শনিবার, ১৩ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

জাকিরের ভার্টিক্যাল লাইভস্টক ফার্ম

শাইখ সিরাজ

জাকিরের ভার্টিক্যাল লাইভস্টক ফার্ম

গত বছর ঈদুল আজহার আগে একজন ফোন দিলেন আমাকে। বললেন, ‘আমার নাম জাকির হোসেন। হৃদয়ে মাটি ও মানুষ দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে যাত্রাবাড়ীতে একটা গবাদি পশুর খামার গড়ছি। করোনার দিন ভালো হলে আপনি যদি একবার আমার খামারটি কোনো একদিন দেখে যেতেন আমার খুব ভালো লাগত।’ করোনার সংক্রমণ তখন ক্রমেই বাড়ছে, বাড়ছে মৃত্যু। বললাম, ইনশা আল্লাহ! দিন ভালো হোক। কিন্তু করোনার অভিঘাত বছরব্যাপী চলছে। প্রকোপ কিছুটা কমলেও নিশ্চিহ্ন হয়নি। তবে পৃথিবী থেমে থাকেনি। করোনাকে স্বীকার করেই সবাই সব কাজ করে চলেছে। আমাকেও কাজে নামতে হয়েছে। পাল্টে যাওয়া সময়ের স্রোতের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েই চলতে হচ্ছে। গত সপ্তাহে গিয়ে উপস্থিত হলাম যাত্রাবাড়ীর কাজলায় জাকিরের গবাদি পশুর খামার দেখতে। কাজলা এখনো পুরোপুরি শহর হয়ে ওঠেনি। জমিগুলো প্লট আকারে ভাগ করা। কেউ কেউ এর মধ্যে বাড়ি তুলেছেন। কারও কারও প্লট এখনো খালি পড়ে আছে। এর আগে ফোনে কথা হয়েছে জাকিরের সঙ্গে। আসার আগেও যোগাযোগ হয়েছে। চার তলা এক বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন জাকির। বেশ স্বাস্থ্যবান। বয়স ৪০-এর মতো হবে। দুই হাতে নানারকম চেইন আর ব্যান্ড। আমাকে পেয়ে বেশ উচ্ছ্বসিত। লক্ষ্য করলাম আমার শার্টের মতো শার্টও পরেছেন। বললেন, ‘আসেন স্যার’। বলেই বাড়ির দিকে চললেন। আমি বললাম, চলেন আগে খামারে যাই। বললেন, ‘স্যার, এটাই তো খামার।’ বিস্মিত হলাম। এ ফ্ল্যাট বাড়িতে গরুর খামার! আর পাঁচটি আবাসিক ভবনের সঙ্গে এর কোনো তফাত নেই। জাকিরের সঙ্গে কথা বলতে বলতে প্রবেশ করলাম বাড়িটিতে। জাকির জানালেন এ বাড়িটিই তার গবাদি পশুর খামার। কোনো তলায় দুধের গরু, কোনো তলায় বাছুর ও ষাঁড়। ফলফসলসহ সামগ্রিক কৃষি উৎপাদনে ভার্টিক্যাল এক্সপানশন বা ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণের কথা বলে আসছি। কিন্তু প্রাণিসম্পদের যে এমন ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারিত একটি খামার হতে পারে তা দেখিয়ে দিয়েছেন জাকির হোসেন। নিয়ে গেলেন প্রথম তলায়। প্রথম তলায় দুগ্ধ খামার। মাত্র ২ হাজার ৯৪০ বর্গফুটের কক্ষ। এর মধ্যেই বসবাস ৪০টি গাভীর। দুধ দিচ্ছে ২২টি। প্রতিদিন ৩০০ লিটারের মতো দুধ পান। আয়োজনটিই বিস্ময়কর। তার চেয়ে বিস্ময়কর এমন উদ্যোগের পেছনের গল্পটি।

