শুক্রবার, ৫ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

সংবাদপত্রের সঙ্গে আমার যোগসূত্রতা

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

সংবাদপত্রের সঙ্গে আমার যোগসূত্রতা

সংবাদপত্রের সঙ্গে আমার সংযোগ দুই ধারায়। পাঠক হিসেবে এবং লেখক হিসেবে। পাঠক তো মনে হয় আমি তখন থেকেই যখন ঠিকমতো পড়তে শিখেছি। শুনতে পাই এবং দেখতেও পাই যে, খবরের কাগজ এখন আর আগের মতো নেই। পড়ার মতো জিনিস থাকে কম, বিজ্ঞাপন অধিক এবং ছবির ভীষণ ভিড়। তবু সংবাদপত্র না পড়লে আমার চলে না। দিন শুরু করি ওই পাঠ দিয়েই, আগে যেমন করতাম।

দ্বিতীয় সংযোগ লেখালেখির কারণে। ওই অভ্যাসটার সূত্রপাতও কৈশোরেই। কৈশোরে কিশোরদের পাতাতে লিখতাম, পরে এসেছি বড়দের অংশে। সংবাদপত্রের পাঠাভ্যাসটার শুরুও ওই কিশোরদের পাতা থেকেই। পত্রিকা সম্বন্ধে এখন আমার একটা অভিযোগ এই যে, কিশোরদের পাতা আছে বটে, কিন্তু রয়েছে বড়ই কোণঠাসা দশাতে। কিশোরদের ব্যাপারে বিবেচনার এই অভাবটা গোটা সমাজেই বিদ্যমান, যে জন্য কিশোররা বিপথগামী হচ্ছে, হয়ে পড়ছে অপরাধপ্রবণও। টের পাই যে, আমার নিজের ভিতরকার কিশোরটি এখনো বৃদ্ধ হয়নি, ওই কিশোরটি কিশোরদের প্রাণবন্ত পাতা খোঁজে এবং পায় না।

লেখার কথা বলছিলাম। লেখা তো প্রকাশের জন্যই। সংবাদপত্রে লেখার ভিতর একটা আলাদা আনন্দ আছে; সেটা হচ্ছে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা না-করার। দ্রুত মুদ্রিত হয় এবং হাতে চলে আসে, আশা করতে পারি যে পৌঁছেছে সেটা অন্যদের মনোযোগের জগতে না হোক অন্ততপক্ষে গোচরের জগতে।

পত্রিকার সঙ্গে আমার আত্মীয়তার তৃতীয় একটি গ্রন্থিও আছে। তা হচ্ছে সম্পাদনা। শুরু করেছি হাতে লেখা পত্রিকা দিয়ে, তারপর দেয়ালপত্রিকা, সেটা পার হয়ে এসেছি ছাপা পত্রিকায়। এ কাজটা আমার জন্য খুবই আনন্দের। আমার পেশাগত কাজ শিক্ষকতা, সে-কাজে আনন্দ আছে, আনন্দ পেয়েছি লেখাতেও, আর বিশেষ রকমের আনন্দ পত্রিকা সম্পাদনায়। বার্ষিক, ষাণ¥াসিক, ত্রৈমাসিক, মাসিক, এমনকি সাপ্তাহিক পত্রিকাও আমি সম্পাদনা করেছি; ষোল বছর ধরে সম্পাদনা করছি একটি ত্রৈমাসিক। আমি শিক্ষকতায় এসেছি স্রোতের টানে, পারলে সাংবাদিকই হতাম- রিপোর্টিং অংশের নয়, সম্পাদকীয় বিভাগের। এ জন্যই বলছিলাম আপনারা যে সম্মাননা জানাচ্ছেন, সেটা বাইরের কাউকে নয়, ভিতরের একজনকেই। এবং ভিতরের হওয়ার জন্যই আমার কাছে এটি আত্মীয়ের উপহার।

