শুক্রবার, ১২ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

বৈষম্যের নিগড়মুক্ত হোক নারী

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান

বৈষম্যের নিগড়মুক্ত হোক নারী

নারী ও পুরুষ নিয়েই মানবকুল। তাহলে কেন নারীকে তার ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হবে? কেন তাকে হতে হবে বৈষম্য ও নিগ্রহের শিকার? এসব প্রশ্নের সমাধান খুঁজতে হবে। সমাজ, পরিবার ও কর্মক্ষেত্রে নারী নিগ্রহ ও অমর্যাদা প্রতিরোধ করতে হবে। ধর্ম বর্ণ লিঙ্গ নির্বিশেষে সবার ন্যায়ানুগ অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

বিচারক হিসেবে আমার মনে হয়েছে নারীর অধিকার নিশ্চিতের সঙ্গে তার বিচার পাওয়ার অধিকারটিও অনিবার্য। কিন্তু সব ক্ষেত্রে বিচার কি পাচ্ছে নারীরা? বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য ও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পুরুষের মনোজগতে আনতে হবে পরিবর্তন। কতরকম নিগ্রহের শিকার নারীরা এ সমাজে! অথচ তারা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন কেউ নন। তাই কেবল নারী কেন- লিঙ্গ, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী নির্বিশেষে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সমাজের সবারই অনেক ভূমিকা রয়েছে। একজন বিচারকও রাখতে পারেন এ ভূমিকা। আইনের প্রতি লক্ষ্য রেখেই এ দায়িত্ব পালন সম্ভব। সঙ্গে বিদ্যমান সামাজিক অবস্থাটিও মনোজগতে রাখতে হবে। নারীর মানবাধিকারের প্রতি অভিগম্যতা প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগ ভূমিকা রাখতে পারে। সবরকম নিগ্রহ ও বৈষম্য থেকে নারীকে সুরক্ষিত রাখতেই হবে।

প্রাগৈতিহাসিক যুগের দিকে তাকালে দেখা যাবে নারী ও পুরুষের কখনই সমান অধিকার ছিল না। সনাতন হিন্দুধর্ম মতে নারীরা পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকার হতে যেরকমভাবে বঞ্চিত ছিলেন, স্বামীর ত্যাজ্য বিত্তেও তাদের অধিকার ছিল না। এমনকি স্বামীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীকে নিক্ষেপ করা হতো স্বামীর জ্বলন্ত চিতায়। আজ সে বৈষম্য ও নিগ্রহপূর্ণ অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। প্রগতিশীল চিন্তাবিদ বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ মানবিক মনীষীর উদ্যোগে হিন্দুসমাজে প্রচলিত অনেক কুপ্রথাই আজ বিলুপ্ত। হিন্দু নারীরা ধীরে ধীরে তাদের অধিকার পেতে থাকেন। কিন্তু আমাদের দেশে এখনো হিন্দু নারী পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকার পান না। তারা স্বামীর অবর্তমানে তার রেখে যাওয়া সম্পদের ওপর শুধু জীবনীস্বত্ব ভোগ করেন। অর্থাৎ বিধবা হিন্দু নারী যত দিন বেঁচে থাকবেন তত দিন মৃত স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পদ ভোগ করতে পারবেন মাত্র। তা বিক্রয় বা দান করার কোনো অধিকার তার নেই। এমনকি হিন্দু নারী যৌক্তিক কারণে স্বামীকে পরিত্যাগ করার অধিকারও রাখেন না।

ইসলাম ধর্মে অবশ্য নারীদের অধিকার হিন্দুধর্মাবলম্বী নারীদের চেয়ে অনেক বেশি। তারা পিতা ও স্বামী উভয় দিক থেকেই সম্পত্তির উত্তরাধিকার। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর বিদায় হজের ভাষণে উল্লেখ করেছেন, ‘হে মানুষ! মহিলাদের ওপর তোমাদের অধিকার রয়েছে। তোমাদের ওপরও মহিলাদের অধিকার রয়েছে।’ এখানে রসুল (সা.) নারী ও পুরুষের সম-অধিকারের কথাই বলেছেন। বিশ্বের অগ্রযাত্রায় আজ যে পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে তার আলোকেই এ অধিকারের বিষয়গুলোকে বিশ্লেষণ করতে হবে। তিনি আরও বলেছিলেন, ‘মহিলাদের সঙ্গে সদয় ব্যবহার করবে, তারা তোমাদের সাহায্যকারিণী। তারা নিজেদের জন্য কিছুই রাখে না, তোমরা আল্লাহতায়ালার এ আমানতের দায়িত্ব গ্রহণ করেছ।’ প্রিয় নবী নারীকে তার স্বামীর কাছে আল্লাহর গচ্ছিত এক আমানতের সঙ্গে তুলনা করেছেন। আজ থেকে পনের শ বছর আগে আমাদের প্রিয় নবী এ রকম একটি বার্তা দিয়ে গেছেন। এ মানবিক বার্তাটি অনুসরণ করলে আমার বিশ্বাস সব ধর্মের নারী-পুরুষের অধিকারের ভেদাভেদ ও বৈষম্য অনেকাংশেই দূরীভূত হয়ে যেত। বিদায় হজের ভাষণে নবী কখনো এ কথাগুলো শুধু মুসলিমদের জন্য বলেননি। তিনি তাঁর পুরো ভাষণেই সম্বোধন করেছেন ‘হে মানুষ’ বলে। অর্থাৎ বিশ্বের সব ধর্ম, বর্ণের ও লিঙ্গের মানুষের জন্যই ছিল তাঁর এ ঐশী বাণী।

আধুনিক বিশ্বের অনেক দেশেই নিকট অতীতেও নারীদের ভোটাধিকার পর্যন্ত ছিল না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে নারীরা তাদের ভোটাধিকার পেয়েছেন তাদের সংবিধানের ১৯তম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে ১৯১৯ সালে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আজ পর্যন্ত কোনো নারী প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। এবারই প্রথম একজন নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। সেদিক থেকে আমাদের উপমহাদেশ ও এর পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলো বেশ এগিয়ে। ১৯১৮ সালে সীমিত আকারে নারীরা ভারতবর্ষে ভোটাধিকার প্রাপ্ত হলেও পরবর্তীতে ১৯১৯ থেকে ১৯২৯ সালের মধ্যে ভারতের নারীরা ভোটাধিকার প্রাপ্তি ও নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অধিকারও প্রাপ্ত হন। আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার মানুষ ১৯৬০ সালে শ্রীমাভো বান্দরনায়েককে তাদের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করে। এই States Woman বিভিন্ন সময়ে মোট ১৮ বছরের অধিককাল শ্রীলঙ্কার রাজনীতির মুখ্য ব্যক্তি ছিলেন। ছিলেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী।

আমাদের পাশের রাষ্ট্র ভারতের অন্যতম নেতা শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান অপরিসীম। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যেসব মহীয়সী নারীর ভূমিকা ছিল অসামান্য তার মধ্যে মাতঙ্গিনী হাজরা, সরোজিনি নাইডু, কনকলতা বড়ুয়া, অরুণা আসফ আলী, তারা রানী শ্রীবাস্তব, লক্ষ্মী সাহগাল, কমলনাদেবী চট্টোপাধ্যায়, সূচেতা ক্রীপালনী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। ব্রিটিশবিরোধী ভারত ছাড় আন্দোলনে মাতঙ্গিনী হাজরা নিজেদের তৈরি করা ভারতীয় পতাকা হাতে নিয়ে একটি মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। সে অবস্থায় তিনি তিনবার গুলিবিদ্ধ হন। প্রচন্ড রক্তক্ষরণের মধ্যেও তিনি উচ্চারণ করে গেছেন ‘বন্দে মাতরম’। মাতঙ্গিনী হাজরা একজন নারী ছিলেন বলেই কি তাঁর এ অদম্য সাহস ও আত্মত্যাগ খাটো করে দেখার সুযোগ আছে? না, নেই। মহাত্মা গান্ধী, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস, পি াকেয়ার অসামান্য অবদান আজ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়।

১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর পাকিস্তান নামক একটি অদ্ভুত রাষ্ট্রের জন্ম হয়। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত নিগৃহীত হতে থাকে। হতে থাকে বৈষম্যের শিকার। আমাদের ভাষার জন্য আন্দোলন করতে হয়েছে। শাহাদাতবরণ করেছেন রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার প্রমুখ। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালির মুক্তির যে বীজ বপিত হয়েছিল কালক্রমে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে তা স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ লাভ করে। দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা অর্জন করি একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, মাতৃভূমি বাংলাদেশ। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের পাশাপাশি ২ লাখ মা-বোন হারিয়েছেন তাদের সর্বোচ্চ সম্মান ও সম্ভ্রম। লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে কত নারী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান সম্ভবত এখন পর্যন্ত করা যায়নি। বিভিন্ন সময় পত্রপত্রিকায় উঠে আসা ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম, তারামন বিবি, গীতা কর, মমতাজ বেগম, সুহাসিনী দেবী প্রমুখের নাম হয়তো আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু আমাদের দৃষ্টির অগোচরে রয়ে গেছেন অনেকেই।

শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে সোহাগপুর পল্লীর নির্যাতিত প্রায় সব নারীই হারিয়েছিলেন তাদের প্রত্যেকের স্বামীকে। এখানেই শেষ নয়, হারাতে হয়েছে তাদের সম্ভ্রম। এ রকম বিধবা নারীর সংখ্যা অগণিত। সোহাগপুরে প্রায় ১৬৪ জন পুরুষকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তান বর্বর সেনাবহিনী। আমরা হয়তো অনেকেই জানি না আমাদের মুক্তিযুদ্ধে কত নারী কীভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন। আমাদের নেত্রকোনার মদন উপজেলায় ১৯৭১-এর ২৮ ও ২৯ আগস্ট এক ভায়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সে যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পাকিস্তানের এক মেজরসহ ১৫৫ জন পাক সেনা ও ৫০-৬০ জন রাজাকার নিহত হয়। যুদ্ধের ময়দানে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক বীরত্বপূর্ণ গাথা এখনো হয়তো বা অনুচ্চারিত রয়ে গেছে। কিন্তু তার চেয়ে বেশি আশ্চর্যের বিষয়, গ্রামের অশিক্ষিত নারীরা কীভাবে যুদ্ধের ময়দানে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছেন তা একেবারেই জনশ্রুতির অন্তরালে রয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধকালে নারীদের এ আত্মত্যাগ এর সত্য সবার জানা প্রয়োজন। মদনের এ যুদ্ধে ‘মিরাশী’ বা ‘মিরাশের মা’ নামক একজন নারী যুদ্ধক্ষেত্রে হামাগুড়ি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার সরবরাহ করেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই ওই গল্পটি শুনে এসেছিলাম। সম্প্রতি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ নামক বইয়ের সপ্তম খন্ডের ৩৩৫ পৃষ্ঠায় এই বীর নারীর গল্পটি বর্ণিত হয়েছে। এটি দেখে মুক্তিযুদ্ধে মিরাশীর মতো সাধারণ নারীদের বীরোচিত অংশগ্রহণ সম্পর্কে আমার ধারণাটি আরও দৃঢ় হয়। তাঁরা সাহসী ও বীর নারী। তাঁদের শ্রদ্ধা।

সরোজিনি নাইডু, মাতঙ্গিনী হাজরা, অরুণা আসক আলী, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার প্রমুখ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ যে পথ দেখিয়ে গেছেন আমাদের ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম থেকে শুরু করে মিরাশের মাসহ অসংখ্য নারী সে পথ ধরেই এগিয়ে গেছেন। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে নাম না জানা অনেক পুরুষ ও নারী মুক্তিযোদ্ধার অংশগ্রহণের খবর আমরা জানি। বেশ কিছু লোক রাজাকার ও আলবদরও হয়েছিল। কিন্তু আমরা কি জানি যে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধিতা করে অস্ত্র হাতে নিয়েছে এমন কোনো নারীর অস্তিত্ব আছে কিনা? সম্ভবত নেই। সে জন্যই জানি না। নারীরা মায়ের জাতি। দেশমাতার স্বাধীনতার বিরোধিতা তারা কখনো করেননি, করতে পারেন না। খোঁজ করলে পাওয়া যাবে তাদের কেউই কখনো রাজাকার বা আলবদর ছিলেন না।

নারীর এমন অসামান্য অবদান ও আত্মত্যাগের পরও কেন তারা বৈষম্য, অমর্যাদা ও নিগ্রহের শিকার হবেন? কেন নারী ও পুরুষের মধ্যে ভেদাভেদ করি? জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের পথ সুগম করার লক্ষ্যে ষাটের দশকের শেষের দিকে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁর নির্দেশে ১৯৬৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। স্বাধীনতার পর জাতীয় সংসদে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট কোটাব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। প্রথম দিকে এর সংখ্যা ছিল ১৫। ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি হতে হতে বর্তমানে তা ৫০-এ দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া সাধারণ আসনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নারীদের জন্য উন্মুক্ত। তাই তো এ পর্যন্ত দুজন নারী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। বর্তমানে জাতীয় সংসদের নেতা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মধ্যে তাঁর স্থান বেশ উঁচুতে। বিরোধীদলীয় নেতাও একজন নারী, মহান জাতীয় সংসদের স্পিকারও একজন মহীয়সী নারী। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানও একজন নারী। তাঁদের প্রত্যেকেই স্ব স্ব অবস্থানে অত্যন্ত দক্ষতা, সৃজনশীলতা ও সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। নিকট অতীতে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের দুজন বিচারপতিও ছিলেন নারী।

নারীদের প্রতি পরম শ্রদ্ধা জানিয়ে বিদ্রোহী কবির ভাষায় বলছি- বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।

নারী-পুরুষে বিভেদ আসলে সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার মাত্র। যে পুরুষ এটি বোঝেন না যে তার মা ও মেয়েও নারী সে পুরুষ সহজেই তার মানবিকতা ও মনুষ্যত্ব হারাতে পারে। তার মধ্যে এমনকি পাশবিক শক্তির বাসা বাঁধতে সময় লাগে না। সমাজে অনেক পুরুষ আজকাল এগিয়ে আসছেন নারীর ওপর অনাচার, বৈষম্য ও নিগ্রহ রোধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে। কিন্তু আমাদের সমাজে এখনো অনেকে আছেন যারা একজন সম্ভ্রম হারানো নারীকে বা মেয়েকে তাদের মতোই একজন নিরপরাধ মানুষ ভাবতে পিছিয়ে যায় বা দ্বিধায় পড়ে। কেবল খোঁজার চেষ্টা করে মেয়েটির কোনো দোষ ছিল কিনা। প্রশ্ন করে মেয়েটির পোশাক-পরিচ্ছদ কেমন ছিল? সে ওই জায়গায় গেল কেন? ইত্যাদি।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের ২ লক্ষাধিক মা-বোনকে সম্ভ্রম হারাতে হয়েছে এটা ইতিহাসস্বীকৃত। এর মধ্যে কতজনকে আমরা আমাদের পরিবারে ঠাঁই দিয়েছি এর হিসাব বোধ হয় আমরা রাখিনি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুবাদে এও জেনেছি যে হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্ভ্রমহারা অনেক মা-বোন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তাদের ওপর ঘটে যাওয়া বর্বর অন্যায়কে আড়াল করেছেন সামাজিক নিগ্রহ ও লোকলজ্জার ভয়ে। কারণ আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা এখনো সহজে এ ধরনের ঘটনা মেনে নিতে চায় না। এটি যেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ব্যাধিগ্রস্ত এক মনোজগৎ। কিন্তু এর ব্যতিক্রমও আছে। আজ এ রকম একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা বর্ণনার মধ্য দিয়েই আমার এ লেখার ইতি টানব।

১৯৭১-এর ২৬ মার্চ। ২৫ মার্চের ভয়াল রাত শেষে ভোরে পুবাকাশে প্রতিদিনের মতো সূর্য আলো বিকিরণ করছিল। দিনব্যাপী মেশিনগান উঁচিয়ে পাক সেনারা ঢাকার রাস্তা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ। দ্বিপ্রহরের পর বিকাল, বিকাল পেরিয়ে প্রায় গোধূলিবেলার সময় মিরপুরের এক বাড়িতে ঘটে যায় নারকীয় কান্ড। হজরত আলী লস্কর নামে এক স্বাধীনতাকামী মানুষ দৌড়ে তার বাড়িতে পৌঁছে বলতে থাকেন ‘কাদের মোল্লা মেরে ফেলবে’। হ্যাঁ, এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ সাজাপ্রাপ্ত ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কর্তৃক মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত কাদের মোল্লার কথাই বলছি। তবে এটি তার বিচারসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কোনো লেখা নয়। হজরত আলী লস্করের মেয়ে মোমেনা বেগম নিগৃহীত হওয়ার পর তার সঙ্গে তার স্বামী ও শ্বশুর কেমন আচরণ করেছিলেন তা বিচারকালে তার বর্ণনায় উঠে এসেছে। তার প্রদত্ত সাক্ষ্যের কিয়দংশে উঠে এসেছে যে, মোমেনা নিজেও সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন তার বাবাকে যেদিন ধরে নিয়ে যায় সেদিন। তারপর তার শ্বশুরবাড়ি ও তার স্বামী তার প্রতি কেমন আচরণ করে তার চিত্র ফুটে উঠেছে তার প্রদত্ত সাক্ষ্য থেকে- ‘আমার নাম মোমেনা বেগম। স্বামীর নাম হাবিবুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল ১২-১৩ বছর। আমরা চার বোন, এক ভাই । ভাই-বোনদের মধ্যে আমি সবার বড়। আমার বাবার নাম হজরত আলী লস্কর। আমার বাবা দরজির কাজ করতেন। তিনি আওয়ামী লীগ করতেন এবং বঙ্গবন্ধুর ভক্ত ছিলেন। আমার বাবা মিছিলে যেতেন, নৌকা মার্কার পোস্টার লাগাতেন। মিছিলে গিয়ে জয় বাংলা, জয় বাংলা স্লোগান দিতেন।’

‘...২৬ মার্চ, ১৯৭১ সন্ধ্যায় বেলা ডুবার আগেই ঘটনাটা ঘটে। সেই সময় আমার আব্বা দৌড়াইয়া দৌড়াইয়া আসে এবং বলতে থাকে কাদের মোল্লা মেরে ফেলবে। আক্তার গুন্ডা বিহারিরা তারা ও পাক বাহিনীরা দৌড়াইয়া আসছিল আমার বাবাকে মেরে ফেলার জন্য। কাদের মোল্লা ও বিহারিরা দরজার সামনে এসে বলে “এই হারামিকা বাচ্চা দরজা খোল, বোম মার দেঙ্গা।” দরজা না খোলায় তারা একটি বোম মারে। আমার আম্মা হাতে একটা দা নিয়ে দরজাটা খোলে, দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে আমার আম্মাকে তারা গুলি করে। আমার আব্বা আমার আম্মাকে ধরতে গেলে অভিযুক্ত কাদের মোল্লা পিছন থেকে শার্টের কলার টেনে ধরে বলে “এই শূয়ারের বাচ্চা, এখন আর আওয়ামী লীগ করবি না? বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যাবি না? মিছিল করবি না, জয় বাংলা বলবি না?” তখন আমার বাবা হাত জোড় করে কাদের মোল্লাকে বলল “কাদের ভাই আমাকে ছেড়ে দাও।” আক্তার গুন্ডাকে বলল “আক্তার ভাই আমাকে ছেড়ে দাও।” তখন তারা আমার বাবাকে টেনেহিঁচড়ে ঘরের বাইরে নিয়ে যায়। দাও দিয়ে আমার মাকে তখন তারা জবাই করে (সাক্ষী তখন অঝোরে কাঁদছিল)। তখন চাপাতি দিয়ে খোদেজাকে জবাই করে, তাসলিমাকেও জবাই করে। আমার একটি ভাই ছিল বাবু, বয়স ছিল দুই বছর তাকে আছড়িয়ে মারে। বাবু মা মা করে চিৎকার করছিল। ওই চিৎকার শুনে আমেনা চিৎকার দেয়। চিৎকার দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমেনাকে তারা টেনে বের করে। টেনে বের করে তারা আমেনার সব কাপড়-চোপড় ছিঁড়ে ফেলে। তারা তখন আমার বোনকে নির্যাতন করতে থাকে। তখন আমেনা অনেক চিৎকার করে, একপর্যায়ে চিৎকার বন্ধ হয়ে যায়। (এ পর্যায়ে সাক্ষী কিছু সময়ের জন্য কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে)। তারপর প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসে, তখন তারা কী দিয়ে যেন খুঁচাচ্ছিল দেখছে ঘরে আর কেউ আছে কিনা। এই পর্যায়ে একটি খোঁচা আমার বাম পায়ে গেঁথে যায়। আমি খুব আঘাতপ্রাপ্ত হই। খোঁচা লাগার পরে আমাকে যখন টেনে বের করে আমি আর কিছু বলতে পারি না আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। আমার যখন জ্ঞান ফিরে তখন অনেক রাত। আমার পেটে তখন প্রচ- ব্যথা এবং ভেজা আমি হাঁটতে পারি না। আমার পেটে অনেক ব্যথা। আমি প্যান্ট পরা ছিলাম, প্যান্টটা ফাড়া। তখন আমি আস্তে আস্তে অনেক কষ্টে ফকিরবাড়ি যাই। ফকিরবাড়ি যাওয়ার পরে ওই বাড়িতে আমি বলি, মা দরজাটা খোল, বাবা দরজাটা খোল, তখন তারা দরজাটা খোলে। তখন তারা আমার শরীরের কাপড়-চোপড় রক্তে ভেজা দেখে ও আমার প্যান্টটা ফাড়া দেখে। তারা একটি কাপড় দিয়ে আমার পায়ের ক্ষতস্থান বেঁধে দেয় এবং তাদের বড় সালোয়ার আমাকে পরতে দেয়। এবং পরের দিন ডাক্তার এনে আমাকে চিকিৎসা করায় এবং ঔষধ-পত্র দেয়। খুব ছোটবেলায় আমার বিয়ে হয়েছিল কিন্তু তখনো স্বামীর ঘরে যাইনি। ফকিরবাড়ির লোকজন আমাকে জিজ্ঞেস করে আমার বাড়ি কোথায়, আমার স্বামী কোথায়। তখন তারাই আমার শ্বশুরবাড়িতে খবর দেয়, তখন আমার শ্বশুর এসে আমাকে নিয়ে যায়। নিয়ে গিয়ে তারা আমাকে চিকিৎসা করায় আমার শাশুড়ি আমাকে রাতে বুকের মধ্যে রাখতেন। আমি পাগলের মতো এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ি করতাম, আমার শ্বশুর-শাশুড়ি আমাকে ধরে ধরে নিয়ে এসে বুকে জড়ায়ে রাখত।’

‘...যত দিন দেশ স্বাধীন হয়নি তত দিন আমি আমার শ্বশুরবাড়িতেই ছিলাম। আমার শ্বশুর ও স্বামী মিরপুর থেকে আমাকে কোলে করে তাদের জিঞ্জিরার বাসায় নিয়ে যায়। আমার স্বামী এখনো জীবিত উনি হার্টের রোগী, তার হার্টে রিং পরানো হয়েছে।

...জখমি অবস্থায় চার দিন ফকিরবাড়িতে থাকার পরে আমার শ্বশুর এসে আমাকে নিয়ে যায়। জিঞ্জিরায় নিয়ে গিয়ে আমার শ্বশুর আমাকে চিকিৎসা করান।’

মোমেনা তার জেরার এক জায়গায় পুনরুক্তি করে বলেছেন- ‘...যত দিন দেশ স্বাধীন হয়নি তত দিন আমি আমার শ্বশুরবাড়িতেই ছিলাম। আমার শ্বশুর ও স্বামী মিরপুর থেকে আমাকে কোলে করে তাদের জিঞ্জিরার বাসায় নিয়ে যায়।’

যে সত্যটি উঠে এসেছে নির্যাতিতা মোমেনার জবানবন্দি থেকে তা পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন। মোমেনা তার বাবার অপহরণকারী গুন্ডা বাহিনী কর্তৃক নিগৃহীত হয়েছিল। তাদের হাতে হারাতে হয়েছিল তার সম্ভ্রম। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এর বিচারক হিসেবে যখন কাদের মোল্লার বিচার পরিচালনা করছিলাম তখন মোমেনার বক্তব্য শুনে আমরা (আমি ও অন্য দুজন বিচারক) অভিভূত হই তার প্রতি তার শ্বশুরবাড়ির মানুষদের মানবিক আচরণের কথা শুনে। বিচারকরাও রক্ত-মাংসের মানুষ। আবেগ তাদেরও তাড়িত করতে পারে। তবে আবেগ দ্বারা তাড়িত হয়ে কোনো রায় দেওয়া বিচারকের কাজ নয়। আমরাও তা করিনি।

কিন্তু মানুষ হিসেবে আমাদের মনে হচ্ছিল মোমেনা পিতৃ-মাতৃহীন মেয়ে। সে পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর গুন্ডা দল কর্তৃক নিগৃহীত হয়েছে, হারিয়েছে সম্ভ্রম। তার প্রতি তার স্বামীর আচরণ বা তার শ্বশুরবাড়ির আচরণ নিঃসন্দেহে একটি অনন্য মানবিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সব পুরুষ যদি মোমেনার স্বামী ও শ্বশুরের মতো হন তাহলে সমাজে থাকবে না কোনোরকম লিঙ্গ-অসমতা, থাকবে না নারীর প্রতি পুরুষের কোনো বৈষম্যমূলক আচরণ। আর তখনই সম্ভব হবে সমাজের সর্বস্তরে নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এটি উপলব্ধি করেছেন বহুযুগ আগে। তাই তিনি ‘ভারতবর্ষীয় বিবাহ’তে লিখেছেন- ‘অন্তঃপুরের প্রাচীর থেকে বাইরে চলে আসার দ্বারাই নারীর মুক্তি নয়। তার মুক্তি এমন একটা সমাজে যেখানে তার নারীশক্তি, আনন্দশক্তি আপন উচ্চতম প্রশস্ততম অধিকার সর্বত্র লাভ করতে পারে। পুরুষ যেমন আপন ব্যক্তিগত ব্যবসায় অতিক্রম করেও বিশ্বক্ষেত্রে নিজেকে ব্যক্ত করার অবকাশ পেয়েছে, তেমনি যখন গৃহস্থালির বাইরেও সমাজসৃষ্টি-কার্যে নারী আপন বিশেষ শক্তির ব্যবহারে বাধা না পাবে তখন মানবসংসারে স্ত্রীপুরুষের যথার্থ যোগ হতে পারে।’

সহনশীল পুরুষের দৃষ্টান্ত শুধু পুরুষই হতে পারে। মোমেনার স্বামী হাবিবুর রহমানই তার অনন্য উদাহরণ। আমরা সব পুরুষ যদি হাবিবুর রহমানের মতো সহনশীল ও নারীর মর্যাদা রক্ষায় সোচ্চার থাকি তাহলে সমাজ পরিবর্তনে সময় লাগবে না, দেশ আরও এগিয়ে যাবে। আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর অবদান ও অর্জনকে দিতে হবে স্বীকৃতি। সব মানবাধিকারে তাদের অভিগম্যতাকে নিশ্চিত করতে হবে। নারীর কীর্তি ও কর্মকে উৎসাহ দিতে হবে। এখানে অল্প কথায় এটি বলার প্রয়াস পেয়েছি যে মহান মুক্তিযুদ্ধকালে আমাদের দেশের নারীরা কত অপরিসীম আত্মত্যাগ করেছেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মনোজগৎ ও গন্ডি থেকে নারীদের করতে হবে মুক্ত ও বৈষম্যমুক্ত।

লেখক : বিচারপতি, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

আপিল বিভাগ, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর