শুক্রবার, ১২ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

রসুলের আধ্যাত্মিক ও শারীরিক শক্তি

আল্লামা মাহ্‌মূদুল হাসান

বিশ্বরসুল একজন কামিল রসুল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। তাঁকে কামিল কিতাব দান করে ইসলামের পরিপূর্ণতা ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত পরিপূর্ণ করলাম ও তোমাদের জন্য ইসলামকে পছন্দ করলাম।’ কামিল নবুয়ত, কামিল কিতাব ও কামিল দীনের ভার-বোঝা বহন করার জন্য প্রয়োজন ছিল অধিক পরিমাণ আধ্যাত্মিক এবং শারীরিক শক্তির। আধ্যাত্মিক শক্তির ভারসাম্য রক্ষার জন্যও প্রয়োজন ছিল শারীরিক বিশেষ শক্তির। বস্তুশক্তির মাধ্যম পানি। আল্লাহ পানিকে বস্তুগত বিষয়ে শক্তি সঞ্চালনের মাধ্যম বানিয়েছেন। তিনি ইরশাদ করেন, মানুষ তার খাদ্যদ্রব্যাদির প্রতি লক্ষ্য করুক, আমিই পানি বর্ষণ করি।’ অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘এবং আমি পানি থেকে সব প্রাণীকে সৃষ্টি করেছি।’

বস্তুত আজকের মহাশক্তি বিদ্যুতের সূত্রপাত পানি থেকেই হয়েছে; গাছপালা, বৃক্ষলতা, উৎপন্ন ফসলের ভিটামিনের শক্তির উৎসও পানি। যদি মাদরাসার একটি ভবন নির্মাণের জন্য আমার এক ভাই প্রয়োজনীয় রড সরবরাহ করেন আর অন্য একজন সিমেন্ট, বালু, ইট ও কংক্রিট দান করেন, এরপর এগুলোকে একত্রিত ও মিশ্রিত করে ঢালাই করে দেওয়া হয় তাতে ঢালাই মোটেই সঠিক হবে না, শক্তিশালী হবে না। হ্যাঁ যদি এর মধ্যে প্রয়োজনমতো পানি দেওয়া হয়, তাহলে ঢালাই মজবুত ও শক্তিশালী হবে। মোট কথা যে কোনো বস্তুতে শক্তি সঞ্চারের মাধ্যম হচ্ছে পানি, আর সমস্ত পানির মধ্যে অন্যতম ও প্রধান পানি হচ্ছে জমজমের পানি। জমজমের পানি কেবল তৃষ্ণাই নিবারণ করে না; বরং তা পুষ্টিকরও বটে। তাই রসুলের বুকে পানি সংযোজনের পেছনে দৈহিক শক্তি সঞ্চারের রহস্য নিহিত থাকতে পারে। এ বিবরণের সমর্থনে নিচের উপাত্ত পেশ করা যেতে পারে। ক. অন্যান্য পানির তুলনায় জমজমের পানি অধিক পুষ্টি ও বিশেষত্বের অধিকারী। এটা যেমন বাস্তব তেমন হাদিসেও এর পুষ্টির কথা উল্লেখ রয়েছে। খ. কুদরতি তরিকায় রুহানি ও আধ্যাত্মিক শক্তি বৃদ্ধির কথা আলোচ্য হাদিসেই বর্ণিত রয়েছে। এ অবস্থায় আধ্যাত্মিক শক্তির সঙ্গে সমতা রক্ষার তাগিদেই দৈহিক শক্তি বৃদ্ধির প্রয়োজন রয়েছে। উভয়ের মধ্যে সমতা সৃষ্টি না হলে ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দেয়। হজরত বাকিবিল্লাহ (রহ.) তাসাররুফের মাধ্যমে স্বীয় মুরিদের অন্তর্জগতে আধ্যাত্মিক শক্তি সঞ্চার করেছিলেন, কিন্তু মুরিদের দৈহিক শক্তির সমতার অভাবে তা ক্ষতির কারণ হয়। এখান থেকেও উভয় শক্তির সমতার বিষয়টি প্রমাণিত হয়। সুতরাং বিশ্বরসুলের আধ্যাত্মিক ও দৈহিক ক্ষমতার সমন্বয় সাধনের জন্য জমজমের পানিকে বুকে সংযোজনের রহস্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বটে। গ. বাস্তবেও রসুলুল্লাহর দৈহিক শক্তি ছিল অতুলনীয়। তিরমিজির হাদিস দ্বারা বোঝা যায় রসুলের দৈহিক শক্তির পরিমাণ ছিল শক্তিশালী ৪ হাজার পুরুষের সমান। আর তা নবুয়ত প্রাপ্তির পরবর্তী সময়েই প্রকাশ পায়। কোনো মানুষের পক্ষে এরূপ শক্তির অধিকারী হওয়া যুক্তিবহির্ভূত। এ পরিমাণ শক্তি একজন কামিল রসুলের মধ্যে কেবল কুদরতি তরিকায়ই যুক্ত হতে পারে অন্য কোনোভাবে নয়। রসুলের আধ্যাত্মিক শক্তি রসুলের বুকে দৈহিক শক্তি সঞ্চারের পর রুহানি ও আধ্যাত্মিক শক্তিও সঞ্চার করা হয়। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘ইমান ও হিকমত ভর্তি সোনার পেয়ালা নিয়ে হজরত জিবরিল আলাইহিস সালাম আগমন করেন।’ রসুলের রুহানি ও আধ্যাত্মিক শক্তির পরিমাণ কী ছিল এ সম্পর্কীয় কোনো উদ্ধৃতি সম্পর্কে আমি আজ পর্যন্ত অবহিত হতে পারিনি। তবে খোলাফায়ে রাশেদিন ও সাহাবায়ে কিরাম থেকে শুরু করে তাবেয়িন, তাবে-তাবেয়িন, আইম্মায়ে মুজতাহিদিন, ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেয়ি, ইমাম আহমাদ, ওয়ায়েজ করনি, আবদুল কাদের জিলানি, মুইনুদ্দিন চিশতি, শাহ আহমাদ কাবির রেফায়ি, জুনায়েদ বাগদাদি এবং সিলেটের শাহ জালাল ইয়ামানি (রহ.)-সহ সব আধ্যাত্মিক সম্রাট যেমন রসুলের ইলমে জাহেরির এক বিন্দুতুল্য, তেমনি তাঁদের ইলমে বাতেনি তথা আধ্যাত্মিক ও রুহানি শক্তিও রসুলের রুহানি শক্তির এক বিন্দুতুল্য মাত্র। এখান থেকে বিশ্বরসুলের আধ্যাত্মিক শক্তির কিছুটা অনুমান করা যায়। এভাবে বিশ্বরসুলকে সঠিকভাবে কামিল করার পর ‘ইকরা’র মাধ্যমে কামিল কিতাব নাজিল হওয়া শুরু হয় এবং নবুয়তের সূচনা ঘটে। ইলমের মাধ্যমে নবুয়তের প্রারম্ভ হওয়াই দীনি ইলমের গুরুত্বের অকাট্য প্রমাণ। ২. ইখলাসের গুরুত্ব। ইসলামের পরিভাষায় ইলম দ্বারা মূলত ইলমে দীনকে বোঝানো হয়। ইলমের সঙ্গে দীনের সম্পর্ক যেমন অত্যাবশ্যকীয় তেমন আমলের সম্পর্কও অত্যাবশ্যকীয়। ইলম আমল ছাড়া মোটেই গ্রহণযোগ্য হয় না। আবার ইলমবিহীন আমলের যেমন গুরুত্ব নেই তেমন ইখলাসবিহীন আমলেরও কোনো মূল্য নেই। এ জন্যই আমলের জন্য ইখলাস রুহতুল্য। ইখলাসের সংক্ষিপ্ত পরিচয় হচ্ছে, আমল কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা এবং এতে কোনো স্বার্থ-চরিতার্থের প্রয়াস না থাকা, আমলের মাধ্যমে বিনয় ও দাসত্বের ভাব প্রস্ফুটিত হওয়া, গর্ব-অহংকার প্রকাশ না পাওয়া; আমল কবুল হলো কিনা এ ব্যাপারে শঙ্কিত থাকা। আল্লামা সুসি বলেন, ‘আমলে ইখলাস অনুভূত না হওয়াই মূলত ইখলাস।’ ইমাম গাজ্জইল বলেন, আলেম ছাড়া সব মানুষ ধ্বংসের পথে; আমল ছাড়া সব আলেমও ধ্বংসের পথে; ইখলাসবিহীন আমলদাররাও ধ্বংসের পথে; (আমল কবুল হলো কিনা এ ব্যাপারে আল্লাহর ভয়ে) যারা ভীতসন্ত্রস্ত থাকে, তারাই হচ্ছে মুখলিস।’

লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ।

সর্বশেষ খবর