শনিবার, ৩ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ

আতিক হেলাল

বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ

উপমহাদেশের স্বনামখ্যাত আইনবিদ, আইনের শাসন ও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠার অন্যতম রূপকার বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদের আজ ৪২তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৯ সালের ৩ এপ্রিল তিনি ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। ১৯১১ সালের ১১ জানুয়ারি কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। বিচারপতি মোরশেদ একজন আইনবিদ ও বিচারপতিই ছিলেন না, ছিলেন একজন যথার্থ সংস্কৃতিমান ব্যক্তিত্ব, যিনি বিচারপতির আসনে অধিষ্ঠিত থেকে সুযোগ সীমিত থাকা সত্ত্বেও নানা ধরনের রাজনৈতিক-সামাজিক দায়িত্ব পালন করে যশস্বী হন।

সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রের তুলনায় আইন পেশায় বাঙালি মুসলমানের প্রবেশ ঘটে অনেক বিলম্বে। উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের গোড়ার দিকে পাশ্চাত্যে শিক্ষিত মুসলমান আইনজীবীর সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য। অথচ স্বাধীন পেশা হিসেবে তখনো সমাজে আইন পেশার গুরুত্ব ছিল অসামান্য। বিশেষ করে ঔপনিবেশিক আমলে তাঁরা রাজনৈতিক ও অন্যান্য সামাজিক আন্দোলনে অংশ নিতে পারতেন অন্য পেশাজীবীদের তুলনায় অনেক বেশি।

সৈয়দ মাহবুব মোরশেদের পূর্বপুরুষ স্যার সৈয়দ আমীর আলী (৬ এপ্রিল, ১৮৪৯-৩ আগস্ট, ১৯২৮) কলকাতা হাই কোর্টের প্রথম মুসলমান বিচারপতি নিযুক্ত হন ১৮৯০ সালে। এরপর তাঁর ছেলে সৈয়দ তারেক আমীর আলীসহ আরও অনেক বাঙালি মুসলমান হাই কোর্টের বিচারপতি হন। সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ হাই কোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর। বিচারপতি হিসেবে তাঁর এ সম্মানজনক আসন গ্রহণের মধ্য দিয়ে তখনকার সমাজে বাঙালি মুসলমানদের জন্য উচ্চ আদালতসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের রুদ্ধদ্বার উন্মোচিত হতে শুরু করে। সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণে তাঁর কর্মক্ষেত্র ছিল অনেক প্রসারিত।

বাংলা-ইংরেজি ছাড়াও আরবি-ফারসি ভাষায় তাঁর পান্ডিত্য ছিল। আইন ছাড়াও তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতির বিষয়ে বহু প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। অখন্ড পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি অসামান্য ভূমিকা রেখে গেছেন। নির্ভেজাল গণতন্ত্রের পক্ষে তিনি ছিলেন একজন অবিচল প্রবক্তা। সর্বোপরি তাঁর সেই ব্যক্তিত্ব ও বৈদগ্ধ্য সব প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা ও উজ্জ্বলতাকেও অতিক্রম করেছে।

হজরত ইমাম হোসাইনের বংশধরদের একজন বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদের পূর্বপুরুষ মুফতি সৈয়দ আলী রাশেদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলের প্রথম দিকে সদর দেওয়ানি আদালতের বিচারক ছিলেন। তাঁর পিতা সৈয়দ আবদুস সালেকও একজন সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে তিনি যোগ দেন বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর হিসেবে বগুড়া, দিনাজপুর প্রভৃতি জেলায় নিযুক্ত ছিলেন। একজন ধর্মপ্রাণ, সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর বেশ খ্যাতি ছিল। মাহবুব মোরশেদের মা আফজালুন্নেসা বেগম ছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের বোন। মাতামহ কাজী ওয়াজেদ আলী ছিলেন উপমহাদেশের প্রথম মুসলমান আইন গ্র্যাজুয়েট প্রখ্যাত সমাজ-সংস্কারক নবাব আবদুল লতিফের জ্ঞাতি ভাই। পিতা ও মাতা উভয় দিক থেকেই মোরশেদ ছিলেন ঐতিহ্যসম্পন্ন পরিবারের উত্তরাধিকারী। ১৯৩৯ সালের ১ অক্টোবর কলকাতার মেয়র এ কে এম জাকারিয়ার মেয়ে লায়লা আরজুমান্দ বানুর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন মাহবুব মোরশেদ।

মাহবুব মোরশেদ কলকাতা হাই কোর্টে আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন ১৯৩৪ সালে। তবে তিনি মামা ফজলুল হকের সহকারী না হয়ে সুভাষচন্দ্রের অগ্রজ শরৎচন্দ্র বসু (১৮৮৯-১৯৫০) এবং খ্যাতনামা অবাঙালি আইনজীবী কে বি খাইতানের জুনিয়র হয়ে কাজ করার দুর্লভ সুযোগ লাভ করেন। কিন্তু এর অল্প কিছু দিনের মধ্যেই তিনি আইনে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য যুক্তরাজ্যে যান। ১৯৩৮ সালে তিনি লন্ডনের বিখ্যাত লিংকন’স ইন থেকে বার অ্যাট ল (ব্যারিস্টার) ডিগ্রি লাভ করেন। দেশে ফিরে আবার আইন পেশায় আত্মনিয়োগ করেন এবং ১৯৫১ সালে ঢাকা হাই কোর্ট বারে যোগ দেন।

১৯৫৫ সালে যখন মোহাম্মদ আলী (বগুড়া) পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আইনমন্ত্রী তখন সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ পূর্ব পাকিস্তান হাই কোর্টের বিচারক হিসেবে যোগ দেন।

১৯৫৮-এর অক্টোবরে জেনারেল আইয়ুব খান রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। সংসদীয় গণতন্ত্রের শাসনব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে যায়। মানুষের সব মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়। তখন দেশের উচ্চ আদালতের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতরও বটে। বিচারপতি মোরশেদ প্রধান বিচারপতি থাকা অবস্থায়ই প্রচন্ড সাহসিকতা ও গভীর দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছেন। ১৯৬৬ সালে তিনি ঐতিহাসিক ছয় দফার খসড়া প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৯-এ আইয়ুবের গোলটেবিল বৈঠকে বিচারপতি মোরশেদ ওয়ান ম্যান ওয়ান ভোট দাবি করেছিলেন। তাঁর যুক্তি ছিল, ওয়ান ইউনিট পাকিস্তান ভেঙে দেওয়ার পর জনসংখ্যার ভিত্তিতে পূর্ববাংলা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬৯টি আসন পূর্ব বাংলার প্রাপ্য।

লেখক : কবি ও শিশুসাহিত্যিক।

সর্বশেষ খবর