‘স্যার, আমি তো সিঙ্গাপুর গেছিলাম। ২১ বছর পরের কাজ করছি। কী যে কষ্টের কাজ। রড-সিমেন্ট কাঁধে নিয়া ১০-১২ তলা পর্যন্ত উঠতে হইছে। সেইখানে থাইকা আপনার অনুষ্ঠানগুলো দেইখা ভাবতাম দেশে ফিরে আমিও একটা গরুর খামার দিমু। বিদেশ থেকে ফিরে অনেকেই অনেক কিছু করে। কেউ গার্মেন্ট দিছে, কেউ মুদির দোকান দিছে। আমার স্বপ্ন গরুর খামারের। কিন্তু আমার পরিবারের সেটা পছন্দ না। তাই কাউরে কিছু কই নাই। বাসা নারায়ণগঞ্জে। এই চিপায় এসে জমি কিনে বাড়ি করে গরুর খামার দিলাম যাতে বাসায় কেউ টের না পায়। সামনেই একটা খাবার হোটেল আছে আমার। বাসায় বলে আসতাম হোটেলে যাচ্ছি। কিন্তু আমি চলে আসতাম এইখানে। খামার হওয়ার আগ পর্যন্ত পরিবারকে জানাই নাই। সারা দিন খামারে কাজকাম করে গোসল করে আতর মেখে বাসায় যাইতাম। যাতে স্ত্রী-পুত্র টের না পায়। নাইলে তো স্যার আমার ভাত বন্ধ!’

বেশ মজা করে কথা বলেন জাকির। মন দিয়ে শুনছিলাম তার কথাগুলো।

-তাহলে আপনার পরিবারের কেউ জানত না আপনি গবাদি পশুর খামার দিচ্ছেন?

-না স্যার।

-এ খামারের বয়স কত দিন হলো?

-চার বছর।

-এখানে কতটুকু জমির ওপর এ বাড়ি?

-৪ কাঠা।

-কত দিয়ে কিনেছিলেন?

-৪০ লাখ টাকায়।

-আপনার পরিবার কি এখনো আপনার এ খামারের বিষয়ে জানে না?

-এখন জানে। খামার হয়ে গেলে একদিন ৪০ কেজি দুধ নিয়ে গেলাম বাসায়। দুধ খেয়ে মহাখুশি। খাঁটি দুধ। বউরে জিগাইলাম দুধ কেমন? বউ কয় ভালো দুধ। প্রত্যেক দিন দুধ নিয়ে যাই। ছেলেপেলে খুব মজা করে খায়। একদিন বড় ছেলেরে বললাম, লও বাজান, যে খামার থেকে দুধ আনি সে খামার দেখায়ে আনি তোমারে। ছেলে আইসা দেখে দুধের খামারের নাম ‘সম্রাট গবাদি পশুর খামার’। দেইখ্যা ছেলে কয় বাজান, সম্রাট তো ছোট ভাইয়ের নাম! কইলাম, সম্রাট কি আর কারও নাম হইবার পারে না! ছেলে খামার দেখে গিয়ে তার মারে কইল। পরে একদিন তার মারেও নিয়া আইলাম। খামার দেইখা সেই রকম খুশি!

দারুণ আশাবাদী আর আত্মবিশ্বাসী এক উদ্যোক্তা জাকির। তার বিশ্বাস অন্য যে কোনো ব্যবসার চেয়ে প্রাণিসম্পদের খামার লাভজনক। বাড়িসহ খামার গড়তে তার খরচ হয়েছে ৮ কোটি টাকা। জানতে চাইলাম এত খরচ করে খামার দিয়ে লাভ কেমন হয়? হেসে বললেন, ‘স্যার, একেকটা কোরবানিতেই কত কোটি টাকা আইস্যা পড়ে! গত কোরবানির মৌসুমে এ খামার থেকে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকার গরু বিক্রি হইছে। আর শনিরআখড়ায় ওঠা সবচেয়ে বড় ষাঁড়টিও ছিল আমার খামারের।’

গরু ওঠানো-নামানোর জন্য বাড়িতে বিশেষভাবে সিঁড়ি তৈরি করা হয়েছে। নিজেদের চলাচলের জন্য ভবনের মাঝামাঝি আলাদা সিঁড়ির ব্যবস্থা। বাড়ির প্রতিটি ফ্লোরেই যেন বিস্ময়। তৃতীয় তলায় রাখা হয়েছে বাছুর। বিশেষ করে এ অংশটি গরু মোটাতাজাকরণের জন্য। উদ্যোগটির প্রতিটি অংশে রয়েছে তার অন্যরকমের আত্মবিশ্বাস আর ভালোবাসা।

দারুণ মাতৃভক্ত জাকির। মায়ের সে ভালোবাসাই লালন করে চলেছেন। মা তাকে জুগিয়ে গেছেন দারুণ আত্মবিশ্বাস। গল্পে গল্পে অনেক কথাই বললেন জাকির।

-স্যার, আমার মা বইলা গেছেন জাকির, গাছের পাতা শেষ হইয়া যাইব, তোমার টাকা কোনো দিন শেষ হইব না। আমার মার স্ট্রোক করেছিল। ১০ বছর বিছানায় পড়ে ছিলেন। আমার মায়ের দোয়া আছে স্যার আমার ওপর। ২১ বছর যে খাটনি খাটছি- মাইনষের কাম করছি। এখন আমি চাই আমি যেন আরও মানুষের কাজের সংস্থান করতে পারি। আমার এ খামারে ১৬ জন কাজ করে। আমি আরও মানুষের কাজের সংস্থান দিতে চাই।

প্রশ্ন হলো, চারদিকে দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে মানুষের আবাসন। এর ভিতরে এ খামার কত দিন সম্প্রসারিত করতে পারবেন জাকির। বললেন, ‘সমস্যা নাই। বিক্রমপুরে জমি আছে। সেইখানে নিয়া যামু খামার।’ বুঝলাম বেশ পরিকল্পনা করেই মাঠে নেমেছেন তিনি।

জাকিরের অনুরোধে ওপরতলাটি দেখার জন্য গেলাম। ভাবলাম সেখানেও অন্য কোনো জাত অথবা রকমের গরুর আবাসন। না, চার তলায় জাকিরের অফিস ও নিজের থাকার ব্যবস্থা। পরিবার এখানে থাকে না, এককভাবে তার জন্য সবচেয়ে প্রিয় ক্ষেত্র এটিই। চারদিকে সাজানো প্রিয় মানুষদের ছবি। তারও বিভিন্ন বয়সের ছবি রয়েছে। রয়েছে বাবা-মায়ের ছবিও। জাকির পল্লী চিকিৎসক কালু ডাক্তারের সন্তান। বিক্রমপুর ও নারায়ণগঞ্জে তাদের আদি ঠিকানা। গভীর আবেগ আর ভালোবাসা থেকেই সিঙ্গাপুর থেকে দেশে এসে গড়েছেন এ খামার। পাশাপাশি একটি রেস্টুরেন্ট চালাচ্ছেন। গরুর ভুসি নিশ্চিত করার জন্য ময়দার মিল তৈরি করেছেন। চার তলার অফিস থেকেই পরিচালনা করেন তার ব্যবসায়িক কর্মকা-।

জাকির সত্যি সত্যিই একটি ভবনকে প্রাণিসম্পদের ভার্টিক্যাল খামার হিসেবে গড়ে তুলেছেন। একেবারে নিচতলাও কাজে লাগিয়েছেন ছাগল ও ভেড়ার খামার গড়ে। বললেন, ছাগল-ভেড়া মিলে গোটা চল্লিশেক রয়েছে। পাশেই একটা অংশে বায়োগ্যাস প্লান্ট। দারুণ পরিশ্রমী আর স্পষ্টভাষী জাকিরের কাছে সব কাজই যেন সহজ। খামারের প্রসার ঘটছে, বাড়ছে স্বপ্নের পরিধি। বললেন, ‘এ বছর গরু আর হাটে তুলমু না। অনলাইনেই বিক্রি করমু। সময় এখন ডিজিটাল হয়ে গেছে।’ সবকিছুর মধ্যে রয়েছে তার যথেষ্ট আনন্দ। জাকিরের স্বপ্ন এ খামারের দুধ একদিন পাস্তুরিত ও প্যাকেটজাত হিসেবে বাজারজাত করবেন। এর জন্য চিলিং প্লান্ট ও প্যাকেজিং স্থাপনাও গড়ে তুলবেন নিজের খরচে। একই সঙ্গে সমন্বিত খামারের প্রয়োজনেই গড়ে তুলবেন নিজস্ব ফিড মিল; যাতে তার খামারের গবাদি প্রাণীকে খাওয়াতে পারেন মানসম্পন্ন খাবার। আগামী কোরবানি ঈদেও গরু মোটাতাজাকরণের একটি বড় পরিকল্পনা রয়েছে জাকিরের। এ আয়োজন ও স্বপ্ন নতুন করে জানান দেয়, কৃষির জন্য বিনিয়োগের পাশাপাশি সদিচ্ছাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভার্টিক্যাল প্রাণিসম্পদের খামার হিসেবে জাকিরের এ উদ্যোগ অবশ্যই অনুকরণীয়। জাকিরদের মতো এমন উদ্যমী তরুণের হাত ধরেই দেশ এগিয়ে যাবে অন্যরকম সমৃদ্ধির এক আগামীর পথে।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

সর্বশেষ খবর