বুধবার, ২৪ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

অকারণ হত্যাকান্ড জঘন্য অপরাধ

এম এ মান্নান

অকারণ হত্যাকান্ড জঘন্য অপরাধ

ইসলামে মানুষ হত্যাকে জঘন্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যারা বিনা বিচারে মানুষ হত্যা করে তারা জঘন্য অপরাধী। গণহত্যা আরও বড় অপরাধ।  দুনিয়ায় অহেতুক কারও প্রাণনাশ বা হত্যা সামাজিক অনাচার ও অত্যাচারের অন্তর্ভুক্ত। আল কোরআনে মানব হত্যাকে চিরতরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ছাড়া তোমরা তাকে হত্যা কোর না।’ সুরা বনি ইসরাইল আয়াত ৩৩।

ইমাম কুরতুবি (রহ.) মুসনাদে বাজ্জারের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘পৃথিবীর সব মানুষ একসঙ্গে যদি একজন নিরপরাধ মানুষকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয় তবে আল্লাহ সব মানুষকেই জাহান্নামে দেবেন। এর পরও অন্যায়ভাবে হত্যাকে কখনো মেনে নেবেন না।’ কিয়ামতের দিন মানুষ হত্যার বিচার করা হবে সবার আগে। তারপর অন্য অপরাধের বিচার। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে সর্বপ্রথম যে মোকদ্দমার ফয়সালা হবে তা হলো রক্তপাত (হত্যা) সম্পর্কিত।’ বুখারি, মুসলিম।

আল্লাহতায়ালার যত সৃষ্টি রয়েছে এর মধ্যে শ্রেষ্ঠতম হচ্ছে মানুষ। মানব সৃষ্টির ব্যাপারে আল্লাহ ফেরেশতাদের প্রবল আপত্তি উপেক্ষা করেছেন এবং মানুষকে এ জমিনে তাঁর প্রতিনিধি বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমার পালনকর্তা যখন ফেরেশতাদের বললেন আমি পৃথিবীতে একজন প্রতিনিধি বানাতে যাচ্ছি তখন তারা বলল তুমি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে সৃষ্টি করবে যে দাঙ্গা-হাঙ্গামার সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত ঘটাবে? অথচ আমরা প্রতিনিয়ত তোমার গুণকীর্তন করছি এবং তোমার পবিত্র সত্তাকে স্মরণ করছি। তিনি বললেন, নিঃসন্দেহে আমি জানি যা তোমরা জানো না।’ সুরা বাকারা আয়াত ৩০। মানুষের প্রতি ভালোবাসার কারণেই আল্লাহ মানুষকে তাদের দান করেছেন সৃষ্টিকুলের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর আকৃতি। আল্লাহ রব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, ‘আমি সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতর অবয়বে।’ সুরা ত্বিন আয়াত ৪। শুধু তাই নয়, আল্লাহর সুস্পষ্ট বাণী হচ্ছে- এ বিশ্বজগতের সবকিছু তিনি সৃষ্টি করেছেন কেবল মানুষেরই জন্য। আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তিনিই সেই সত্তা যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য জমিনের সবকিছু।’ সুরা বাকারা আয়াত ২৯। আল্লাহ যেমন ভালোবাসা দিয়ে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তিনি মানব জাতির সুরক্ষা ও নিরাপত্তাও নিশ্চিত করেছেন। একজন মানুষের জীবন সম্পদ মানসম্মান আল্লাহর কাছে এত দামি যে কোরআন ও হাদিসে এসব বিষয়ের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আল কোরআনে একজন মানুষ হত্যা করাকে গোটা মানব জাতিকে হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে কেউ প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ অথবা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করা ছাড়া কাউকে হত্যা করে সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করল।’ সুরা মায়েদা আয়াত ৩২।

পৃথিবীতে যত পাপ আছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় কোনটি? একাধিক হাদিসে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সাতটি মহাপাপ থেকে বেঁচে থাকো। এর প্রথমটি হলো আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক বা অংশীদার করা। আর তৃতীয়টি হলো অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা।’ বুখারি, মুসলিম।

অন্যদিকে একজন মানুষের জীবন রক্ষাকেও গোটা মানব জাতির জীবন রক্ষা বলে সাব্যস্ত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং যে কারও জীবন রক্ষা করে সে যেন সবার জীবন রক্ষা করে।’ সুরা মায়েদা আয়াত ৩২। যেহেতু একজন মানুষের জীবনের দাম এত বেশি তাই এর সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্যও প্রয়োজন কঠোর আইন ও বিধান। আর তাই আল্লাহ মানুষের জীবনের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য কিসাসের মতো কঠোর শাস্তির বিধান দিয়েছেন। কিসাস হচ্ছে কেউ কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করলে এর শাস্তিস্বরূপ ঘাতককে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে ইমানদাররা! তোমাদের প্রতি নিহতদের ব্যাপারে কিসাস গ্রহণ করা বিধিবদ্ধ করা হয়েছে।’ সুরা বাকারা আয়াত ১৭৮। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে বুদ্ধিমানেরা! কিসাসের মধ্যে তোমাদের জন্য জীবন রয়েছে, যাতে তোমরা সাবধান হতে পারো।’ সুরা বাকারা আয়াত ১৭৯। আয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে, যখন কোনো ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কোনো মানুষকে হত্যা করে তখন সে এতটাই অপাঙ্ক্তেয় হয়ে যায় যে সে পৃথিবীতে থাকার, মনুষ্যসমাজে বাস করার অধিকার হারায়। সে হয়ে পড়ে মানবসমাজের এক মরণঘাতী ব্যাধি, মানবসমাজ টিকে থাকার জন্য যার অপসারণ অপরিহার্য। আর অপসারণের কাজটিই হয় কিসাস তথা ঘাতকের মৃত্যুদন্ড কার্যকরের মাধ্যমে। ফলত এ কথা সুনিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে কোনো ঘাতকের মৃত্যুদন্ড কার্যকর মানেই অন্যান্য মানুষের নিরাপদ জীবন লাভ। ‘একবার হজরত হামজা (রা.) রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রসুলুল্লাহ! আমাকে এমন পথ বলে দিন যা আমাকে সুখী করবে। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, মানুষের জীবন রক্ষা ও ধ্বংস করা এ দুটির মধ্যে তুমি কোনটি পছন্দ কর? হামজা (রা.) বললেন, মানুষের জীবন রক্ষা করা। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, দুনিয়া ও আখিরাতে সুখী হওয়ার জন্য তুমি এ কাজই করতে থাকো।’ মুসনাদে আহমাদ। যখন কেউ অন্যায় ও অবৈধভাবে মানুষ হত্যায় লিপ্ত হয় তার ওপর থেকে আল্লাহর রহমত ও বরকত উঠে যায়। আল্লাহ হত্যাকারীদের ওপর নাখোশ হন এবং তাদের ওপর আল্লাহ-প্রদত্ত সাজা নাজিল হয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা গণহত্যায় লিপ্ত হয়েছিল তাদের লজ্জাজনক পরাজয় তারই প্রমাণ।

 

লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক।

সর্বশেষ খবর