শনিবার, ২০ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা
ইতিহাস

সুলায়মান কররানি

সুলায়মান কররানি

বাংলায় কররানি বংশের পরাক্রমশালী শাসক সুলায়মান কররানি। ১৫৬৩ থেকে ১৫৭২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি বাংলা শাসন করেন। ক্ষমতালাভের পর সুলায়মান কররানি বাংলায় শান্তি স্থাপনে নিয়োজিত হন এবং তার রাজধানী গৌড় থেকে মালদহের ১৫ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত তান্ডায় স্থানান্তর করেন। শূর বংশের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার অবলুপ্তির ফলে আফগানদের মধ্যে তার সম্ভাব্য কোনো প্রতিপক্ষ ছিল না। এ সময় মুঘলদের হাতে দিল্লি, অযোধ্যা, গোয়ালিয়র এবং এলাহাবাদের পতন হলে বহুসংখ্যক আফগান বাংলায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। তাদের সাহায্যে সুলায়মান কররানি এক শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করেন। এ ছাড়া তার অধীনে ছিল ১ হাজার যুদ্ধহাতির এক বাহিনী।

কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও সুলায়মান কররানি দূরদর্শিতার প্রমাণ দেন। রাজ্যের শান্তি ও নিরাপত্তাবিধানের জন্য তিনি মুঘলদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। মুঘলদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বিরোধিতা পরিহার করে চলেন। সাম্রাজ্যের পশ্চিম সীমান্তে নিয়োজিত মুঘল কর্মকর্তাদের মূল্যবান উপহার ও বন্ধুত্বপূর্ণ চিঠিপত্র পাঠিয়ে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করতেন। তিনি মুনিম খান মারফত মাঝেমধ্যে আকবরের দরবারেও অতি মূল্যবান উপঢৌকন পাঠাতেন। কখনো প্রকাশ্যে সার্বভৌমত্ব দাবি করেননি। তিনি আকবরের নামে খুতবা পাঠ ও মুদ্রা প্রচলন করেন। আপাতদৃষ্টিতে মুঘলদের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করলেও তিনি নিজে ‘হজরত-ই-আলা’ উপাধি গ্রহণ করেন, যা থেকে বোঝা যায় কার্যত তিনি ছিলেন স্বাধীন। পশ্চিম সীমান্তে শান্তি স্থাপনের পর সুলায়মান কররানি রাজ্য বিস্তারের দিকে মনোনিবেশ করেন। ১৫৬৭-৬৮ খ্রিস্টাব্দে আকবর যখন চিতোর অভিযানে ব্যস্ত, তখন সুলায়মান তার ছেলে বায়েজিদ কররানির নেতৃত্বে ওড়িশায় একটি অভিযান পাঠান। এখানে বায়েজিদের সহকারী ছিলেন বীর সেনাপতি কালাপাহাড় ওরফে রাজু। এ যুদ্ধে বায়েজিদের কাছে ওড়িশার রাজা হরিচন্দন মুকুন্দদেব পরাজিত ও নিহত হন। ইতিমধ্যে স্বয়ং সুলায়মান ওড়িশার দিকে অগ্রসর হন এবং এর রাজধানী তাজপুর অধিকার করেন। কালাপাহাড়ের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একাংশ পুরি পর্যন্ত অগ্রসর হয় এবং গ্রামাঞ্চল দখল করে। সুলায়মান কররানি লোদি খান ও কতলু লোহানিকে যথাক্রমে ওড়িশা ও পুরির গভর্নর নিয়োগ করেন।

সুলায়মান কররানি যখন ওড়িশা অভিযানে ব্যস্ত, সে সময় কোচ রাজা বিশ্ব সিংহ তার ছেলে শুক্লধ্বজ ওরফে চিলা রায়ের নেতৃত্বে একটি সৈন্যবাহিনী বাংলার উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল আক্রমণে পাঠান। কিন্তু অভিজ্ঞ সেনাপতি কালাপাহাড় কোচ বাহিনীর সম্মুখীন হলে সম্পূর্ণ অসহায় অবস্থায় শুক্লধ্বজ বন্দী হন। কালাপাহাড় কোচবিহারের রাজধানী অবরোধ করেন।

ইতিমধ্যে সদ্যবিজিত ওড়িশায় বিদ্রোহ দেখা দেয়। এ ছাড়া সম্ভাব্য মুঘল আক্রমণের আশঙ্কায় বিচক্ষণ কূটনীতিবিদ সুলায়মান উত্তর সীমান্তে শক্তিশালী মিত্রবাহিনীর প্রয়োজীয়তা অনুভব করেন। ফলে তিনি কালাপাহাড়কে ফিরিয়ে এনে কোচ রাজাকে তার রাজ্যে পুনরায় অধিষ্ঠিত করেন এবং ১৫৬৮ খ্রিস্টাব্দে যুবরাজকে মুক্তি দেন। সুলায়মান কররানি নয় বছর বাংলার শাসকরূপে দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়ে বাংলার সালতানাত বিশাল শক্তির অধিকারী এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের এক প্রভাব বিস্তারকারী শক্তিতে পরিণত হয়। এর সীমা কোচ সীমান্ত থেকে ওড়িশার পুরি পর্যন্ত এবং শোন নদ থেকে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। একজন বিজ্ঞ এবং প্রজাহিতৈষী শাসক হিসেবে সুলায়মান কররানি সুনাম অর্জন করেন। কর্মঠ, পরিশ্রমী এবং কঠোর প্রশাসক কররানি বিচারক হিসেবেও ছিলেন সৎ এবং ন্যায়পরায়ণ। তার রাজ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিরাজমান ছিল। সুলায়মান কররানি একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন। তিনি ধর্মীয় আচারানুষ্ঠানসমূহ যথাযথভাবেই পালন করতেন। তিনি বিদ্বান ও সুফিদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। ১৫৭২ খ্রিস্টাব্দের ১১ অক্টোবর তাঁর মৃত্যু হয়।

আজিমউদ্দিন আহমেদ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর