বুধবার, ৩ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন

ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গসহ মোট পাঁচটি রাজ্যে আগামী তিন মাসের মধ্যে বিধানসভা নির্বাচন সম্পন্ন হবে। পুবে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, দক্ষিণে কেরালা, তামিলনাড়ু ও পন্ডিচেরি। দেশ-বিদেশের নজর এবার পশ্চিমবঙ্গের দিকেই বেশি। তার কারণ এই প্রথম আরএসএস ও বিজেপি যৌথভাবে একদা মিত্র এবং বিজেপির জোটসঙ্গী মমতা ব্যানার্জিকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে শুরু করে নাগপুরের আরএসএসের সদর দফতরের প্রধান মোহন ভাগবতসহ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার অর্ধেকের বেশি মন্ত্রী এখন পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

প্রচারে মমতা ব্যানার্জি নিজে বলছেন, বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে পরগাছা। কংগ্রেস-সিপিএম জোট বলছে, এ পরগাছাকে পশ্চিমবঙ্গে এনে পুঁতে দিয়েছিলেন কেন? সেদিন তো বহুদর্শী প্রবীণ রাজনীতিবিদ জ্যোতি বসু বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের মতো এমন একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাজ্যে বিজেপির মতো হিন্দুত্ববাদীদের আনার পরিণাম কী হতে পারে। এখন এ রাজ্যে ঠিক সেটাই দেখা যাচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গে এক ভয়ংকর কান্ড চলছে। সন্ত্রাস আর সন্ত্রাস। চলছে গুলি-বোমা, আর সেই সঙ্গে টাকার হরিলুট। বস্তুত ১৯৬২ সালে প্রথম ভোট দিয়েছিলাম। তারপর দেশের বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচনের রিপোর্ট করেছি। কিন্তু এমন অস্বাভাবিক পরিস্থিতি কোথাও কখনো দেখিনি। হিন্দি বলয়ে নির্বাচন করতে গিয়ে আরএসএসের দাপট দেখেছি। কিন্তু সেই দাপটেও তারা ক্ষমতা দখল করতে পারেনি। এবার আসন্ন পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনে বিজেপির স্লোগান ক্ষমতা দখলের। কার ক্ষমতা কে দখল করবে? পশ্চিমবঙ্গ তো ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য!

বর্তমান নির্বাচনী প্রচারে বিজেপি এবং তৃণমূল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুটি স্লোগান চুরি করেছে। চুরি না বলে ডাকাতিও বলা যেতে পারে। মমতা এখন সভা-সমিতিতে গিয়ে ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করছেন। ওদিকে নরেন্দ্র মোদি থেকে অমিত শাহ, মোহন ভাগবতরা বলছেন, বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ দখল করে সোনার বাংলা গঠন করবে। যদিও গুজরাটি উচ্চারণে ‘সোনা’ শব্দটি ‘ছোনা’ শোনা যাচ্ছে।

এ যুদ্ধে কে হারবে কে জিতবে তা পশ্চিমবঙ্গসহ গোটা ভারতবর্ষ জানতে পারবে ২৩ মে, যেদিন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ফল প্রকাশ হবে। দুই পক্ষের যে খুব একটা জনসমর্থন রয়েছে তা এ পর্যন্ত মনে হচ্ছে না। ইতিমধ্যে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলো জোট বেঁধেছে। সিপিএমসহ বাম দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে জোট ঘোষণা করে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে কংগ্রেস। এ ব্যাপারে কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী দিল্লি থেকে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন আপাদমস্তক দুর্নীতিতে ডুবে থাকা তৃণমূল এবং সর্বাংশে সাম্প্রদায়িক বিজেপিকে ঠেকাতে ধর্মনিরপেক্ষ এ অসাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোকে এক হয়ে লড়াই করতে হবে। প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছিল পশ্চিমবঙ্গে হয়তো তৃণমূল ও বিজেপি এ দুই শক্তিই একমাত্র লড়াই করছে। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ জোট গঠনের পর এ রাজ্যে স্পষ্ট হয়ে গেছে ত্রিমুখী লড়াই। অতিসম্প্রতি এ জোটে শামিল হয়েছে আব্বাস সিদ্দিকির ধর্মনিরপেক্ষ ফ্রন্ট। এও শামিল হওয়ার ফলে সব অর্থেই ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলো সরাসরি চ্যালেঞ্জ করার মতো জায়গায় চলে এসেছে।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন এ জোটের ফলে বাম ও কংগ্রেসের নিজস্ব শক্ত ঘাঁটিগুলো ছাড়াও আরও অন্তত ৩০-৪০টি বিধানসভা আসনে এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়তে পারে। আর তা যদি সত্যিই হয় তবে রাষ্ট্রশক্তি, পুলিশ ও প্রশাসনের বলে বলীয়ান তৃণমূল ও টাকার বস্তা নিয়ে নির্বাচনে নামা বিজেপি যে কড়া প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে তা বলাই বাহুল্য।

পশ্চিমবঙ্গের এবারের বিধানসভা নির্বাচনের ঢাকে কাঠি পড়ার পরই দলবদলের হিড়িক শুরু হয়ে যায়। সারদা, নারদা এবং আরও একাধিক চিটকা- কেলেঙ্কারি, গরু পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত নেতা-মন্ত্রী, কয়লা পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত নেতা-মন্ত্রীরা বিজেপিতে যোগ দিতে শুরু করেন। সে প্রবণতা এখনো চলছে। ফলে তৃণমূল ঠিক করে উঠতে পারছে না দলের কতজন নেতা শেষ পর্যন্ত ওই দলে টিকে থাকবেন। তৃণমূলের একাধিক বড় নেতা বিজেপিতে চলে যাওয়ায় দলটির অবস্থা হয়েছে তাসের ঘরের মতো। একটা দমকা হাওয়ায় ভেঙে পড়তে পারে।

অন্যদিকে তৃণমূল বলে চলেছে বিজেপি একটি সাম্প্রদায়িক দল। একবার ক্ষমতা দখল করতে পারলে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও দলিতদের প্রাণ ওষ্ঠাগত করে ছাড়বে। একই সঙ্গে তারা বাঙালি তাসও খেলার চেষ্টা করে চলেছে। তাদের বক্তব্য উত্তর ভারতের গোবলয় ও নাগপুর থেকে আসা হিন্দুত্ববাদী নেতারা বাংলার সংস্কৃতি কিছুই বোঝেন না। কিন্তু তাতে এখনো চিড়ে ভিজেছে বলে মনে হচ্ছে না। মোদি বাহিনী যত নিজেদের হিন্দুত্ব স্টাইল চাপিয়ে দিচ্ছে তত বেশি করে মমতা ব্যানার্জি সংখ্যালঘু ভোটকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছেন। ফলে এক নতুন ধরনের সাম্প্রদায়িক সমীকরণ ভোটের বাজারে উঠে এসেছে। যার মর্মার্থ এবারের বিধানসভা নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক ইস্যু নেই। রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক দিশা নেই। লড়াই হচ্ছে কট্টর হিন্দুত্ব বনাম কট্টর সংখ্যালঘু আবেগের মধ্যে। এ যুদ্ধের ফল আপাতত যাই হোক না কেন এ প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার রেশ যে গঙ্গাপাড়ে বেশ কিছু দিন থাকবে তা জলের মতো পরিষ্কার।

আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের আগে রীতিমতো তপ্ত হয়ে উঠেছে এ বঙ্গের পরিবেশ। সম্প্রতি রাজ্যের এক মন্ত্রী জাকির হোসেনকে মুর্শিদাবাদের নিমতিতায় (বাংলাদেশ সীমান্তের খুব কাছে) আক্রমণ করা হয়। বোমা হামলা চালানো হয় তার ওপর। খোদ মন্ত্রীর ওপর এহেন হামলায় স্বভাবতই প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। রেলস্টেশনে (যা কিনা রেল বা কেন্দ্রীয় সরকারের নিরাপত্তায় রয়েছে) আইইডি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ওই মন্ত্রীকে খতম করার চেষ্টা হয়। মন্ত্রীর প্রাণ না গেলেও গুরুতর জখম হন। প্রাথমিকভাবে দাবি করা হয় তৃণমূলের অন্তর্দলীয় কোন্দলের ফলই এ হামলা। কিন্তু তদন্তে বেরিয়ে আসছে অন্য তথ্য। প্রথমত আইইডি বিস্ফোরণ ঘটানোর মতো রসদ ও প্রযুক্তি তৃণমূলের সর্বস্তরের দুর্বৃত্তদের কাছে থাকার কথা নয়। বরং তা থাকার কথা মুর্শিদাবাদের আনাচে-কানাচে থাকা জামায়াতপন্থিদের। দ্বিতীয়ত রেল যেহেতু কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন সংস্থা তাই সেখানে আইনশৃঙ্খলার কোনো ইস্যুতে দিল্লির সরকার সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারে। গত বিধানসভা নির্বাচনের সময় থেকেই বিজেপির অভিযোগ ছিল মমতা ব্যানার্জির সংখ্যালঘু ভোট দখলের চেষ্টা এমন পর্যায়ে গেছে যে, জামায়াতপন্থি দুষ্কৃতকারীদের ব্যবহার করতেও তার দল দুবার ভাবে না। এহেন পরিস্থিতিতে এ বিস্ফোরণের তদন্ত যে সেদিকেই নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হবে তা বুঝতে আইনস্টাইন হওয়ার দরকার পড়ে না।

            লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর