শিরোনাম
শুক্রবার, ২ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বনেতাদের শ্রদ্ধা

ড. মুহাম্মদ সামাদ

বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বনেতাদের শ্রদ্ধা

মুজিববর্ষে ১৭ মার্চ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত বর্ণাঢ্য আয়োজনে উদ্যাপিত হলো আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর বহমানের জন্মশতবার্ষিকীর প্রধান উৎসব ‘মুজিব চিরন্তন’। মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানাদির শুরুতে কভিড-১৯ পৃথিবীকে আক্রমণ করে বসে। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের করণীয় নির্ধারণে ২০২০ সালের ৮ মার্চ সন্ধ্যায় গণভবনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় কমিটি ও বাস্তবায়ন কমিটির জরুরি সভা আহ্বান করেন। সভায় সবার নানান পরামর্শের মধ্যে একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানা মত দেন, জাতির পিতার রাজনীতি ছিল মানুষের মঙ্গলের জন্য, সেই মানুষের জীবনকে জিম্মি রেখে মুজিববর্ষের অনুষ্ঠান করা সংগত হবে না। এ মত যে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার যৌথ সিদ্ধান্ত এমন অনুমানে অপরাধ নেই!

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুজিববর্ষজুড়ে করোনা মোকবিলা করেছেন। বিশ্বের বহু দেশের আগে বাংলাদেশের মানুষের জন্য টিকা এনে দিয়েছেন। গরিব-অসহায় মানুষের মুখের আহার জুগিয়েছেন। ঘরহীন মানুষকে সুন্দর সুন্দর বাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। জীবন-জীবিকা স্বাভাবিক করতে লাখো-কোটি টাকা প্রণোদনা দিয়েছেন। অনলাইনে এবং বিভিন্ন সহায়ক সুযোগ তৈরি করে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রেখেছেন। জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডেকে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের ওপর আলোচনা করেছেন এবং বঙ্গবন্ধু মুজিবের প্রাপ্য শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবকিছু সামলে নিয়ে ১৭ মার্চ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত আয়োজন করলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর প্রধান উৎসব ‘মুজিব চিরন্তন’। সব সময় সঙ্গে রাখলেন পঁচাত্তরের শোকাবহ ও নির্মম ঘটনার পর মায়ের মমতা নিয়ে দুঃখে-সুখে, কান্নায়-আশ্রয়ে, সংসারের হাল ধরায় ও সন্তান লালনপালনে সর্বোপরি রাজনীতির বন্ধুর পথচলায় অটল-অবিচল হয়ে পাশে থাকা প্রত্যুৎপন্নমতিসম্পন্ন ছোট বোন শেখ রেহানাকে। ‘মুজিব চিরন্তন’ অনুষ্ঠানমালায় প্রধানত এশিয়া, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা- এ তিন মহাদেশের সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানগণ বাঙালির স্বাধীন-সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন। ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিন পিং ১৯৫২ ও ১৯৫৭ সালে বঙ্গবন্ধুর চীন সফর এবং চেয়ারম্যান মাও সে তুং ও চৌ এন লাইসহ প্রবীণ প্রজন্মের চীনা নেতাদের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। রাষ্ট্রপতি শি জিন পিং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন ও সাফল্যের প্রশংসা করেন। তিনি ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ নীতির আওতায় চীন-বাংলাদেশ সহযোগিতার কৌশলগত অংশীদারিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিদে সুগা তাঁর সরকার ও জনগণের পক্ষ থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে হৃদয় উৎসারিত অভিনন্দন জানান। তিনি উল্লেখ করেন, ৫০ বছর আগে বঙ্গবন্ধুর অদম্য নেতৃত্বে জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করলে প্রথম দিকের স্বীকৃতি প্রদানকারী দেশসমূহের মধ্যে জাপান অন্যতম। জাপানি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকে জাপানে স্বাগত জানানোর ঐতিহাসিক ঘটনা স্মরণ করেছেন এবং জাপানের ধান খেত ও ফসলের মাঠ দেখতে গিয়ে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলাপের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি জাপান ও বাংলাদেশের পতাকা এবং দুই দেশের দিগন্তবিস্তৃত ধান খেতের সাদৃশ্য তুলে ধরেছেন। এ ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য, অবকাঠামো উন্নয়নসহ বিভিন্ন প্রকল্পে অতীতের মতো সহায়তা অব্যাহত রেখে এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন জাপানি প্রধানমন্ত্রী সুগা। ২০ মার্চ ওআইসি মহাসচিব ড. ইউসুফ আল ওথাইমিন ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের ওআইসির সদস্যপদ লাভের কথা স্মরণ করেন। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস সামাজিক উন্নয়ন, দুর্যোগ মোকাবিলা, শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ এবং মিয়ানমার থেকে আসা লাখ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার প্রশংসা করে বাংলাদেশের পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।

২৬ মার্চ ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ১৯৭২ সালে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের বন্ধুত্ব রচনা হয়েছিল বলে মন্তব্য করে বলেন, ব্রিটেন-বাংলাদেশ সম্পর্কের আগামী ৫০ বছরের দিকে তাকিয়ে আমি আপনাদের সুবর্ণজয়ন্তীর আন্তরিক শুভকামনা জানাচ্ছি। একই দিন রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভøাদিমির পুতিন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে অসাধারণ নেতা হিসেবে উল্লেখ করেন এবং দুই দেশের বন্ধুত্বের ঐতিহাসিকতা তুলে ধরে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য গঠনমূলক সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন এক অভিনন্দন বার্তায় অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশকে উদারতা, মানবিকতা ও মানবাধিকারের নজির হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

‘মুজিব চিরন্তন’ অনুষ্ঠানমালায় দক্ষিণ এশিয়ার নেতৃবৃন্দের কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর প্রতি দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের গণতন্ত্রকামী মানুষের ভালোবাসার কথা গভীর আন্তরিকতায় উচ্চারিত হয়েছে। সেজন্য সম্মানিত অতিথিমন্ডলী- ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, নেপালের রাষ্ট্রপতি বিদ্যাদেবী ভান্ডারী, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ডা. লোটে শেরিং, শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে ও মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি ইবরাহিম মোহাম্মদ সলিহর প্রতি আমরা আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। মহামারী কভিড-১৯ উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে অভূতপূর্ব সাড়া দিয়ে ‘মুজিব চিরন্তন’ অনুষ্ঠানমালায় তাঁরা বঙ্গবন্ধুর সংগ্রাম, সাফল্য আর কীর্তিগাথার ওপর তাৎপর্যমন্ডিত বক্তব্য প্রদান করে বঙ্গবন্ধুকে মহিমান্বিত করেছেন এবং বাংলাদেশের মানুষকে সম্মানিত করেছেন।

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানমঞ্চে বড় বোন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সঙ্গে নিয়ে শেখ রেহানা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হাত থেকে ‘গান্ধী শান্তি পুরস্কার ২০২০’ গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুকে এ পুরস্কার দিয়ে ভারত গর্বিত হয়েছে বলে বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন পুরস্কারের বিচারকম-লীর প্রধান নরেন্দ্র মোদি। উপমহাদেশের দুই মহান নেতা বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী স্মরণে ঢাকায় ‘বঙ্গবন্ধু-বাপু ডিজিটাল প্রদর্শনী’ উদ্বোধন করা হয়েছে। টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার সমাধিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করে নরেন্দ্র মোদি লিখেছেন- ‘অধিকার, নিজস্ব সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের জন্য বাংলাদেশের মানুষের যে সংগ্রাম, বঙ্গবন্ধুর জীবন তারই প্রতিচিত্র। তাঁর অবিনাশী চেতনা আর অদম্য সাহস কোটি মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে, বহু বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে তারা পরিণত হয়েছে বিজয়ী জাতিতে।’

সর্বোপরি বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ‘মুজিব চিরন্তন’ অনুষ্ঠানমালায় প্রধান অতিথি হয়ে বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে জেল-জুলুম-নির্যাতন সহ্য করে বঙ্গবন্ধুর সাহসী নেতৃত্বে অর্জিত স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাস তুলে ধরে তা পাঠ ও অনুশীলনের জন্য তরুণ প্রজন্মের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় কমিটি ও ‘মুজিব চিরন্তন’ অনুষ্ঠানমালার সভাপতি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর মহাজীবনের উদার ও মানবিক মূল্যবোধ ধারণ ও চর্চার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি সারা বিশ্বের শোষিত-নিপীড়িত মানুষের মুক্তির সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের প্রভাব নিয়ে কথা বলেছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা পারস্পরিক সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বজায় রেখে দক্ষিণ এশিয়াকে একটি সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সবাইকে একযোগে কাজ করার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন।

একটি বিষয় না বললেই নয়, ‘মুজিব চিরন্তন’ অনুষ্ঠানমালায় আমাদের দেশের বরেণ্য লেখক-শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবীগণ বঙ্গবন্ধুর মহাজীবনের নানা দিক নিয়ে মূল্যবান বক্তব্য দিয়েছেন। দেশের নবীন-প্রবীণ ও প্রথিতযশা সংস্কৃতিকর্মীরা কবিতা, সংগীত, নাটক ও নৃত্যের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে শৈল্পিকভাবে উপস্থাপন করেছেন। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ভারতের প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ পন্ডিত অজয় চক্রবর্তী ‘মৈত্রী’ নামে একটি নতুন রাগ সৃষ্টি করেছেন এবং তা সংস্কৃত, হিন্দি ও বাংলা ভাষায় পরিবেশন করেছেন। তাঁদের এ যূথবদ্ধ প্রয়াস নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।

পিতার প্রতি কন্যার মমত্ববোধ ও ভালোবাসা চিরন্তন। আদরের ছোট বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ‘মাতৃসমা’ কন্যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সযতœ তত্ত্বাবধানে আয়োজিত ‘মুজিব চিরন্তন’-এর ব্যাপ্তি দেশের সীমানা পেরিয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে গেছে। পৃথিবীর দেশে দেশে আমাদের দূতাবাস/হাইকমিশনসমূহ ও প্রবাসী বাঙালিদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের উদ্যোগে উদ্যাপিত হয়ে চলেছে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর উৎসব। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ‘মুজিব চিরন্তন’ অনুষ্ঠানমালা একদিকে বঙ্গবন্ধু মুজিবকে অনন্য উচ্চতায় তুলে ধরেছে, অন্যদিকে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সাফল্য বাঙালি জাতিকে করেছে গর্বিত ও মহিমান্বিত। শেখ হাসিনার শক্তিশালী নেতৃত্ব, অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা, অর্জিত অভিজ্ঞতা, দৃঢ় ব্যক্তিত্ব ও প্রজ্ঞার প্রোজ্জ্বল প্রকাশ এ ‘মুজিব চিরন্তন’ অনুষ্ঠানমালা। এ উদ্যোগ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার এক অনন্য সাফল্য।

লেখক : কবি ও শিক্ষাবিদ।

সর্বশেষ খবর