফুল চাষি ও ব্যবসায়ীদের চরম বিপাকে পড়তে হয়েছে। বেশি ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছেন যারা ঋণ করে এবং অন্যের জমি বর্গা নিয়ে ফুল চাষ করেছেন। তবে আশার কথা এ সময়ের ভিতর তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। স্বপ্ন বুনেছেন রঙিন ফুলের। তাদের খোঁজখবর নিতে গিয়ে মনে পড়ল টিউলিপের কথা। তাই আবার ছুটে গেলাম দেলোয়ার-শেলীর খামারে। ফেব্রুয়ারির রোদ্রোজ্জ্বল এক সকালে গিয়ে বিস্মিত হলাম। গতবারের তুলনায় আরও উজ্জ্বল হয়ে ফুটে আছে টিউলিপ। গত বছর দুই সারিতে ১ হাজার টিউলিপ ফোটার সাফল্য দেখিয়েছিলেন দেলোয়ার আর শেলী। সেটা ছিল একেবারেই পরীক্ষামূলক প্রচেষ্টা। এবার দেলোয়ার বিস্তার ঘটিয়েছেন টিউলিপ ফুল নিয়ে তাঁর বাণিজ্যিক যাত্রার। এবার আবাদি এলাকা বাড়িয়েছেন ৮ শতকে। নয়টি সারিতে ফুটেছে ২০ হাজার টিউলিপ। বেড়েছে টিউলিপের রঙের বাহারও। গতবার মাত্র দুটি রঙের ফোটালেও এবার তা ছড়িয়েছে ছয় রঙে। লাল, হলুদ, পিংক, কমলা, হালকা গোলাপি ও গাঢ় রঙের টিউলিপ শোভা পাচ্ছে তাঁর বাগানে। দেলোয়ার বলছেন, গতবারের প্রচারের পর এবার ব্যাপক সাড়া পড়েছে উদ্যোক্তা ও ক্রেতাদের মাঝে। দর্শনার্থীও আসছে প্রচুর। গতবার দেলোয়ার বলেছিলেন, দেশের উত্তরাঞ্চলে যেহেতু শীতের পরিমাণটা বেশি, টিউলিপ চাষের জন্য সেটি হতে পারে উৎকৃষ্ট এলাকা। তাই পরীক্ষামূলকভাবে এবার নিজেই টিউলিপের বাণিজ্যিক বাগান সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আগ্রহী উদ্যোক্তাদের মাঝে টিউলিপের বাল্ব সরবরাহ করছেন। যেমন ঠাকুরগাঁওয়ের ফুল চাষি রাহুল রায়কে দিয়েছেন টিউলিপের বাল্ব। চুয়াডাঙ্গার নূর হোসেনকেও দিয়েছেন। সেখানেও টিউলিপ বেশ ভালোভাবেই ফুটে তুলেছে তার রং। টিউলিপ নিয়ে যে রঙিন স্বপ্ন বুনছেন দেলোয়ার, তার পাশে এসে দাঁড়ানো উচিত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর। একটা অভিমান ধরা পড়ে দেলোয়ারের কণ্ঠে, ‘আমি যা করছি তা তো সরকারের কৃষি গবেষণা বিভাগ বা ফ্লোরিকালচার বিভাগের করা উচিত। তারা যদি গবেষণা করে একটা উপযোগী জাত আমাদের জন্য তৈরি করে দিতে পারতেন!’ উচ্চমূল্যের বিদেশি ফল-ফসল চাষে কৃতিত্ব পুরোটাই আমাদের কৃষকের। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সে অর্থে তেমন কোনো সহযোগিতা করেনি। প্রযুক্তিনির্ভর বাণিজ্যিক কৃষির এ যুগে আমাদের তরুণ কৃষক যতটা এগিয়ে ততটা এগিয়ে যেতে পারছে না রাষ্ট্রীয় কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউেটর ফ্লোরিকালচার একটা বিভাগ আছে। প্রশ্ন থাকে, এ বিভাগটির কাজের ফলাফল মাঠপর্যায়ে কোথায়?

হতাশা থাকলেও স্বপ্নের জায়গাটা দেলোয়ারের অনেক বড়। তাই হতাশা মুছে আশার কথাও শোনান। টিউলিপের দেশি বাজার একেবারে মন্দ নয়। শত কোটি টাকার একটা বাজার ইতিমধ্যে তৈরি হয়ে আছে। কোনোভাবে দেশি বাজার তৈরির পর সেখানে সাস্টেইন করতে পারলে আন্তর্জাতিক বাজারেও প্রবেশ সম্ভব হবে। স্বপ্ন এমনই হওয়া উচিত। যেমন দেলোয়ার টিউলিপকে নিয়ে ভাবছেন শেষ পর্যন্ত। এ বছর তিনি টিউলিপ বিক্রি করছেন পটে করে। পটপ্রতি টিউলিপের উৎপাদন খরচ ১২০ টাকা। বিক্রি করছেন ২০০ টাকায়। এতে তার লাখখানেক টাকা লাভ হয়েছে। বলছিলেন, একটা বাল্ব আনতে যে পরিমাণ খরচ সরকারকে দিতে হয় তা যদি প্রাথমিক পর্যায়ে কমানো যেত যেমন বাল্ব কোয়ারেন্টাইনে দিতে হয় ৬ থেকে ৭ টাকা, ট্যাক্স শতকরা ১০ টাকা, এগুলোও যদি কমানো যেত তাহলে টিউলিপ নিয়ে তাঁর গবেষণা আরও সহজ হয়ে আসত।

টিউলিপ দেখতে দেলোয়ারের খামারে দূরদূরান্ত থেকে লোকজন আসছে। ভিড় লেগেই আছে। ঢাকা থেকে গাড়ি করে অনেকে ঘুরতে যাচ্ছে সেখানে। টিউলিপের সঙ্গে ছবি তুলছে। ফেসবুকে দিচ্ছে। এ থেকে বোঝা যায় টিউলিপ হতে পারে কৃষি পর্যটনের একটি অনন্য ক্ষেত্র।

আমাদের দেশে ফুল এখন কৃষিবাণিজ্যে বেশ গুরুত্বের জায়গায় এসে যাচ্ছে। দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের বহু কৃষক যুক্ত রয়েছেন ফুল চাষে। প্রচলিত কৃষি থেকে বেরিয়ে বাণিজ্যিক ফুল চাষের মধ্য দিয়ে তারা শুধু ভাগ্যেরই পরিবর্তন করছেন না, কৃষি বাণিজ্য, অর্থনীতিসহ সব ক্ষেত্রে যুক্ত করেছেন তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এখানে সবচেয়ে আশার কথা হলো, গদখালীর কৃষক যেমন তাদের আবাদে যুক্ত করছেন নতুন নতুন ফুল, পৃথিবীর আধুনিকতম প্রযুক্তিগুলো ভেঙে তারা টেকসই প্রযুক্তিতে রূপান্তর করছেন। পৃথিবীর আধুনিক অনুশীলনগুলো দেখে ঝিনাইদহের মহেশপুরের তৃণমূল কৃষক এলইডি আলো ব্যবহার করছেন চন্দ্রমল্লিকা খেতে। এর মধ্য দিয়ে তারা পাচ্ছেন বহুমুখী সুফল। এরই ধারাবাহিকতা দেশের বাণিজ্যিক কৃষি তথা বাণিজ্যিক ফুল চাষে টিউলিপের সংযুক্তি। আশা করি অল্প দিনেই দেশের ফুল চাষে সম্ভাবনাময় জেলাগুলোয় বড় পরিসরে শুরু হয়ে যাবে টিউলিপের চাষ। ইউরোপের রঙিন আকর্ষণ কৃষিবাণিজ্যে নতুন শোভা ছড়াবে বাংলাদেশে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যদি দেলোয়ারের মতো উদ্যোগী কৃষকের পাশে দাঁড়ায় তবে বাংলাদেশের কৃষিও অগ্রসর হবে দুর্দান্ত গতিতে।

                লেখক : গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

সর্বশেষ খবর