খবরের কাগজের কাছে মানুষ এমনি এমনি যায় না, যায় প্রত্যাশা নিয়ে। প্রথম প্রত্যাশা সংবাদের। গরম গরম খবরগুলো আসে দুই দিক থেকে- অপরাধের এবং রাজনীতির। তা আসুক; কিন্তু আঁতের খবরটাও তো চায় লোকে, মুখ ফুটে সেটা তারা বলুক আর না-ই বলুক। আঁতের খবর হচ্ছে অপরাধ কেন ঘটে এবং রাজনীতি কেন ভিন্ন রকমের হয় না, সেই কার্যকারণের। প্রত্যাশার ব্যাপারে আরও একটা জিনিসের মুখোমুখি হই আমরা। সেটা হলো নিরপেক্ষতা। এই বিশ্বসংসারে নিরপেক্ষতা বলে সত্যি সত্যি কোনো কিছু আছে কি? বিশেষ করে সেখানে তো নেই-ই, থাকতেই পারে না, যেখানে দ্বন্দ্ব চলছে ন্যায়ের সঙ্গে অন্যায়ের। রাষ্ট্র ও সমাজে ওই দ্বন্দ্বটাই চালু রয়েছে- ন্যায়ের সঙ্গে অন্যায়ের। এই যুদ্ধে যদি কেউ বলেন তিনি নিরপেক্ষ, বুঝতে হবে তিনি সত্য কথা বলছেন না, বা ভয় পাচ্ছেন সত্যের মুখোমুখি হতে। নিরপেক্ষ থাকার অর্থটা তো দাঁড়ায় অন্যায়কে দেখেও না-দেখা এবং পরোক্ষে অন্যায়কেই সমর্থন দেওয়া। সংবাদপত্রের কাছে নিরপেক্ষতার নয়, প্রত্যাশাটা হচ্ছে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর।

তবে সমস্যা আছে। বড় সমস্যা হলো ঝুঁকির। ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে এবং প্রায়শ হয়ও। ঘটনা অবশ্য আরও আছে। সেটা হলো স্বার্থ। স্বার্থের নিষেধাজ্ঞা থাকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ব্যাপারে। তা ছাড়া এটাও তো সত্য যে, ন্যায়-অন্যায়ের বোধটা দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারও। শিকারির দৃষ্টিতে যেটা ন্যায়, শিকারের দৃষ্টিতে সেটা ঘোরতর অন্যায়। প্রশ্নটা তাই ওঠে, আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখছেন। পাঠক চায় সংবাদপত্রের দৃষ্টিটা হবে জনস্বার্থের। চায় ন্যায়-অন্যায়ের বিচারটা ঘটুক জনগণের স্বার্থের দৃষ্টিতে। নিরপেক্ষতা নয়, চায় প্রবল পক্ষপাতিত্ব; চায় অন্যায়ের দ্বারা নিপীড়িত জনগণের পক্ষে দাঁড়ানো।

যাকে আমরা দেশ বলি সেটা তো আসলে ওই জনগণই। দেশপ্রেম মানে দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা। মানুষই সৃষ্টি করে, মানুষের ভিতর রয়েছে শক্তি ও সম্ভাবনা। আমাদের এই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘটেছে একটি জনযুদ্ধের ভিতর দিয়ে। যুদ্ধ জনগণই করেছে। প্রাণ দিয়েছে, আশ্রয় হারিয়েছে। কিন্তু তাদের মুক্তি আসেনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসের কথা আমরা বলি। বলাটা খুবই দরকার। কিন্তু ওই চেতনাটা আসলে যে কী তা বুঝতে চাই না। স্বার্থ চলে আসে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে। তাই এই কথাটা বলা হয় না যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আসলে সমাজ বিপ্লবের চেতনা। সমাজে এবং রাষ্ট্রে মানুষ একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন চেয়েছে। তা হলো সম্পর্কের পরিবর্তন। আগের সম্পর্কটা ছিল শাসক ও শাসিতের। প্রত্যাশা ছিল নতুন সম্পর্ক হবে মানুষের সঙ্গে মানুষের। প্রতিষ্ঠা ঘটবে অধিকার ও সুযোগের সাম্যের; বিকেন্দ্রীকরণ ঘটবে ক্ষমতার, এবং সর্বস্তরে কার্যকর হবে নির্বাচিত জনপ্রতিধিদের শাসন। মুক্তির স্বপ্নটা বড় রাষ্ট্রকে ভেঙে ছোট রাষ্ট্র করার ছিল না, ছিল জনগণের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটেনি; বাস্তবতা চলে গেছে সম্পূর্ণ উল্টো দিকে। প্রত্যাশা হলো অন্যায় রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ব্যবস্থাটাকে ভেঙে ফেলা, অবারিত করা অবরুদ্ধ জনক্ষমতা ও জনমুক্তিকে।

