সোমবার, ২২ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

নবী গবেষক ছফিউর রহমান মুবারকপুরী (রহ.)

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

নবী গবেষক ছফিউর রহমান মুবারকপুরী (রহ.)

বর্তমান সময়ের আলোচিত সিরাত গ্রন্থ আর-রাহিকুল মাখতুম সম্পর্কে নবীপ্রেমিক সবারই কমবেশি ধারণা আছে। ১৯৭৯ সালে রাবেতায়ে আলম ইসলামী সংস্থা এক ব্যতিক্রমী প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর হাজার হাজার জীবনী গ্রন্থ থাকা সত্ত্বেও নতুন করে আবার এ অনুপম মানুষটির জীবনী গ্রন্থ চেয়ে প্রতিযোগিতার আহ্বান করে রাবেতায়ে আলম ইসলামী। ১১৮২ জন নবী গবেষক রসুল (সা.)-এর ওপর অনবদ্য গবেষণালব্ধ প্রেমমাখা চোখভেজা সিরাতের পান্ডুলিপি জমা দেন। নবীজীবন সবগুলোই সেরা। একজন আদনা লেখকও যদি রসুল (সা.)-কে নিয়ে দুকলম লিখে, সে লেখক এবং তার লেখাও নবী প্রেমিকরা দিওয়ানা হয়ে চোখে মুখে বুকে মাখবে, এটাই বাস্তবতা। আর এখানে ১১৮২ নবী গবেষক দিনরাত জেগে কঠোর পরিশ্রম করে সিরাত পান্ডুলিপি জমা দিয়েছেন, এর মধ্য থেকে সেরাটি নির্বাচন করা কত দুঃসাধ্য আর বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। এত শত পান্ডুলিপির মাঝে ভারতের বিখ্যাত নবী গবেষক মাওলানা ছফিউর রহমান মুবারকপুরীর পান্ডুলিপিটি প্রথম ঘোষিত হয়। এরপর থেকেই বিশ্বজুড়ে সিরাত পাঠকদের মুখে মুখে মুবারকপুরীর রাহিকুল মাখতুমের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলায়ও এ গ্রন্থটির সহজ-সাবলীল অনুবাদ পাওয়া যায়। মজার ব্যাপার হলো, আরবি ভাষী না হয়েও আরবি ভাষায় আর-রাহিকুল মাখতুম লিখে ১১৮২টি পান্ডুলিপির ভিতর প্রথম হয়ে ছফিউর রহমান প্রমাণ করে দিলেন তিনি শাহ আবদুল আজিজ, শাহ ওয়ালি উল্লাহ, শাহ আবদুল হক, শাহ আনোয়ার শাহ কাশ্মীরিরই যোগ্য উত্তরসূরি। ১৯৪২ সালের জুন মাসের ৪ তারিখে ভারতবর্ষের আজমগড় জেলার হোসাইনাবাদের মুবারকপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন নবী গবেষক ছফিউর রহমান। ছোটবেলা থেকেই তুখোড় মেধাবী ছিলেন। সব সময় সহপাঠীদের চেয়ে পরীক্ষায় অনেক বেশি নম্বর পেয়ে এগিয়ে থাকতেন। কখনো কখনো অতিরিক্ত নম্বরও পেতেন! একবার এক সহপাঠী অভিযোগ করে শিক্ষককে প্রশ্ন করেন, ওস্তাদ, ছফিউর রহমানকে সব সময় বেশি নম্বর দেন কেন? শিক্ষক মুচকি হেসে বললেন, এই ছেলে অতিরিক্ত নম্বর পাওয়ারই যোগ্য! পৃথিবীর অন্যসব মনীষীর মতোই মুবারকপুরীর প্রাথমিক জীবনও অভাব-অনটনে কেটেছে। সৌদি আরবের দারুসসালাম প্রকাশনীর একজন গবেষক ছফিউর রহমান মুবারকপুরীর মৃত্যুর পর তাঁর জীবনাল্লেখ্যা নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি দেখেন, মুবারকপুরী যখন ফায়জে আম মাদরাসার ছাত্র ছিলেন, তখনই জগদ্বিখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতির ‘মাসায়েলে তারাবিহ’ গ্রন্থটি অনুবাদ করেন। আর এ গ্রন্থ অনুবাদ শেষে প্রকাশ করার মতো কোনো অর্থ মুবারকপুরীর কাছে ছিল না। পরবর্তীতে ছাত্র-শিক্ষকদের সহযোগিতায় এ গ্রন্থ প্রকাশিত হয় এবং গ্রন্থ প্রকাশ বাবদ কিছু অর্থ মুবারকপুরীর হাতে আসে।

প্রচুর অর্থকষ্টে ছাত্রজীবন কেটেছে বলেই দরিদ্র ছাত্রদের বেদনা হৃদয়ে ঢেউ তুলত মুবারকপুরীর। তিনি যখন শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হন তখন দরিদ্র ছাত্রদের গোপনে সহযোগিতা করতেন। ছাত্রদের সঙ্গে ‘মিশুক ওস্তাদ’ হিসেবেও চারদিকে সুনাম-সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে তাঁর। মুবারকপুরীর কয়েকজন ছাত্র স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, আমাদের ওস্তাদ পড়ার ফাঁকে ফাঁকে এমন এমন গল্প বলতেন আমরা আশ্চর্য হয়ে যেতাম। তিনি আমাদের অবাক চেহারার দিকে তাকিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে বলতেন, অবাক হচ্ছ কেন, এগুলো সবই বাস্তব ঘটনা এবং আমার জীবদ্দশাতেই এসব ঘটতে দেখেছি। তবে এ ঘটনাগুলো দুর্লভ এটা সত্যি কথা। আল্লামা ছফিউর রহমান মুবারকপুরীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি সব সময় হাসি-খুশি খোশ মেজাজে থাকতেন। তাঁর সামনে কেউ মুখ ভার করে নীরব বসে থাকলে তিনি তাকেও হাসতে বাধ্য করতেন। মদিনায় তিনি যখন গবেষণা বিভাগে কর্মরত ছিলেন তখনকার ঘটনা। তাঁর একজন সহকর্মী বলেন, দীর্ঘ সময় যদি অফিস রুমে কোনো শব্দ না হতো, তখন মুবারকপুরী আনন্দভরা কণ্ঠে ডাক দিয়ে বলতেন, কী হলো, নীরব থাকার মৌসুম চলছে না কি? কিছু কথা তো হওয়া উচিত বলেই তিনি গল্প বলা শুরু করতেন। করাচির দারুল হাদিস রহমানিয়ার শিক্ষক অধ্যাপক আবদুল্লাহ নাছের রহমানী বলেন, একবার আমি হজের উদ্দেশে মদিনায় যাই। কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলাপ করার জন্য মুবারকপুরীকে ফোন করি। মুবারকপুরী ফোন পেয়ে নিজেই আমার হোটেলে চলে আসেন। আপ্যায়নের জন্য তাকে বড় গ্লাসে শরবত দিই। কিন্তু তিনি আমার জন্য নির্ধারিত ছোট গ্লাসের শরবত নিয়ে সুরা সাফফাতের ২২ নম্বর আয়াত তেলাওয়াত করে বললেন, ‘তোমাদের এ বণ্টন তো খুব অসংগত বণ্টন হয়ে গেল দেখছি।’ করাচির অধ্যাপক বলেন, রসিকতার এতটুকু সুযোগও মুবারকপুরী হাত ছাড়া করলেন না। তাছাড়া সময় কম থাকায় আমি তার সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করতে চাইলাম, কিন্তু তিনি সব কাজ ফেলে নিজেই আমার সঙ্গে দেখা করতে চলে এলেন। একজন উঁচু স্তরের আলেমের এ ধরনের বিনয় সেদিন সত্যিই আমাকে মুগ্ধ করেছিল এবং অনেক কিছু শিখিয়েছে। ছফিউর রহমান মুবারকপুরী ১৯৮৮ সাল থেকে দীর্ঘ সময় মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বিভাগে রসুল (সা.)-এর জীবনীর ওপর গবেষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০০৬ সালের ১ ডিসেম্বর পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী জীবন থেকে মওতের গাড়ি চড়ে আখেরাতের অনন্ত জীবনের উদ্দেশে পাড়ি জমান নবীপ্রেমিক, নবী গবেষক এ মহান সাধক। মহান এ আলেমে দীন, নবী গবেষকের বিনয়, জ্ঞানের আগ্রহ এবং খোশ মেজাজি আল্লাহ আমাদের মাঝে জাগিয়ে দিন। আমিন।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাস্সির সোসাইটি, পীর সাহেব আউলিয়ানগর।

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর