বুধবার, ১০ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

আলোকিত এক রাজনীতিক

আলহাজ বোরহান উদ্দিন চৌধুরী মুরাদ

আলোকিত এক রাজনীতিক

এ বছর স্বাধীনতা পুরস্কারে (মরণোত্তর) ভূষিত হয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। তিনি ছিলেন চট্টগ্রামের বনেদি ও ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। একজন দেশবরেণ্য শিল্পপতি, দেশের ব্যবসায়ী সংগঠনের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করার পরও নিজেকে একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, শিল্পপতি হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন না, দেশ ও মানুষকে ভালোবাসতেন বিধায় তিনি একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচয় দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। তাঁর কর্মময় জীবনের ব্যাপ্তি ছিল বিশাল।

আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু চট্টগ্রামের খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। নানা ঝড়ঝাপটার মাঝেও দলীয় আদর্শে তিনি ছিলেন অবিচল, দলীয় নেতা-কর্মীদের কাছে হয়ে উঠেছিলেন বড় অবলম্বন। কেবল রাজনীতিই নয়, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্পায়নের মাধ্যমেও দেশের মাটি ও মানুষের জন্য কাজ করেছেন তিনি। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দেশের বেকারত্ব হ্রাসে সহায়তা করেছেন। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু বহু বছর ধরে সক্রিয় ছিলেন চট্টগ্রামের রাজনীতিতে। দীর্ঘ সময় ধরে ছিলেন দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন চারবার। নবম জাতীয় সংসদে তিনি ছিলেন পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। ১৯৪৫ সালে আনোয়ারা উপজেলার হাইলধর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। তাঁর বাবা নুরুজ্জামান চৌধুরী ছিলেন আইনজীবী ও জমিদার। তাঁর মা খোরশেদা বেগম। বাবু বাংলাদেশের স্বনামধন্য শিল্পপতি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার মরহুম আলহাজ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর দ্বিতীয় মেয়ে নুর নাহার জামানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। 

আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ১৯৫৮ সালে পটিয়া হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ওই বছরই ঢাকা নটর ডেম কলেজে ভর্তি হন। ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে পড়ার সময় বৃত্তি পেয়ে আমেরিকার ইলিনয় ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে ভর্তি হন। পরে নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে পড়াশোনা করেন। পড়াশোনা শেষে ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে দেশে ফেরেন। তিনি ১৯৬৫ সালে ব্যবসা শুরু করেন। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ১৯৫৮ সালে দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সদস্য নির্বাচিত হন। ’৬৭ সালে মূল সংগঠন আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে তিনি আনোয়ারা ও পশ্চিম পটিয়া থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন আলহাজ আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় তাঁর পাথরঘাটাস্থ জুপিটার হাউস থেকে সংগ্রাম কমিটির কর্মকান্ড পরিচালিত হতো। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রামে আসার পর জুপিটার হাউস থেকে সাইকোস্টাইল করে প্রচার করা হয়। তাঁর বাসা থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রসহ সব জায়গায় পাঠানো হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ভারতে যান এবং সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মুজিবনগর সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির সদস্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি তিনি বিশ্বজনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেন। তিনি প্রথমে লন্ডনে যান। সেখান থেকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে আমেরিকায় যান। ’৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এমপিএ) হিসেবে আখতারুজ্জামান চৌধুরী ’৭২ সালে গঠিত বাংলাদেশ গণপরিষদের সদস্য হন এবং বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে ভূমিকা রাখেন। তিনি ’৭২ সালের সংবিধানের অন্যতম স্বাক্ষরকারী।

স্বাধীনতার পর ১৯৮৬, ১৯৯১ ও ২০০৮ সালে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনতার পর আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি দলের কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। ’৭৫ সালে সপরিবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন এবং পরে দলের পুনরুজ্জীবন ও পুনর্গঠনে সাহসী ভূমিকা পালন করেন। আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি কারানির্যাতন ভোগ করেন। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু একজন সফল ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তা। স্বাধীনতার আগে তিনি বাটালি রোডে বয়েল ইন্ডাস্ট্রি নামে একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। পরে আসিফ স্টিল মিল, জাভেদ স্টিল মিল, আসিফ সিনথেটিক, প্যানআম বনস্পতি, আফরোজা অয়েল মিল, বেঙ্গল সিনথেটিক প্রোডাক্ট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ভ্যানগার্ড স্টিল মিল, সিনথেটিক রেজিন প্রোডাক্ট কিনে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রথম দুই দশকে জামান শিল্পগোষ্ঠীর গোড়াপত্তন করেন। তিনি বিদেশি মালিকানাধীন আরমিট মিল কিনে দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করান। বাংলাদেশে বেসরকারি ব্যাংকিং সেক্টর প্রতিষ্ঠায় তিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। তিনি দেশের দ্বিতীয় প্রাইভেট ব্যাংক ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড -ইউসিবিএলের উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। ২০১১ সালে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পুনর্নির্বাচিত হন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু দেশের ব্যবসায়ীসমাজের মুখপাত্র ও ব্যবসায়ী নেতা হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি দুই দফায় চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯৮৮ সালে দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ওআইসিভুক্ত দেশসমূহের চেম্বারের প্রেসিডেন্ট হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ’৮৯ সালে তিনি ৭৭ জাতি গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনিই একমাত্র বাংলাদেশি যিনি এই মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ব্যক্তিজীবনে তিন ছেলে ও তিন মেয়ের বাবা।

লেখক : সাবেক একান্ত সচিব : মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু এমপি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর