শনিবার, ৩ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

লিলিতে লাভের সুঘ্রাণ

শাইখ সিরাজ

লিলিতে লাভের সুঘ্রাণ

দেশে টিউলিপ চাষে রীতিমতো বিস্ময় সৃষ্টি করেছেন গাজীপুরের শ্রীপুর পৌর এলাকার কেওয়া দক্ষিণখন্ড গ্রামের দেলোয়ার-শেলী দম্পতি। টেলিভিশনে টিউলিপ চাষের খবর প্রচারিত হওয়ার পর সেই টিউলিপ ফুলের বাহার দেখার জন্য ভিড় লেগে গিয়েছিল দেলোয়ারের খামারে। সাধারণ মানুষ তো বটেই সরকারের উচ্চপদস্থ আমলা থেকে শুরু করে মন্ত্রী পর্যন্ত ঘুরে দেখে এসেছেন তাদের টিউলিপ ফুলের চাষ ক্ষেত্রটি। প্রথম বছর যখন দেলোয়ারের টিউলিপ চাষ নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতে যাই তখন দেখেছি ওই টিউলিপের খেতের পাশেই একই শেডে একখন্ড জমিতে পরীক্ষা চলছিল লিলি চাষের। বলেছিলেন লিলি নিয়ে চলছে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা। সফল হলেই লিলি নিয়ে মাঠে নামবেন। সেই ওরিয়েন্টাল লিলি এখন অসাধারণ শোভা ছড়াচ্ছে দেলোয়ার-শেলীর ফুল চাষের শেডে। বাংলাদেশের মাটিতে আরেক বিস্ময়ের সূচনা হলো। পাঠক! আজ আপনাদের সে বিস্ময়কর লিলির সৌরভের গল্পই বলব, যা ছড়াচ্ছে অন্যরকম এক লাভের সুঘ্রাণ।

২০১৫ সালের কথা। ফুলের রাজ্যখ্যাত নেদারল্যান্ডস ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছিল ফুল চাষ ও বাণিজ্য নিয়ে তাদের কর্মকান্ড। ফুল ঘিরে তাদের যেমন ব্যস্ততা তেমন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও। বিশ্বে ফুল বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র ‘ফ্লোরাহল্যান্ড’। সেখানে আন্তর্জাতিক নিলামের মাধ্যমে প্রতিদিন বেচাকেনা হয় প্রায় আড়াই কোটি ফুল। বিশ্বের ফুল বাজারের অর্ধেকের বেশি ফুল রপ্তানি হয় সে বাজার থেকে। পৃথিবীতে যে প্রতিষ্ঠানগুলো ফুলের জাত উন্নয়ন থেকে চাষ ও বাজারজাতকরণেও শীর্ষে রয়েছে তাদের একটি নেদারল্যান্ডসের রয়্যাল ভ্যান জানটেন। সেবার সুযোগ হয়েছিল ফুল নিয়ে তাদের কাজকারবার খুব কাছ থেকে দেখার। রয়্যাল ভ্যান জানটেনের ফুল চাষের এলাকা শুধু নেদারল্যান্ডসেই সীমাবদ্ধ নয়, দেশের মাটি পেরিয়ে পৌঁছেছে সাউথ আফ্রিকা, উগান্ডা ও নিউজিল্যান্ডে। ১৮৬২ সাল থেকে ফুল নিয়ে তাদের বাণিজ্য। বিশ্বব্যাপী প্লান্ট ও ফুলের আন্তর্জাতিক নার্সারি হিসেবে প্রসিদ্ধ এ প্রতিষ্ঠান। ফ্লাওয়ার বাল্ব রপ্তানি তাদের মূল বাণিজ্য। ঘুরে দেখেছিলাম ফুল নিয়ে তাদের বিশাল কর্মযজ্ঞ। জেনেছিলাম প্রতিষ্ঠানটি সে বছর লিলি বাল্বই উৎপাদন করছে ১১ কোটি। টিউলিপ বাল্ব ৫ কোটি, অন্যান্য ফুলের বাল্ব উৎপাদন করছে ২ কোটি। প্রগতিশীল ও নতুন নতুন ধারণা নিয়ে কাজ করে এ প্রতিষ্ঠান। নতুন ধরনের ফুলের জাত উন্নয়ন করে চলেছে তারা। রয়্যাল ভ্যান জানটেনে কয়েক জাতের লিলির পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেখেছিলাম। তারা বলছিলেন, একেক দেশে একেক রঙের লিলির কদর। যেমন ভিয়েতনামে হলুদ লিলির চাহিদা বেশি, জাপানে গোলাপি আর ইউরোপে সাদা লিলির চাহিদা ৭০%। যা হোক, রয়্যাল ভ্যান জানটেনের সঙ্গে আমাদের কৃষি উদ্যোক্তা দম্পতি দেলোয়ার ও শেলীর এক দারুণ যোগাযোগ গড়ে উঠেছে। সেখান থেকেই তারা সংগ্রহ করছেন নানান ফুলের বাল্ব। আর এখন তারা টিউলিপের পর ১০ হাজার ওরিয়েন্টাল লিলি ফুটিয়ে জানান দিচ্ছেন অসাধারণ সৌরভ ছড়ানো ফুলটির সম্ভাবনার কথা। শেডের নিচে কয়েকটি সারিতে ১০ হাজার গাছে পাপড়ি মেলে আছে ইউরোপের ফুল লিলি। শেডে প্রবেশ করতেই নাকে এসে লাগে চমৎকার সুঘ্রাণ। একেক লিলির একেক রকম ঘ্রাণ। বলে রাখি, এ লিলি যখন বাল্ব আকারে থাকে তখন তাকে বলা হয় লিলিয়াম। দেলোয়ার বলছেন, তিনিই দেশে প্রথম বাণিজ্যিক লিলি চাষি। ২০১৭ সালে মাত্র কয়েকটি দিয়ে শুরু করে এখন চাষ এলাকা বাড়িয়েছেন। একটি শেডে ৭ শতক জমি, অন্য শেডে ৫ শতক মোট ১২ শতক জমিতে ১০ হাজার ওরিয়েন্টাল লিলির গাছ। প্রতিটি গাছে ফুলের কুঁড়ি। কয়েকটিতে ফুল ফুটে আছে। ছড়াচ্ছে দারুণ সৌরভ। দেলোয়ার জানালেন ফুটন্ত ফুলগুলো তিনি রেখে দিয়েছেন আমার জন্য। ফুল সাধারণত কুঁড়ি অবস্থাতেই বাজারজাত করা হয়। আর সব ফুলের চেয়ে ওরিয়েন্টাল লিলি চাষে খরচ যেমন বেশি ফুলের দামও তেমন বেশি, বলছিলেন দেলোয়ার। তাই জেনেবুঝেই তিনি একটু একটু করে বৃদ্ধি করছেন ফুলের চাষ। পৃথিবীতে সাদা, হলুদ, কমলা, গোলাপি, লাল ও বেগুনি বর্ণের লিলি ফুলের দেখা মিললেও এখানে এখন পর্যন্ত দুই রঙের ফুলই উৎপাদন করেছেন দেলোয়ার। সাদা ও গোলাপি রঙের ওরিয়েন্টাল লিলি। অনেকটা রজনিগন্ধার ডাঁটার মতোই শক্ত ও লম্বা গাছের লিলি ফুল। এক সপ্তাহ হলো বিক্রি শুরু করেছেন। একটি ডাঁটায় তিন-চারটি করে ফুলের কুঁড়ি। দেলোয়ার জানালেন, ডাঁটায় ফুলের কুঁড়ির সংখ্যার ওপর দাম কমবেশি হয়। ১২ শতক জমির লিলি থেকে এবার ১২ লাখ টাকার ফুল বিক্রির আশা করছেন তিনি। বিস্ময় নিয়ে জানতে চাইলাম, সম্ভব? শান্ত কণ্ঠে আশ্বস্ত করলেন, সম্ভব। ওরিয়েন্টাল লিলি সবচেয়ে দামি ফুল। দেশের বাজারে এর যথেষ্ট চাহিদা। বিদেশ থেকে আমদানি হয়। তিনি স্টিকে ফুলের কুঁড়ির সংখ্যা অনুপাতে একেকটি স্টিক বিক্রি করছেন ১২০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত। সে হিসাবে ১০ হাজার গাছ থেকে কমপক্ষে ১২ লাখ টাকা পাওয়া কঠিন নয়। প্রতিটি স্টিকে বিনিয়োগ করতে হয়েছে ৭০ টাকার মতো। তবে লাভ আরও বেশি হতো যদি খরচটা কমানো যেত। বাল্ব আনাতেই মূল খরচ। প্রতিটি বাল্বের জন্য ৫ টাকা কোয়ারেন্টাইন ফি। আবার ১০ শতাংশ ট্যাক্স। এ বিষয়টা সরকার যদি একটু বিবেচনা করে তবে খরচ অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে আসবে। তখন ভোক্তা আরও কম মূল্যে ফুল কিনতে পারবে। ওরিয়েন্টাল লিলি বাংলাদেশে আগে চাষ না হলেও এখন করা সম্ভব হচ্ছে, এটিই দেলোয়ারের সবচেয়ে বড় সফলতা। তার হাত ধরেই দেশে লিলি ছড়িয়েছে, তার দাবি। এটি বাড়ানোর ব্যাপক সম্ভাবনাও দেখছেন দেলোয়ার। তিনি বলেন, ‘আগে যখন আমরা জারবেরা চাষ শুরু করেছিলাম তখন প্রতিটি বিক্রি করতাম ৩০ টাকা করে। সারা দিনে ১০০ ফুলও বিক্রি করা সম্ভব হতো না। এখন ফুলের দাম ৫ টাকা। এক-দেড় লাখ ফুল দৈনিক বিক্রি হয়।’

তরুণ উদ্যমী কৃষক এখন দৌড়াচ্ছে দ্রুতগতিতে। বাংলাদেশের মাটিতে যে কোনো অসম্ভবকে সম্ভব করতে তাদের কোনো জুড়ি নেই। একেক সময় একেক বিস্ময় হাজির করছেন তারা। কারণ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির যুগে নতুন প্রযুক্তি, প্রতিষ্ঠান কিংবা নতুন কোনো জাতের ফসলের খোঁজ করে বের করা কঠিন নয় তাদের কাছে। তবে শুধু বাণিজ্যিক উদ্যোগ নিলেই সাফল্য চলে আসবে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। উদ্যোগ নেওয়ার আগে যেমন লাভক্ষতির হিসাব কষতে হবে পুরোপুরি, তেমনি উদ্যোগটি কতটা সময়োপযোগী বিবেচনায় রাখতে হবে তা-ও। দেলোয়ার এরই মধ্যে বাণিজ্যিক কৃষির পূর্বশর্তগুলো বুঝে গেছেন। তার একটি গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত হলো, একাদিক্রমে চাষ না করে মাটিকে বিশ্রাম দেওয়া। আর সাফল্যের জন্য প্রয়োজন কৃষির প্রতি ভালোবাসা। বাংলাদেশ কৃষি সাফল্যে পৃথিবীতে এক অনন্য নজির গড়েছে, এর পেছনে দেশের নতুন উদ্যোক্তাদের সাহসী উদ্যোগ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার অনেক বড় অবদান রয়েছে। এখনকার কৃষির আবেদন বহুমুখী। এখন বাজারে বিদেশি ফুলের দারুণ চাহিদা। তবে  গত কয়েক দিনে করোনা বিস্তার যেভাবে বেড়ে চলেছে, যদি আবার লকডাউনে যেতে হয় তখন ফুলের বাজার গত বছরের মতো মুখ থুবড়ে পড়ে কিনা সে আশঙ্কাই করছি। গত বছর এ সময়ে ফুল চাষিদের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। অসংখ্য ফুল চাষির ফুল মাঠেই নষ্ট হয়েছে। সে লোকসান অনেকেই এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি। আশা করব সরকার সব কৃষকের পাশে শক্তি হয়ে থাকবে। আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশের কৃষিই একদিন অনন্য বাংলাদেশ গড়তে বড় ভূমিকা রাখবে, যে বাংলাদেশের দিকে সারা বিশ্ব অবাক তাকিয়ে থাকবে।

লেখক : গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর