শিরোনাম
মঙ্গলবার, ২ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও ঐতিহাসিকতা

শহীদুল্লাহ ফরায়জী

জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও ঐতিহাসিকতা

স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের আত্মপরিচয়ের প্রথম সোপান জাতীয় পতাকা। বিশ্বের মানচিত্রে ভৌগোলিক সীমানাকে বেষ্টন করে থাকে এ পতাকা। যেসব উপাদান রাষ্ট্র গঠনে ভূমিকা রাখে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পতাকা। পতাকা থেকে রাষ্ট্রকে কখনো বিচ্ছিন্ন করা যায় না। বাঙালি জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে দুজন বাঙালি স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহাসিক ঘটনায় জড়িত। একজন ভারতের স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলক আরেকজন স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলক। তাঁরা দুজনই স্বাধীনতার প্রশ্নে মানুষের অনমনীয় সংকল্প ও অদমনীয় আকাক্সক্ষার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। অস্তিত্বের বাস্তবতায় জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সাহসিকতাই তাঁদের ঐতিহাসিকতা।

একজন ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন আন্দামান-নিকোবর দ্বীপের রাজধানী ‘পোর্ট ব্লেয়ারে’ ১৯৪৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর। আরেকজন স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন চিরস্মরণীয় কিংবদন্তি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। আর জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সংগ্রামী নায়ক আ স ম আবদুর রব। বাঙালি জাতির ইতিহাসের সংগ্রহশালায় পতাকা উত্তোলনের এ দুটি ঘটনাই কেবল সংরক্ষিত আছে। নেতাজি উত্তোলন করেছিলেন তেরঙা পতাকা আর আ স ম রব উত্তোলন করেছিলেন লাল-সবুজের পতাকা।

একজন ব্রিটিশদের ভারত থেকে বিতাড়িত করার জন্য নিজের দেশ ত্যাগ করেছেন এবং ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ গঠন করে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছেন। আরেকজন স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করে নিজ দেশ ত্যাগ করে সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। দুজনেরই সংগ্রামের লক্ষ্য এক- স্বাধীনতা। একজন দেশমাতৃকার তরে ইহজীবন থেকে চিরতরে নিরুদ্দেশ আরেকজন স্বাধীনতা অর্জনের পরও আজও স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিরন্তর সংগ্রামে জড়িত।

নেতাজিই ছিলেন প্রথম ভারতীয় যিনি ২০০ বছরের পরাধীনতার গ্লানি থেকে আংশিক মুক্তির স্বাদ দেন। ব্রিটিশের দখলে থাকা ভারতের আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জকে প্রথম স্বাধীন বলে ঘোষণা করে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। ভারতের আন্দামানই প্রথম ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্ত হয়েছে।

সে সময় অবশ্য ভারতীয় জাতীয় পতাকা আজকের মতো ছিল না। সময়ের সঙ্গে নানাভাবে বদলেছে ভারতের জাতীয় পতাকা, একদম ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত। ভগিনী নিবেদিতা পতাকা, লোটাস পতাকা, বার্লিন ফ্ল্যাগ সর্বশেষ তেরঙা পতাকা। ১৯৩১ সালে জাতীয় কংগ্রেসের সভায় পতাকা চূড়ান্ত করা হয়। আর বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা চূড়ান্ত করা হয় নিউক্লিয়াসের সিদ্ধান্তে।

উল্লেখ্য, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু যুদ্ধের সময় ১৯৪৩ সালের আগস্টে ঘোষণা করেন, বছর শেষের আগেই ভারতের মাটিতে উপস্থিত হবে আজাদ হিন্দ ফৌজ। ১৯৪৩ সালের শেষের দিকে আজাদ হিন্দ সরকার জাপানিদের কাছ থেকে এ দ্বীপপুঞ্জের দখল নেয়। নেতাজি সুভাস বসু পোর্ট ব্লেয়ারে হাজির হন ২৯ ডিসেম্বর এবং তার পর দিনই ৩০ ডিসেম্বর প্রথমবার পোর্ট ব্লেয়ারে ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। নেতাজির পতাকা উত্তোলনের ৭৭তম বার্ষিকী পালিত হয়েছে ৩০ ডিসেম্বর, ২০২০ আর আ স ম আবদুর রবের পতাকা উত্তোলনের ৫০ বছর পালিত হচ্ছে ২ মার্চ, ২০২১।

নেতাজি স্বয়ং ভারতের এ দ্বীপপুঞ্জে স্বাধীন দেশের পতাকা উড়িয়ে এক বিশাল জনসভায় দেশকে ব্রিটিশ শাসনের কবল থেকে মুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সে ঘোষণার চার বছর পরই ভারতমাতা দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়।

১৯৭১ সালের ২ মার্চ লাখ লাখ ছাত্র-জনতার বিশাল সমুদ্রে তৎকালীন ডাকসু ভিপি আ স ম আবদুর রব পতাকা উত্তোলন করে বলেছিলেন আজ থেকে এটাই হবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে প্রকাশ হয়ে পড়ে স্বাধীনতা উন্মুখ বাঙালি জাতির আকাক্সক্ষা। দিনটি বাঙালি জাতির ইতিহাসে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। পতাকা উত্তোলনের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারদিকে কামান ট্যাংক জলকামান সজ্জিত ছিল। সে চিত্র ছিল খুবই ভয়াবহ। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে কোটি কোটি বাঙালির স্বপ্নের পতাকা উত্তোলন করতে হয়েছিল। স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন থেকে স্বাধীনতার জন্য রক্তলাল পতাকা উত্তোলন বিশ শতকের বিশ্ব রাজনীতিতে বিরল ঘটনা। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের বুকে আরেকটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা চেয়ে পতাকা উত্তোলন অকল্পনীয় ঘটনা।

২ মার্চ বাঙালি জাতির জীবনে ঐতিহাসিক দিন। এ দিন বাঙালি জাতি তার কাক্সিক্ষত স্বপ্নের পতাকা উড়তে দেখল জমিনের ওপর। স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের নির্দেশে ১ মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এ সময় সিদ্ধান্ত হয় ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্র-গণসমাবেশ অনুষ্ঠানের আর এ ছাত্র-গণসমাবেশে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে নিউক্লিয়াস। এ সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে স্বাধীনতা উন্মুখ বাঙালি জাতির পক্ষে আ স ম আবদুর রব স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন। এ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন নূরে আলম সিদ্দিকী। পতাকা উত্তোলনের সময় পাশেই ছিলেন শাজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখনসহ ছাত্রলীগের অন্যান্য নেতা।

সিরাজুল আলম খানের নির্দেশে এবং অনুমোদনে আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ আহমেদ, মার্শাল মণি, হাসানুল হক ইনু বাঙালি জাতির জন্য স্বাধীনতার পতাকা তৈরির পরিকল্পনা করেন। বাংলাদেশের পতাকার পরিকল্পনা হয় ১৯৭০ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইকবাল হলের ১১৬ নম্বর কক্ষে, যা ১৯৭১ সালে ২ মার্চ উত্তোলিত হয়। বাংলাদেশ নির্মাণে বহু গোপন সশস্ত্র সংগঠনের কর্মকান্ড ছিল কিন্তু কারও কোনো পতাকার প্রস্তাব ছিল না। বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকার পরিকল্পনা, উত্তোলন ও নির্মাণ সবকিছুতেই নিউক্লিয়াস ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ জড়িত ছিলেন।

’৫২-এর প্রেরণার পর ২ মার্চ পতাকা উত্তোলন, ৩ মার্চ ইশতেহার পাঠ, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সমগ্র জাতিকে সংগ্রামী ও বিপ্লবী আগুনে পুড়িয়ে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোয় পৌঁছে দেয়- জাতির মাঝে রাষ্ট্রের অনিবার্যতা স্পষ্ট হয়, জাতির অন্তরে বিপুল শক্তির জন্ম হয়।

লেখক : গীতিকার।

[email protected]

সর্বশেষ খবর