মঙ্গলবার, ৯ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

স্বপ্নবাজ হতে হবে ইতিবাচক দৃষ্টিতে

খায়রুল কবীর খোকন

স্বপ্নবাজ হতে হবে ইতিবাচক দৃষ্টিতে

১৯৮০-এর দশক অবধি ‘স্বপ্নবাজ’ শব্দটি আমাদের সমাজে তেমন একটা প্রচলিত ছিল না। যত দূর মনে পড়ে আশির দশকের শেষ দিকে আমাদের দেশের একজন শক্তিমান লেখক নাসরিন জাহানের একটি মঞ্চনাটক বিদগ্ধ নাগরিক সমাজে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। নাগরিক নাট্যসম্প্রদায় প্রযোজিত নাটকটির নাম ‘স্বপ্নবাজ’। তাতে সমাজে নারীর আসল ক্ষমতায়নের সংকট তুলে ধরা হয়েছিল। নিজে একজন শক্ত নারী ব্যক্তিত্ব হওয়ায় নাসরিন জাহান অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তাঁর ‘স্বপ্নবাজ’ নাটকে নারীর প্রকৃত অবস্থানগত দুর্বলতার দিকটি চিত্রায়িত করেছিলেন একজন জীবনশিল্পীর তুলিতে। পুরুষতান্ত্রিকতার তীরন্দাজ সব অর্জুনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তা রুখে দেওয়ার নায়ক যে নারী সে-ই তো আসল স্বপ্নবাজ। সেটাই কথাশিল্পী, নাট্যকার নাসরিন জাহানের স্বপ্নবাজ-এর প্রধান চরিত্র, সেই লড়াকু নারীর চরিত্র নির্মাণে তিনি সার্থক। এর পর থেকে ‘স্বপ্নবাজ’ শব্দটি বেশ পরিচিতি পায় আমাদের সাহিত্য ও সমাজে।

স্বপ্নবাজ মানুষই তো আমরা চাই। যে আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজকে, গণমানুষকে মুক্তির লড়াইয়ে এগিয়ে নেবে। আমাদের রাজনীতিকদের কাছে গণমানুষের প্রত্যাশা তো সেটাই। আমাদের জাতীয় নেতা শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বাঙালির শোষণমুক্তির, সমৃদ্ধ জীবনের স্বপ্ন দেখতেন, তাই তো ছিলেন তাঁরা স্বপ্নবাজ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি নয়া ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের জাঁতাকল থেকে আমাদের জাতির মুক্তির স্বপ্ন দেখতেন, তাই লড়াই করে গেছেন, তিনি আরেক বড় স্বপ্নবাজ। জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধে বিশাল মাপের এক বীর হিসেবে ছিলেন আমাদের জাতীয় স্বাধীনতার আরেক বড় স্বপ্নবাজ। সত্তর দশকের শেষভাগে তিনি ছিলেন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আরও বড় মাপের স্বপ্নবাজ- বাংলাদেশি জাতিকে সারা দুনিয়ার বুকে সুপ্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে রাষ্ট্রনায়কের ভূমিকায়। এ দেশে দুই প্রধান রাজনৈতিক ধারার দুই নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা আশির দশকের নব্বইয়ের ডিসেম্বর অবধি স্বৈরাচার তাড়ানো ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে ছিলেন প্রবল শক্তিমান দুই স্বপ্নবাজ। তাদের যুদ্ধ সফল হয়েছে, স্বৈরাচারের পতন ঘটেছে, গণতন্ত্র ফিরে এসেছে। এরপর নানা ঘটনা আর দুর্বিপাকে গণতন্ত্র এখন পুনরায় ফেরারি। গণতন্ত্রের লেবাসে কর্তৃত্ববাদী শাসন চলছে। স্বপ্নবাজের বাংলাদেশ এখন গণতন্ত্রহারা, দুঃশাসনে নাভিশ্বাস তার। এখনকার স্বপ্নবাজ মানুষ ক্ষমতার রাজনীতির দুর্বৃত্তদের ‘বুনো-ষাঁড় শিং-গুঁতো’য় দৌড়ের ওপরে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিঃসন্দেহেই একজন স্বপ্নবাজ রাজনীতিবিদ, এ দেশকে নিয়ে তাঁর স্বপ্ন আছে হাজার রকমের। ১২ বছর ধরে তিনি একটানা প্রধানমন্ত্রী। তিনি তাঁর সে স্বপ্নগুলোর কথা প্রায়ই সভা-বৈঠকে সোচ্চার উচ্চারণে বলে থাকেন। যারা দুই বেলা দুই মুঠো খেতে পেলেই মহাখুশি, আর কিছু চান না, সেই সাধারণ মানুষের বেশ আনন্দই হয় তাতে। হয়তো বা নিরেট-মগজ আনন্দ! শেখ হাসিনা সম্প্রতি দেশ-গঠনে সবাইকে দেশপ্রেমিক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের আগেই উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলব ইনশা আল্লাহ।’ তিনি গত ২৩ ফেব্রুয়ারি যশোরের বিমানবাহিনী বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান ঘাঁটিতে বিমানসেনাদের এক অনুষ্ঠানে ভার্চুয়াল ভাষণে এ কথা বলেন।

যুগে যুগে যারাই কোনো না কোনো রাষ্ট্র-সরকার পরিচালনা করেছেন তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই এ রকম স্বপ্ন ছিল, কিছু না কিছু। স্বপ্ন ছিল তাদের নিজ নিজ রাষ্ট্র ও মানুষের কল্যাণে। রাষ্ট্রনায়ক বা রাষ্ট্রক্ষমতার খলনায়ক প্রত্যেকেরই তো স্বপ্ন ছিল, স্বপ্ন থাকে। স্বপ্ন না থাকলে কেউ ঝুঁকি নিয়ে, কষ্ট করে, শ্রম-মেধা বিনিয়োগ করে সরকার চালাতে যাবেন কেন? আসলে দুনিয়ার প্রতিটি মানুষেরই কোনো না কোনো স্বপ্ন থাকে, স্বপ্ন নিয়েই মানুষ বাঁচে, অন্তত সাধারণ স্বাভাবিক মানুষ তো সেভাবেই বাঁচে। একেবারে শতভাগ নিরেট-মগজ বা চরম-মানসিক প্রতিবন্ধীর স্বপ্ন থাকে না, কারণ তার তো বোধশক্তিই কাজ করে না। তারা ব্যতিক্রম। মানসিকভাবে সুস্থ, স্বাভাবিক অন্য সব মানুষেরই নিজস্ব স্বপ্ন থাকে, আপন স্বপ্নভূমে তার অবশ্যই বসবাসের একটা জায়গা থাকে। সেটাই তাকে সামনে নিয়ে যায়, সব উদ্যোগের সাফল্যের পথে এগিয়ে দেয়, জীবনের নতুন নতুন পথের সন্ধানে সে লড়াই চালিয়ে যেতে চায়।

বলা হয়, মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। স্বপ্নহীন মানুষ তো জীবন্মৃতই। প্রতিটি মানুষকে স্বপ্ন দেখেই জীবনের চলার পথে এগোতে হবে। তুমুল লড়াই করে বাঁচতে হবে। আর কোনো রাজনীতিবিদ যিনি সরকারপ্রধান তার তো স্বপ্ন থাকবেই, তিনি হবেন প্রকৃত স্বপ্নবাজ- রাষ্ট্রের কল্যাণে, তার দেশের গণমানুষের মঙ্গল-প্রচেষ্টায় সর্বোচ্চ তৎপরতা চালানোর অঙ্গীকারে। তবে সেখানেই কথা আসে। কথাটা এই- অ্যাডলফ হিটলারেরও তো স্বপ্ন ছিল, তিনিও তো ছিলেন এক স্বপ্নবাজ নেতা-জার্মান জাতিকে বিশে^র সেরা জাতিতে রূপান্তরিত করে সারা দুনিয়াকে জার্মান-জাতির বশংবদরূপে, উপনিবেশরূপে প্রতিষ্ঠার, সবাইকে দাস বাননোর। সেই স্বপ্নবাজ হিটলারের দানবীয় রূপান্তরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কোটি কোটি মানুষ নিহত হয়েছে, কোটি কোটি মানুষ আহত ও পঙ্গু হয়েছে, দুনিয়ার ব্যাপক এলাকা বোমার আর গোলার আগুনে পুড়ে ছারখার হয়েছে, আর শত কোটি লোক ক্ষুধা-পীড়ন, নিদারুণ-অপুষ্টি আর দারিদ্র্যের চরম-আঘাতে নরক-যন্ত্রণা ভোগ করেছে। তাই সহজেই অভিমত দেওয়া যায়- স্বপ্ন মহামানবের যেমন থাকে, তেমনি দুর্জনদেরও থাকে।

আসলে মহৎ-স্বপ্ন হতে হবে গণমানুষের কল্যাণে নিবেদিত, অঙ্গীকারে আবদ্ধ। স্বপ্ন হতে হবে গণমানুষের গণতন্ত্রের, মৌলিক অধিকারসহ সার্বিক মানবাধিকার বাস্তবায়নের। রাষ্ট্র-নেতা যখন স্বপ্নবাজ হবেন, তিনি হবেন গণমানুষের প্রকৃত-বন্ধু, তিনি হবেন তাদের প্রকৃত প্রতিনিধি। জনমানুষের ভোটে তাকে অবশ্যই নির্বাচিত হতে হবে রাষ্ট্রীয় সংবিধান মোতাবেক। গণতন্ত্রকে, মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার সমুন্নত রাখার দৃঢ় অঙ্গীকার তার মাঝে থাকতে হবে সদা-সক্রিয়। না হলে কোনো স্বপ্নই কাজের হবে না; তিনি যত বড় স্বপ্নবাজই হোন না কেন।

 

লেখক : বিএনপির যুগ্মমহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসু সাধারণ সম্পাদক।

সর্বশেষ খবর