এ কাজে মিডিয়া খুব বড় একটা ভূমিকা পালন করতে পারে। একালে মিডিয়া অনেক কিছু। প্রায় সবকিছুই করতে পারে। বাংলাদেশে মিডিয়া এখন খুবই তৎপর। মিডিয়াতে শত শত কর্মীর ব্যস্ততা দেখি, দেখতে পাই যে, এদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ। রিপোর্টার্স ইউনিটি ভবনে দ্বিপ্রাহরিক আহারের সময় কয়েক শ সংবাদকর্মী মিলিত হন। অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে তাঁরা জীবিকার জন্য যেমন কাজ করছেন, তেমনি জীবনের কথাও ভাবেন। জীবন বলতে কেবল ব্যক্তিগত জীবন বোঝায় না। ব্যক্তিগত জীবন তো জীবিকার হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে আছে। তরুণ সাংবাদিকরা ভাবেন সমষ্টিগত জীবনের কথাও। ব্যক্তিগত জীবনটা সংকীর্ণ, আবদ্ধ, সমষ্টিগত জীবন প্রশস্ত, উন্মুক্ত। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ব্যবস্থা চাইছে আমাদের বিচ্ছিন্ন, আত্মকেন্দ্রিক ও ব্যক্তিস্বার্থসর্বস্ব করে ফেলতে। সে জীবন তো জীবন নয়, মাকড়সার জালে আটকে থাকা মাত্র।

আমাদের সমষ্টিগত সংগ্রামটা ছিল ‘মিলবার, মিলিতভাবে সংগ্রাম করবার, পুরাতন ব্যবস্থাটাকে বদলে ফেলবার’। সেখান থেকে আমাদেরকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সরানোর কাজটা ওই ব্যবস্থাই করেছে। ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাবে’- এ  কামনা সব মাতার, সব পিতার। কিন্তু কেবল আমার সন্তানের কথা ভাবতে গেলে তো অন্যের সন্তান আমার সন্তানের জন্য প্রথমে প্রতিদ্বন্দ্বী, পরে প্রতিপক্ষ এবং অবশেষে শত্রুপক্ষ হয়ে দাঁড়াবে। সেটাই এখন ঘটছে।

পরিসর নেই মিলবার, সামাজিকতা গেছে শুকিয়ে, সাংস্কৃতিক জীবন চলে এসেছে ঘরের ভিতরে, স্থির হয়েছে সে ফেসবুকে, মোবাইল ফোনে ও ইন্টারনেটে। লোকে এখন প্রকৃতি দেখে না, সেলফিতে নিজেকে দেখে। মনুষ্যত্ব প্রতিনিয়ত পর্যুদস্ত হচ্ছে মুনাফালিপ্সার পদতলে। ওদিকে প্রকৃতি ক্রমাগত শিকার হচ্ছে নৃশংস আক্রমণের। আক্রান্ত হয়ে সে প্রতিশোধ নিচ্ছে মানুষের ওপর। ব্যাপার দেখে অতবড় বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিন্স রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়েছিলেন : তাঁর মনে হচ্ছিল মানুষের বাসভূমি এই গ্রহ শেষ পর্যন্ত ধ্বংসই হয়ে যাবে। তিনি চলে গেছেন, তাঁর সতর্কবাণীটি কিন্তু রয়ে গেছে।

তবে মানুষ পরাজয় মানবে না; মানেনি অতীতে, মানবে না বর্তমানে, এবং মানবে না ভবিষ্যতেও। লড়াইটা ব্যবস্থা বদলের। সে লড়াইয়ের জন্য সচেতনতা চাই। ওই সচেতনতা এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অভিন্ন এবং অবিচ্ছেদ্য।

এসব কথা মোটেই অভিনব নয়। কিন্তু এদেরকে স্মরণ রাখা দরকার। আমাদের মিলতে হবে সাংস্কৃতিকভাবে, সামাজিকভাবে। কেবল বিশেষ অনুষ্ঠানে নয়, মিলতে হবে প্রত্যহ। সারা দেশে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলা চাই। ব্যবস্থা বদলের জন্য বিশ্বজুড়ে আজ সংগ্রাম চলছে, সেই সংগ্রামে যুক্ত হওয়া চাই, রাজনৈতিকভাবে। এ রাজনীতি মুনাফার নয়, মনুষ্যত্বের; দলাদলির নয়, ব্যবস্থাবদলের। বিশ্বজুড়ে এখন চলছে চরম ফ্যাসিবাদী তৎপরতা, রাষ্ট্র পরিণত হয়েছে মানুষের শত্রুতে। এর বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম তা যেমন স্থানীয় তেমনি আন্তর্জাতিকও। কেননা ব্যবস্থাটা বিশ্বব্যাপী বিরাজমান। ব্যবস্থাটা বিশ্বায়নের নাম নিয়েছে, তার আসল নাম পুঁজিবাদ।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর