শুক্রবার, ২ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

সহমর্মিতার হাত বাড়াতে হবে

অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের চরম আতঙ্কের মধ্যে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিশ্ব যখন নাকাল তখন অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুরা আরও বেশি নাজুক। এই সময়ে তাদের বিশেষ যত্ন ও সেবার প্রয়োজন। তাদের দিকে বেশি খেয়াল রাখা প্রয়োজন। অটিজম শব্দের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৮০ সালের ৯ জুলাই সোভিয়েত ইউনিয়নের অদেসা রিজিওনাল হাসপাতালে। তখন আমি পিএইচডির ছাত্র। একদিন বহির্বিভাগে আমার গবেষণা তত্ত্বাবধায়কের পেছনে বসে তাঁর রোগী দেখার পদ্ধতি উপভোগ করছিলাম। ওই সময় একটি অটিস্টিক শিশুর মা বারবার অধ্যাপককে অনুরোধ করছিলেন তার ছেলেকে লাইন ভেঙে দেখার জন্য। অধ্যাপক দ্রাগো মিরেস্কিও তাকে নেতিবাচক উত্তর দিলেন। আবারও ভদ্রমহিলা বললেন, অধ্যাপক আমার ছেলেটি অটিস্টিক। সে অঙ্কে খুব ভালো। আধা ঘণ্টা পর তার অঙ্কের ক্লাস। তুমি যদি একটু দেখে দাও। অনুমতি পেয়ে ছেলেটি যখন রোগীর সিটে বসল অধ্যাপক তাকে জিজ্ঞেস করলেন তুমি অঙ্কে খুব ভালো? মৃদু শ্রেণিভুক্ত অটিস্টিক ছেলেটি মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। অধ্যাপক তার কাছে জানতে চাইলেন দুই যোগ দুই সমান কত? বাচ্চাটির জবাব ‘পাঁচ’। তিনি হাসলেন। ছেলেটির মা এতই সুদৃঢ় এবং আস্থাবান তিনি বললেন প্রফেসর আমার ছেলে যখন বলেছে দুই যোগ দুই সমান পাঁচ তাহলে সে তা প্রমাণ করতে পারবে। এমন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হেরে যাওয়ার ভয়ে অধ্যাপক একটি কাগজ বের করে দিলে সে প্রমাণ করল বীজগণিতের সূত্র ধরে ২+২=৫। আমি অবাক দৃষ্টিতে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

আমার অধ্যাপক আরও দু-একটি গাণিতিক প্রশ্ন করলেন ছেলেটি যার অদ্ভুত সব উত্তর এবং এর প্রমাণ উপস্থাপন করল। ১৯৭০ সালে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ১৯৮০ সালের শুরু পর্যন্ত এ শব্দটি আমি শুনেছি বলে মনে হয়নি। হয়তো আমার কোনো শিক্ষক এ ব্যাপারে বলে থাকলেও পরীক্ষা পাসের জন্য জরুরি নয় বলে এ সম্পর্কে আমি কিছুই পড়িনি, সুতরাং জানার প্রশ্নই ওঠে না। ২০১০ সাল, আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে একদিন জিজ্ঞেস করলেন বঙ্গবন্ধুতে শিশু স্নায়ুরোগ বিদ্যার কী অবস্থা? অত্যন্ত নিচুস্বরে বললাম খুবই খারাপ! ব্যাখ্যা করলাম বহির্বিভাগে ছোট একটা জায়গায় ডা. শাহীন চার-পাঁচটি করে বাচ্চা দেখেন। কোনো ওয়ার্ড নেই, রোগ নির্ণয়ের সুযোগ-সুবিধা নেই। তিনি নির্দেশ দিলেন শিশু স্নায়ুবিদ্যা বিভাগের উন্নতি করার জন্য। তাঁর নির্দেশ মোতাবেক সরকারের ৭ কোটি টাকা বরাদ্দের কর্মসূচির আওতায় লন্ড্রি বিল্ডিংয়ের এক তলার ওপর অতিদ্রুত আরও পাঁচটি ফ্লোর করে ২০১০ সালের শেষের দিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে এর উদ্বোধন করাতে সক্ষম হই।

সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুলের নেতৃত্বে ২০১১ সালের ২৫ জুলাই একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়। এর কারিগর ছিলেন সায়মা ওয়াজেদ হোসেন এবং নেতৃত্বে ছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সহযোগিতায় স্বাস্থ্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির সহযোগিতা ছিল প্রশংসনীয়। এ সম্মেলনে ‘ঢাকা ঘোষণা’ গৃহীত হয়। এরপর আন্তর্জাতিক প্রচারের সুযোগ হয়।

এ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর এক বিশেষ দায়িত্ব ছিল। ১ হাজার ডেলিগেটের স্বাস্থ্যসেবা জরুরি হলে তার ওপর তিনজন বিশেষ অতিথি- ভারতের কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী, শ্রীলঙ্কার ফার্স্ট লেডি মিসেস রাজাপাকসে ও মালদ্বীপের ভাইস প্রেসিডেন্ট-পত্নী মিসেস এলহাম। সমগ্র সম্মেলনে শুধু দিকনির্দেশনা নয় দ্যুতি ছড়িয়েছিলেন সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুল। আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখেছি তাঁর কর্মপ্রেরণা, দক্ষতা এবং গতি। মনে হতো পদার্থবিদ্যার স্থিতিশক্তি তার নেই আছে শুধু গতিশক্তি। আর তাই স্বাভাবিক। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান সাহেবের হাতে আমরা যখন বাংলাদেশে অটিজম ও স্নায়ুবিকাশ-জনিত সমস্যার Situation Analysis করে একটা Strategy Plan দিতে গেলাম বঙ্গভবনে তিনি সায়মা ওয়াজেদ সম্পর্কে বললেন, ‘যে ধমনিতে বঙ্গবন্ধুর রক্ত সে তো জনগণের জন্যই কাজ করবে, নিজের জন্য নয়।’ আসলেও তাঁর পরিশ্রম, ক্লান্তিহীন গতি দেখে তা অস্বীকার করার উপায় নেই, আমি শুধু তাঁর পেছনে দৌড়াতাম।

২৫ জুলাই ও মহাসম্মেলন অটিজম নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে আমাদের বিশেষ প্রেরণা জুগিয়েছে। পুতুলের অনুরোধ বা আমন্ত্রণে আমেরিকাসহ বিশ্বের নানা বিশেষজ্ঞ যাঁরা শিশু মনোরোগ, স্নায়ুরোগ নিয়ে দ্যুতি ছড়াচ্ছেন তাঁর অনেকেই বাংলাদেশে আসেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এ আয়োজন প্রশংসা কুড়িয়েছিল। ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুল জাতিসংঘে যে রেজুলেশন উপস্থাপন করেন তা সর্বসম্মতভাবে পাস হয়। এজন্য বাংলাদেশ গর্ববোধ করতে পারে।

অটিজমের বাচ্চারা সব সময় একক, সম্পূর্ণ কৌতূহলোদ্দীপক, কখনো কখনো রহস্যময়। তাদের জন্য দরকার বাড়তি যত্ন। তাদের জন্য করণীয়- সব সময় তাদের বুঝতে হবে, কথা বলতে বা বলাতে হবে, সবার সঙ্গে মিশতে দিতে হবে এবং বিশেষ প্রাধিকার দিতে হবে। তাদের নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব ত্যাগ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, ঘৃণা বা অবজ্ঞায় শিশুদের মানসিক সমস্যা আরও বাড়িয়ে দেয়। পরিশেষে বলব সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুল- পারিবারিক রাজনীতির বেষ্টনীতে থাকলে কী হবেন জানি না কিন্তু আমি বিশ্বাস করি তিনি একদিন পুরো বিশ্বকে অটিজম এবং স্নায়ুবিকাশ-জনিত সমস্যার ওপর নেতৃত্ব দেবেন ইনশা আল্লাহ। আমি মনে করি অটিজম শিশুদের সঙ্গে অবশ্যই ভালো আচরণ করতে হবে, ভালোবাসা ও সহমর্মিতার হাত বাড়াতে হবে। তাদের সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে হবে।

লেখক : সাবেক উপাচার্য

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব

মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর